Thank you for trying Sticky AMP!!

লিভারপুলের কোচ হওয়ার দৌড়ে থাকা আর্নে স্লট

লিভারপুলের পথে থাকা আর্নে স্লটের ‘আবেদনময়ী’ ফুটবল–দর্শন কেমন

একখণ্ড কালো মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে আছে অ্যানফিল্ড রোডের আকাশ। আর মাত্র চারটি ম্যাচের অপেক্ষা, এরপরই শেষ হবে ইয়ুর্গেন ক্লপের সঙ্গে লিভারপুলের পথচলা। গত ৯ বছরে শূন্য লিভারপুলের ঝুলিকে সাফল্যে পূর্ণ করেছেন এই জার্মান কোচ। শিরোপা জিততে ভুলে যাওয়া ক্লাবটিকে সম্ভাব্য সব ট্রফির স্বাদ দিয়েছেন ক্লপ। তাঁর বিদায়ে নিশ্চিতভাবেই খেলোয়াড় ও ভক্তদের মন খারাপ হওয়ার কথা, হয়েছেও। তবে সাম্প্রতিক সময়ে লিভারপুলের পারফরম্যান্সের কারণে মন খারাপের বদলে ভর করেছে দুশ্চিন্তা।

ক্লপ যাওয়ার আগেই যেন ভেঙে পড়েছে দলটি। একের পর এক ব্যর্থতায় প্রায় ছিটকে গেছে সবগুলো প্রতিযোগিতা থেকে। কাগজে-কলমে এখনো প্রিমিয়ার লিগ জয়ের সম্ভাবনা থাকলেও সে জন্য অলৌকিক কিছুর অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে ক্লাবটিকে। এর মধ্যে চিড় ধরেছে খেলোয়াড়দের মনযোগেও। আগামী মৌসুম থেকে ক্লাবটির অবস্থা ক্লপপূর্ব-যুগের মতো হয়ে যায় কি না, সেই আশঙ্কাও আছে অ্যানফিল্ডজুড়ে!

Also Read: ক্লপের উত্তরসূরি হিসেবে এবার স্লটের দিকে চোখ লিভারপুলের

ক্লাবের বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের এ ক্রান্তিকালে আলোচনায় ‘অখ্যাত’ এক কোচ, নাম তাঁর আর্নে স্লট। কদিন আগেও আলোচনার বাইরে থাকা এই কোচের ক্লপের উত্তরসূরি হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার। এরই মধ্যে লিভারপুল ও ফেইনুর্দ নাকি তাঁর ব্যাপারে ঐক্যমতেও পৌঁছেছে। তবে বিপর্যস্ত সময় পার করা লিভারপুল সমর্থকেরা অবশ্য স্লটকে নিয়ে আছেন সন্দেহের দোলাচলে। তাঁকে কোচ করে আনার সিদ্ধান্ত আদৌ ফলপ্রসূ হবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান তারা। স্লট অবশ্য লিভারপুলের কোচ হওয়ার জন্য বেশ মরিয়া। তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে এটা স্পষ্ট যে আমি লিভারপুলে যেতে চাই। এখন ক্লাব দুটি ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারে কি না, সেদিকেই তাকিয়ে আছি। আমি খুবই আত্মবিশ্বাসী।’

প্রশ্ন হচ্ছে, স্লট আসলে কেমন কোচ? তাঁর কৌশল, দর্শন এবং দক্ষতাই বা কেমন? সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, লিভারপুলের মতো ক্লাবে ক্লপের মতো বিশ্বসেরা কোচের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার যোগ্যতা কি তাঁর আছে?  

৪৫ বছর বয়সী স্লটের খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার অবশ্য খুব সমৃদ্ধ নয়। ১৮ বছরের ক্যারিয়ারে বড় কোনো ক্লাবে খেলা হয়নি এই আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের, খেলেছেন মূলত দ্বিতীয় সারির লিগে। কখনো খেলা হয়নি জাতীয় দলেও। শ্লথগতির খেলোয়াড় হিসেবে দুর্নামও ছিল তাঁর। কিন্তু নিজের এই দুর্বলতাকে তিনি ঢেকে দিয়েছিলেন পাসিংয়ের দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। পাশাপাশি খেলোয়াড়ি জীবনেই কোচিংয়ের প্রতি আগ্রহের দরজা খুলে গিয়েছিল স্লটের। সে সময় দলের কোচদের নাকি বেশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতেন সাবেক এই ডাচ ফুটবলার। কোচ কীভাবে দলকে খেলাচ্ছেন, খেলোয়াড়দের কীভাবে সামলাচ্ছেন—তা নিয়েও বেশ আগ্রহ ছিল স্লটের।

ফেইনুর্ডের ডাগআউটে আর্নে স্লট

তাঁর একসময়ের সতীর্থ ব্রাম ফন পোলেন জানিয়েছেন, স্লট নাকি ডাচ ক্লাব পিএইসি জোলেতে নিজের খেলোয়াড়ি জীবনের শেষ দিকে কোচের মতোই আচরণ করতেন। এই আগ্রহই অবশ্য তাঁকে নিয়ে আসে কোচিংয়ের জগতে। ২০১৩ সালে ফুটবলকে বিদায় জানিয়ে জোলের যুব দলের দায়িত্ব নেন স্লট। এক বছর পর তিনি আরেক ডাচ ক্লাব কামবুরের হয়ে সহকারী কোচ হিসেবে যাত্রা শুরু করেন। ২০১৬ সালে দলের মূল কোচের দায়িত্বও নেন স্লট। যেখানে ক্লাবকে দারুণ কিছু সাফল্যও এনে দেন।

স্লট অবশ্য আসল চমক দেখান ডাচ ক্লাব এজেড আলকমারের দায়িত্ব নিয়ে। শুরুতে অবশ্য তিনি জন ফন ডেন ব্রোমের সহকারী হিসেবে কাজ করেন। সে সময় ক্লাবটির স্পোর্টিং ডিরেক্টর ম্যাক্স হিবের্টস দারুণ মুগ্ধ হন স্লটের কোচিং দক্ষতায়। এর মধ্যে ২০১৮ ও ২০১৯ মৌসুমে ডাচ শীর্ষ লিগ তিন ও চার নম্বরে থেকে শেষ করে এজেড, ২০১৮ সালে ফেইনুর্দের কাছে হেরে যায় ডাচ কাপের ফাইনালে।

Also Read: ক্লপের বিদায়ের পর লিভারপুলের নতুন কোচ হবেন কে

যার ফল হিসেবে একই বছরের ডিসেম্বরে ব্রোমকে সরিয়ে ২০১৯-২০ মৌসুমে স্লটকেই প্রধান কোচ করার ঘোষণা দেয় এজেড। দায়িত্ব নিয়েই কোচ হিসেবে রীতিমতো জাদু দেখাতে শুরু করেন এই ডাচম্যান। প্রথমবারের মতো ক্লাবকে ৮ ম্যাচে এনে দেন ১৯ পয়েন্ট। তাঁর অধীনেই এজেড প্রথমবারের মতো ইউরোপা লিগের নকআউট পর্বে জায়গা করে নেয়। ২০১৯-২০ মৌসুমে ডাচ শীর্ষ লিগের শিরোপা জয়ের সম্ভাবনাও জাগিয়ে তুলেছিল স্লটের এজেড।

২৫ ম্যাচ শেষে শীর্ষে থাকা আয়াক্সের সমান ৫৬ পয়েন্টই ছিল এজেডের। শুধু গোল ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে দুইয়ে ছিল তারা। স্লটের চমক দেখানো দলটি সেবার আয়াক্স, ফেইনুর্দ এবং পিএসভির মতো দলকে হারিয়ে বেশ আলোড়নও তোলে। তবে করোনা মহামারির কারণে লিগ বাতিল করলে এজেডের হয়ে লিগ জেতার স্বপ্ন সেখানেই শেষ হয়ে যায়। লিগ জেতা না হলেও নিজের কোচিং দক্ষতায় সবার নজর কেড়ে নেন এ কোচ। এরপর ২০২১ সালে তাঁকে নিয়ে নেয় ডাচ ক্লাব ফেইনুর্দ।

স্লটের অধীনে প্রথম মৌসুমে তিন নম্বরে থেকে মৌসুম শেষ করে ফেইনুর্দ। পাশাপাশি ইউরোপিয়ান মঞ্চেও নিজের অস্তিত্বের জানান দেন এই কোচ। উয়েফা কনফারেন্স লিগে ফাইনালে নিয়ে যান ফেয়েনুর্ডকে। ফাইনালে অবশ্য জোসে মরিনিওর এএস রোমার বিপক্ষে ১-০ গোলে হেরে যায় স্লটের দল। প্রথম মৌসুমে সাফল্যের কাছাকাছি গিয়ে নিরাশ হতে হলেও পরের মৌসুমে ঠিকই দলকে লিগ শিরোপা জেতান স্লট।

মৌসুম শেষে লিভারপুল ছাড়বেন ইয়ুর্গেন ক্লপ

এরপর ২০২৩-২৪ মৌসুমে জিতেছেন ডাচ কাপের শিরোপাও। আর ব্যক্তিগত অর্জনের ঝুলিতে যুক্ত হয় টানা দুই বছর সেরা কোচের সম্মানও। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ মৌসুমে রাইনাস মিশেল অ্যাওয়ার্ড নামের এই পুরস্কারটি জেতেন স্লট।
এ তো গেল স্লটের সাফল্যগাথা, যা তাঁর কোচিংয়ের সময়কাল বিবেচনায় একেবারেই সামান্য নয়। এই অল্প সময়ে নিজের সাফল্য-ক্ষুধার পরিচয়ও বেশ ভালোভাবে রেখেছেন তিনি। কিন্তু বড় প্রশ্ন হচ্ছে, স্লটের কৌশল আসলে কেমন? তিনি কীভাবে দলকে খেলাতে পছন্দ করেন? প্রিমিয়ার লিগের মতো উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন লিগে তিনি কি আসলেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবেন?  

স্লটের কৌশলকে বোঝার জন্য ফিরে যাওয়া যেতে পারে গত মৌসুমে ইউরোপা লিগের সেমিফাইনালে। যেখানে এএস রোমার মুখোমুখি হয়েছিল ফেইনুর্দ। সে সময় রোমা কোচ মরিনিওর কৌশল নিয়ে জানতে চাওয়া হয় স্লটের কাছ থেকে। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তার কৌশল পছন্দ করি না। মরিনিওর দলের খেলা দেখতে আমার ভালো লাগে না। আমি শুধু পেপ গার্দিওলার দলের খেলা দেখি। কারণ, প্রতিবার আমি কিছু না কিছু শিখতে পারি।’

স্লটের কোচিং–দর্শন এ কথাটুকুতেই অনেকটা স্পষ্ট। তিনি দলকে মূলত আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলাতেই পছন্দ করেন। রক্ষণাত্মক ও দৃষ্টিকটু কৌশলের ধারণায় আস্থা নেই তাঁর। মাঠে বলের দখল নিজের দলের খেলোয়াড়দের কাছেই দেখতে চান। কিন্তু উদ্দেশ্যহীনভাবে বলের দখল চান না স্লট। তাঁর দলের প্রতিটি আক্রমণকে তিনি প্রতিপক্ষের বক্সে গিয়ে ফাইনাল শটে শেষ হওয়ার মধ্য দিয়ে পরিণতি পেতে দেখতে চান।

Also Read: লিভারপুলের নয়, ওয়েস্ট হাম মালিকের পাঠানো বিমানে আমোরিম

গার্দিওলার কোচিং–দর্শনে অনুপ্রাণিত হলেও প্রতিপক্ষের শক্তি অনুযায়ী নিজের কৌশল বদলাতেও দ্বিতীয়বার ভাবেন না। পজিশন ধরে রেখে খেলাতে পছন্দ করা এই কোচই কনফারেন্স লিগের সেমিফাইনালে মার্শেইয়ের বিপক্ষে দলকে খেলিয়েছিলেন লং পাসের ফুটবল। কৌশল বদলেই সেদিন ২০ মিনিটের মধ্যে ২-০ গোলে এগিয়ে ছিল ফেইনুর্দ। পরে ম্যাচটি তারা জিতেছিল ৩-২ গোলে। বিশেষ মুহূর্ত বাদ দিলে দলকে তিনি ৪-২-৩-১ ফরমেশনে খেলাতে এবং ডাবল পিভট ব্যবহার করে মাঝমাঠ ধরে আক্রমণে যেতে পছন্দ করেন।

এজেড ক্লাবে সহকারী কোচ হিসেবে কাজ করার সময় প্রধান কোচ ব্রোম নাকি স্লটের ফুটবলীয় কৌশলকে নাম দিয়েছিলেন, ‘সেক্সি (আবেদনময়ী) ফুটবল।’ সম্প্রতি একই কথা বলেছেন ডাচ ফুটবল সাংবাদিক মার্সেল ফন ডার ক্রান। তিনি বলেছেন, ‘সে একজন সফল কোচ এবং ফেইনুর্দকে চ্যাম্পিয়ন করেছেন। দলকে তিনি পাগলাটে এবং সেক্সি ফুটবল খেলান। ফুটবল মাঠে এই লোক যা করে দেখান, তা সত্যিই আবেদনময়ী।’

Also Read: কোথায় হারাল ক্লপের ‘হেভিমেটাল’ ফুটবল

ক্লপের ফুটবল–দর্শনের সঙ্গে পুরোপুরি না মিললেও দর্শনগত জায়গায় ক্লপের ‘হেভিমেটাল’ ফুটবলের সঙ্গে বেশ মিলও আছে স্লটের। লিভারপুল সমর্থকেরাও দলকে গতিময় ও আক্রমণাত্মক দেখতে চান। সঙ্গে চান ট্রফিও। স্লটের ট্রফি ক্যাবিনেট ও দর্শন বলছে, লিভারপুলের এই প্রত্যাশা পূরণের সামর্থ্য তাঁর আছে। সম্প্রতি খেলাধুলাভিত্তিক পোর্টাল দ্য অ্যাথলেটিকে সাবেক লিভারপুল ফরোয়ার্ড ডার্ক কুইটও বলেছেন, লিভারপুলের খেলার ধরনের সঙ্গে স্লট পুরোপুরি মানিয়ে যান।

এ ছাড়া কম খরচে এবং তরুণ ফুটবলারদের তৈরি করে সাফল্য পাওয়ার দিক থেকেও ক্লপের সঙ্গে মিল আছে স্লটের। খেলোয়াড়দের সঙ্গে স্লটের সম্পর্কও বেশ দারুণ। কীভাবে একজন খেলোয়াড়ের সেরাটা বের করে আনতে হয়, তা ভালোই জানা আছে তাঁর। এখন অপেক্ষা শুধু মাঠের খেলায় এসব প্রমাণ করে দেখানোর। তার আগে অবশ্য লিভারপুলের সঙ্গে স্লটের চুক্তিটাও আনুষ্ঠানিকভাবে আলোর মুখ দেখতে হবে।