Thank you for trying Sticky AMP!!

ম্যানচেস্টার সিটি কোচ পেপ গার্দিওলা ও লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ

গার্দিওলা-ক্লপ, দ্বৈরথ ছাড়িয়েও যারা বন্ধু

১ জুন ২০১৯।

ওয়ান্দা মেত্রোপলিতানোতে ম্যাচটা শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। টটেনহামকে ২-০ গোলে হারিয়ে পাওয়া চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি নিয়ে লিভারপুল খেলোয়াড়দের উৎসব চলছে। মাঠে উদ্‌যাপন শেষ হওয়ার পর ড্রেসিংরুমে ফিরেও সেই উৎসব চলল অনেকক্ষণ। খেলোয়াড়েরা আনন্দে পাগলপারা অবস্থা। এর মধ্যেই বড়সড় এক বিয়ারের মগ হাতে ড্রেসিংরুমে ঢুকলেন লিভারপুল কোচ ইয়ুর্গেন ক্লপ। তাঁর অবস্থাও খেলোয়াড়দের মতোই। পৃথিবীর সব বিয়ার একাই পান করবেন, এমন ভাব।

ড্রেসিংরুমে ঢোকামাত্রই ক্লপের হাতে একটা মুঠোফোন দিয়ে গেলেন লিভারপুলের প্রধান ফিজিও লি নোবস। রিং বাজছে তাতে। ‘আমি এক ঝলক স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নামটা দেখেছিলাম—পেপ কলিং...’, পরে ঘটনাটার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেছেন ক্লপ। তিনি ভেবেছিলেন তাঁর সহকারী পেপ লিন্ডার্স কল করেছে। কথা বলা শুরু করার কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলেন, লোকটা পেপ লিন্ডার্স নন, পেপ গার্দিওলা! ক্লপকে চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতায় অভিনন্দন জানাতে ফোন দিয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটির কোচ।

প্রিমিয়ার লিগে তখন দুজন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বী। ওই মৌসুমেই ৯৭ পয়েন্ট পেয়েও ক্লপের লিভারপুল লিগ জিততে পারেনি, কারণ তাদের চেয়ে ১ পয়েন্ট বেশি পেয়ে শিরোপা নিয়ে গেছে পেপ গার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটি। নিয়ে গেছে এফএ কাপ, লিগ কাপও। এমন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যেও সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ একটা ট্রফি জেতার পরপরই যে ট্রফিটা আবার অন্যজনের খুবই কাঙ্ক্ষিত, তিনি নিজের আক্ষেপ ভুলে গিয়ে অন্যজনকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, কিছুটা অস্বাভাবিক ঘটনা তো বটেই। একবার মনে করে দেখুন তো, নিজেদের দ্বৈরথের সেরা সময়টাতে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন কিছু জেতার পর আর্সেন ওয়েঙ্গার কি অভিনন্দন জানিয়ে ফোন দিয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে? কিংবা গার্দিওলা নিজেই কি কখনো এমন ফোন দিয়েছেন জোসে মরিনিওকে? এ রকম কিছু শোনা যায়নি কখনো।

ওই ঘটনার প্রায় ৫ বছর পর অ্যানফিল্ডে আজ মুখোমুখি হচ্ছেন ক্লপ-গার্দিওলা। এর মধ্যেও হয়েছেন আরও অনেকবার। তবে আজকের ম্যাচটার মাহাত্ম্য, লিগে এটাই ক্লপ-গার্দিওলার শেষ লড়াই। মৌসুম শেষেই লিভারপুল ছাড়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন ক্লপ। বলেছেন কোচিং থেকে আপাতত অবসরে যাওয়ার কথাও। এফএ কাপে এখনো সিটি ও লিভারপুল দুই দলই টিকে আছে। সেখানে দুই দল সেমিফাইনাল বা ফাইনালে মুখোমুখি হলেও হতে পারে। যদি সেটা না হয়, তাহলে আজই শেষ হচ্ছে ক্লপ-গার্দিওলার দারুণ রোমাঞ্চকর, তীব্র এবং আনন্দদায়ক এক দ্বৈরথ।

Also Read: ক্লপের জীবনে দেখা সেরা কোচ গার্দিওলা

এ রকম তীব্র লড়াই যাঁদের মধ্যে থাকে, তাঁরা কখনো কখনো না চাইলেও একে অন্যের ‘শত্রু’ হয়ে যান। গার্দিওলা-ক্লপ এ ক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম কীভাবে হয়ে গেলেন! বেশি দূর যাওয়ার দরকার নেই, শুধু আজকের ম্যাচটা সামনে রেখে লিভারপুল কোচ ক্লপের কথাগুলো শুনুন। একাধিকবার বলেছেন, তাঁর জীবনে দেখা সেরা কোচ পেপ গার্দিওলা। অবশ্য শুধু আজকের ম্যাচের আগে নয়, একই কথা ক্লপ আগেও বলেছেন অনেকবার।

অন্যদিকে গার্দিওলার চোখে ক্লপ এমন একজন, যিনি ফুটবলের পৃথিবীটাকে আরও সুন্দর বানিয়েছেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে গার্দিওলার শক্ত প্রতিপক্ষ তো অনেক কোচই ছিলেন। কিন্তু তাঁর চোখে সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ কে? গার্দিওলা একাধিকবার ক্লপের নাম বলেছেন। ক্লপ মৌসুম শেষে লিভারপুল ছেড়ে যাবেন, এমন ঘোষণা শুনে তাই তো বলেছিলেন, ‘যাক, এখন আমি লিভারপুলের বিপক্ষে ম্যাচের আগে শান্তিতে ঘুমাতে পারব!’ রসিকতা করে বলা কথাটার মধ্যেও যে কতটা শ্রদ্ধা মেশানো ক্লপের জন্য, সেটা বোঝা কঠিন কিছু নয়।

গার্দিওলার চোখে ক্লপই তাঁর সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ

কীভাবে এটা সম্ভব হলো? দুই কোচের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠতা আছে, এমন একজন একবার ইংল্যান্ডের দ্য টেলিগ্রাফকে বলেছিলেন, ‘ওদের মধ্যেও অহংবোধ আছে। কিন্তু ওরা পরস্পরের বেলায় এটা দূরে সরিয়ে রাখে, কারণ দুজনই জানে প্রতিপক্ষ হিসেবে অন্যজন কত ভালো।’ এটাই দুজনকে শত্রু না বানিয়ে আসলে ‘বন্ধু’ বানিয়ে দিয়েছে। সেই বন্ধুত্ব রোজকার দেখা-সাক্ষাতের বা পারিবারিক নয় বরং পারস্পরিক শ্রদ্ধার, আন্তরিকতার। এ জন্যই লিভারপুলকে ১ পয়েন্টে হারিয়ে সিটির লিগ জেতা এবং পরে লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর দুজন দেখা হলে রসিকতা করতে পারেন যে, ‘তুমি যে ট্রফিটা বেশি করে চেয়েছিলে, সেটা জিতেছি আমি, আমি যেটা চেয়েছিলাম, সেটা জিতেছ তুমি।’

Also Read: চেলসির ‘খরচের খেল’ দেখে বিস্মিত ক্লপ ও গার্দিওলা

দুই ক্লাব মুখোমুখি হওয়া ছাড়া এমনিতে দুজনের সাক্ষাৎ হয় খুব কম। কথাবার্তা যা হয় সেটা ফোনেই। সেখানেও আসলে ফুটবল নিয়েই নাকি কথা হয় বেশি। দুজন দুই ঘরানার কোচ। ক্লপ হাই প্রেসিং ফুটবল খেলান দলকে, যেটা ‘হেভি মেটাল’ ফুটবল হিসেবেও পরিচিত। অন্যদিকে গার্দিওলার দর্শনই, বলের দখল ধরে রেখে খেলা। তবে গত সাত বছরে দুজনই কি একে অন্যের কাছ থেকে কিছুটা প্রভাবিত হননি?

আর্লিং হলান্ডকে দলে নেওয়ার পর গার্দিওলাকে কিছুটা হলেও পাল্টাতে হয়েছে খেলার ধরন। সিটিকে তাই এখন প্রায়ই খুব সরাসরি পাসে আক্রমণে যেতে দেখা যায়। আবার দমিনিক সোবোসলাই-অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার-ওয়াতারো এন্দোকে নিয়ে গড়া লিভারপুলের মাঝমাঠকেও তো এখন দেখা যায় বেশ বল ধরে খেলছে। এই যে রাইট ব্যাক ট্রেন্ট আলেক্সান্ডার আরনল্ডকে ক্লপ রাইট উইংয়ে পাঠিয়ে দিয়েছেন, সেটাকে কি একসময় গার্দিওলার জোয়াও ক্যানসালোকে রক্ষণ থেকে আক্রমণে পাঠিয়ে খেলানোর দর্শনের প্রভাব আছে? চাইলে মিল খোঁজা যায়।

Also Read: ক্লপ-গার্দিওলা যেভাবে চমকে দিলেন সবাইকে

দুজন দুজনকে কতটা প্রভাবিত করেছেন, কিংবা আদৌ করেছেন কি না, সেই বিতর্ক পাশে রেখেও বলা যায়, সর্বশেষ সাত বছরের তাঁদের এই দ্বৈরথ ইংলিশ ফুটবল, ইউরোপিয়ান ফুটবল এমনকি বিশ্ব ফুটবলকেও অনেক প্রভাবিত করেছে। অবশ্য দ্বৈরথের শুরুটা আরও অনেক আগে, জার্মানিতে। তখন একজন ছিলেন বায়ার্ন মিউনিখে, অন্যজন বরুসিয়া ডর্টমুন্ডে। ২০১৩ জার্মান সুপার কাপে ডর্টমুন্ডের ৪-২ গোলের জয় দিয়ে যে লড়াইয়ের শুরু, সেটা হয়তো শেষ হচ্ছে আজ অ্যানফিল্ডে। পরিসংখ্যান বলছে, ২৯টি মুখোমুখি লড়াইয়ে এখন পর্যন্ত ১১ বার জিতেছেন ক্লপ, ১০ বার গার্দিওলা। ড্র হয়েছে বাকি ৮ ম্যাচ। অবশ্য এই ৮ ড্রয়ের দুটি পেনাল্টিতে নিষ্পত্তি হয়েছে, সেখানেও ১-১ সমতা। আজ গার্দিওলা জিতলে স্মরণীয় এই দ্বৈরথ শেষ হবে এক অবিশ্বাস্য সমতায়! আর সেটা যদি না–ও হয়, দুজনের সম্পর্কে তাতে কোনো হেরফের হবে বলে মনে হয় না।

কেন হবে না, সেটা ক্লপের কথা শুনলেই বুঝতে পারবেন, ‘সে (গার্দিওলা) আমাকে বলে রেখেছে, আমরা দুজনই যখন আর কোনো ক্লাবের দায়িত্বে থাকব না, সময় করে বসব দুজন। ওয়াইনের গ্লাস থাকবে হাতে। ফুটবল নিয়ে কথা বলব। আমি অবশ্য খুব একটা ওয়াইনপ্রেমী নই। তবে ওর ডাকে অবশ্যই যাব। আমাদের আড্ডাটা হবে।’

যদি ফুটবল ভালোবাসেন, সেই আড্ডায় থাকার ভীষণ লোভ নিশ্চয়ই আপনারও হচ্ছে।

Also Read: লিভারপুলের ভালো খেলার কারণ ক্লপ নন, ম্যানচেস্টার সিটি