Thank you for trying Sticky AMP!!

নদীয়ায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

৫১ বছর আগে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের যে গৌরবময় ইতিহাসের শুরু নদীয়া থেকে

ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে পড়েছে ৫১টি বছর। ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই অর্থাৎ আজকের দিনে দেশের ক্রীড়া ইতিহাস নিয়েছিল আশ্চর্য এক মোড়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য সব জনপদ যখন রক্তাক্ত, ঠিক তখন পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম সাক্ষী হলো অনন্য এক ইতিহাসের। ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল প্রথম ম্যাচটি খেলে সেদিন, প্রতিপক্ষ নদীয়া জেলা ক্রীড়া সমিতি দল।

স্বাধীনতার জন্য জনমত তৈরি আর তহবিল গড়তেই এপার বাংলার একদল ফুটবলযোদ্ধা ফুটবল ম্যাচ খেলা শুরু করেন ভিনদেশে। ম্যাচের সংখ্যা কোথাও বলা হচ্ছে ১৩টি, কোথাও ১৬টি। সেই ম্যাচ থেকে ওঠা ঠিক কত টাকা মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দেওয়া হয়, সে নিয়েও আছে দুই রকম তথ্য। কোথাও উল্লেখ রয়েছে ১৬ লাখ, কোথাও ৫ লাখ টাকা।

বল পায়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়েছিল স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

সংখ্যাতত্ত্বের এই বিভ্রান্তি এক পাশে থাকুক। দৃষ্টিটাকে বরং ৫১ বছর আগে আজকের দিনে ফিরিয়ে বলা যাক, স্বাধীন বাংলা দলের জার্সিতে প্রথম ম্যাচের সেই ফুটবল-দূতদের অনেকেই আর নেই। নওশেরুজ্জামান, আইনুল হক, অমলেশ সেনরা পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। সে সময় ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণ শিবির থেকে বিমানে উড়িয়ে এনে প্রথম ম্যাচটি খেলানো গোলরক্ষক খোন্দকার নূরন্নবীও আজ শুধুই ছবি। কিন্তু তাঁদের রেখে যাওয়া স্মৃতি আর সাহসের গল্প প্রজন্মান্তরে প্রেরণা হয়েই থাকবে। বিশ্ব ফুটবলগ্রহে তাঁরা জন্ম দিয়ে গেলেন ৩৫ জন ফুটবলার নিয়ে গড়া স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল নামে অবিশ্বাস্য এক অধ্যায়ের।

প্রথম ম্যাচে ৪-২-৪ ছকে খেলেছিল স্বাধীন বাংলা দল। গোলপোস্টে ছিলেন নূরন্নবী। লেফটব্যাক আবদুল হাকিম, রাইটব্যাক বিমল কর, স্টপারে অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও আইনুল হক। মাঝমাঠে কায়কোবাদ ও খোকন। রাইট উইংয়ে নওশেরুজ্জামান, লেফটে সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরা। দুই স্ট্রাইকার কাজী সালাউদ্দিন ও এনায়েতুর রহমান। এপার বাংলার খেলোয়াড়দের জন্য নদীয়াবাসী যেন শুভেচ্ছার লাল কার্পেট বিছিয়ে দিলেন ম্যাচের আগে, সিক্ত করলেন ভালোবাসায়। ব্যাপ্তিতে এটি নিছকই একটি ফুটবল ম্যাচ, যার চূড়ান্ত স্কোরলাইন ২-২। কিন্তু এর ঐতিহাসিক আবেদন বিশাল। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম মোড়ে আজও যেন অদৃশ্য সাইনবোর্ড ঝুলছে, যেখানে সোনার হরফে লেখা, এখানেই পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যতিক্রমী এক ফুটবল দলের যাত্রা হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের দুই সদস্য প্রতাপ শংকর হাজরা ও আইনুল হক

জাকারিয়া পিন্টু ও প্রতাপ শংকরের নেতৃত্বে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ম্যাচ-পূর্ব মাঠ প্রদক্ষিণের ছবিটা বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবিই হয়ে আছে। ক্রীড়া সাংবাদিক ও পাক্ষিক ক্রীড়া জগতের সম্পাদক দুলাল মাহমুদের খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধ বইয়ে রয়েছে সেই দিনের সচিত্র বর্ণনা।

২৫ জুলাই নদীয়া জেলা ক্রীড়া সমিতির সঙ্গে প্রথম ম্যাচের আগে তোলা হয় নানা ছবি, যা ইতিহাস তুলে ধরছে। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দেন লুৎফর রহমান, জাকারিয়া পিন্টু ও মুজিবুর রহমান। অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও সহ–অধিনায়ক প্রতাপ শংকর একসঙ্গে আছেন এক ছবিতে। গ্রুপ ছবিতে দাঁড়িয়ে নদীয়ার জেলা প্রশাসক, মুজিবুর রহমান, আশরাফ আলী চৌধুরী, এন এ চৌধুরী, মোহাম্মদ মহসীন, কোচ ননী বসাক, এম এ মতিন প্রমুখ আছেন। বাংলাদেশের পতাকার সামনে বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতির সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমানের দাঁড়িয়ে থাকার ছবিটাও মনকাড়া।

ম্যাচ-পূর্ব শুভেচ্ছা বিনিময়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিতি পর্ব সারেন নদীয়ার জেলা প্রশাসক ডি কে ঘোষ। তখন তাঁর পাশে ছিলেন তরুণ সালাউদ্দিন, এনায়েত, প্রতাপ শংকর হাজরা, অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু, আশরাফ আলী চৌধুরী। স্বাধীন বাংলা দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টুকে স্মারক উপহার দেন নদীয়া দলের অধিনায়ক।

নদীয়া দলের অধিনায়কের কাছ থেকে স্মারক উপহার নিচ্ছেন স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু

সেই অবিস্মরণীয় দিনের ৫১ বছর পূর্তিতে দুকূল উপচানো আবেগ টের পাচ্ছেন তৎকালীন তরুণ প্রতাপ শংকর। চোখে-মুখে অদৃশ্য আবেগের প্লাবন নামে ম্যাচটির কথা তুলতেই। স্মৃতির সেলুলয়েডের ফিতায় সেসব দেখতে দেখতে প্রতাপ শংকর বলে চলেন, ‘ প্রথম ম্যাচটি খেলতে আমরা কলকাতা থেকে নদীয়া পৌঁছাই। সবাই শিহরিত ছিলাম তখন। কিন্তু সমস্যা হলো লেফট হাফে কে খেলবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়। কেউ চাইছিল নওশের খেলুক, কারও পছন্দ তসলিম। শেষে টসে ওঠে নওশেরের নাম। এসব আজকের দিনে খুব বেশি মনে পড়ে। আসলে স্বাধীন বাংলা দলের হয়ে পুরো ভ্রমণটাই কখনো ভোলার নয়। বিশেষ করে প্রথম ম্যাচটা বেশিই মনে দোলা দেয়।’

প্রতাপ শংকর স্মৃতিতে ডুব দেন, ‘সেদিন মাঠে গিয়ে দেখি মাঠে ভারতের পতাকা ওড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। তার আগেই পিন্টু ভাই আর আমি গোপনে সিদ্ধান্ত নিই, ম্যাচের আগে বাংলাদেশের পতাকা হাতে মাঠে দৌড়াব আমরা। আমরা গোঁ ধরায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হলো এবং তা করলেন পিন্টু ভাই। ২০-২৫ হাজার দর্শকে ঠাসা কৃষ্ণনগর স্টেডিয়ামে তখন ৯০ ভাগ দর্শকই দাঁড়ানো। প্রথমার্ধের পর আমি উঠে যাই এবং আমার জায়গায় শাহজাহান নামে। আমরা পিছিয়ে থেকে সম্ভবত ২-১ করি এবং শেষ পর্যন্ত ম্যাচের ফল ২-২ (স্বাধীন বাংলা দলের গোলদাতা শাহজাহান ও এনায়েত)।’

স্বাধীন বাংলা দলের অন্দরে ওই দিনটি তৈরি করেছিল দেশের প্রতি ভালোবাসার এক অবিশ্বাস্য মোহনা। কিন্তু দিনটি বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে আজও উপেক্ষিত। দিনটি নীরবে আসে, নীরবে চলে যায়। জাতীয় পর্যায়ে স্মরণ করা দূরে থাক, কোনো সংগঠনও দিনটি মনে করে না আলাদাভাবে।

স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছের নদীয়ার জেলা প্রশাসক

আর তা দেখে ব্যথিত সেই ম্যাচের অন্যতম খেলোয়াড় শেখ আশরাফ আলী, যিনি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় দলেরও একজন গর্বিত সদস্য। ১৯৭২ সালে আবাহনীতে নাম লিখিয়ে টানা খেলে যান আকাশি নীল জার্সিতে। সেই আশরাফ আলী স্মৃতির পুকুরে ডুব দিয়ে বলছিলেন, ‘যত দূর মনে পড়ে, আমরা সেদিন হাতে লাল বর্ডার দেওয়া সবুজ গেঞ্জি আর সবুজ শর্টস পরে নেমেছিলাম। আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম ভালো খেলব এবং খেলেছি। দেশের সম্মান আমরা রেখেছি।’

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে ঐতিহাসিক এক দিন ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই। দিনটির কথা পাঠ্যবইয়ে থাকা উচিত ছিল মনে করেন শেখ আশরাফ আলী। সেটি নেই বলে তাঁর অনেক আক্ষেপ। বলেন, ‘জীবদ্দশায় যদি দেখতে পেতাম যে স্বাধীন বাংলা দলের সেই ঐতিহাসিক প্রথম ম্যাচের গল্পটা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, অনেক খুশি হতাম। কিন্তু তা আর হলো কই! কোনোভাবে স্মরণেই তো আসে না দিনটা। এসব দেখে দুঃখ লাগে, কষ্ট পাই।’

এই দুঃখটাই নিরন্তর কষ্ট দেয় প্রতাপ শংকর, জাকারিয়া পিন্টুদের। যাঁরা আজ থেকে ঠিক ৫১ বছর আগে ভিনদেশের মাটিতে অনন্য এক যাত্রার শুরুটা করেছিলেন।