Thank you for trying Sticky AMP!!

কিশোরগঞ্জে আজহারুলের খেলার পাঠশালা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম বলেই হয়তো জয়ের নেশা তাঁর। সেই নেশার টানেই বর্তমানে ৪৯ ছুঁই ছুঁই আজহারুল ইসলাম খান ২৫ বছর ধরে জাতীয় স্তরে খেলে চলেছেন। জাতীয় অ্যাথলেটিকসে চাকতি নিক্ষেপে (ডিসকাস) ৩২টি সোনার পদক জিতেছেন। সর্বশেষ জয় গত জানুয়ারিতে চট্টগ্রাম এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে ৪৪ তম জাতীয় অ্যাথলেটিকসে। ইভেন্টটিতে তিনবার গড়েন জাতীয় রেকর্ড। বর্তমান রেকর্ডও তাঁরই।

২০১০ সালে ঢাকায় দক্ষিণ এশিয়ান গেমস চাকতি নিক্ষেপে ব্রোঞ্জ জেতেন। এই গেমসে পুরুষ চাকতিতে এটিই বাংলাদেশের একমাত্র পদক। ২০১৩ সালে সার্জেন্ট হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েও নৌবাহিনীর হয়ে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে খেলছেন। দীর্ঘ খেলোয়াড়ি জীবনের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৭ সালে রূপচাঁদা-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারে বর্ষসেরা রানারআপ হন। পুরস্কার মঞ্চে তোলা একটা ছবি কিশোরগঞ্জ শহরে গাইটাল উপজেলা রোডে নিজের দোতলা বাড়ির ফটকে বড় করে টাঙিয়ে রেখেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের তিন মহা তারকা মাশরাফি বিন মুর্তজা, সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে হাস্যোজ্জ্বল আজহারুল।

কিশোরগঞ্জে খেলার পাঠাশালা গড়েছেন আজহারুল।

আজহারুলের বাড়িতে ঢুকতেই দৃষ্টি কেড়ে নেওয়া ছবিটা যেন এক লড়াকুর জীবনেরই গল্প বলে। গর্বিত আজহারুল ছবিটা দেখিয়ে বলেন, ‘এটি আমার জীবনের বড় এক অর্জন। কত বড় বড় তারকার সঙ্গে আমি এক মঞ্চে! মাশরাফি-সাকিবদের পাশে দাঁড়ানোর অনুভূতিই অন্য রকম।’

আজহারুল ওখানেই থামেননি। প্রতিদিন ভোর সাড়ে ছয়টায় বাইক নিয়ে ছোটেন বাড়ির পাশের কিশোরগঞ্জ সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়ামে। ততক্ষণে ৪০-৪৫ কিলোমিটার দূরের নেত্রকোনা থেকে ২ জন, ২৫ কিলোমিটার দূরে তাড়াইল উপজেলা থেকে ৮-১০ জন, ১৫ কিলোমিটার দূরে হোসেনপুর থেকে ১০ জন এবং ১২ কিলোমিটার দূরের করিমগঞ্জ উপজেলা থেকে ২ জন চলে আসেন। সবাই খেলোয়াড়। কেউ আসেন বাসে, কেউ অটোতে, কেউ সাইকেলে চেপে। তাঁদের নিয়ে আজহারুল তাঁর খেলার পাঠশালায় নেমে পড়েন কোচের ভূমিকায়।

করোনা-বিরতির আগে আজহারুলের ছাত্রছাত্রী ছিল প্রায় ১০০। এখন ১১৩। প্রতিদিন অনুশীলনে আসা খেলোয়াড় সংখ্যা ৩৫-৪০ থেকে বেড়ে এখন ৬০-৬৫। বিখ্যাত শোলাকিয়া ময়দান থেকে তিন কিলোমিটার দূরে কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামটি হয়ে উঠেছে ওই অঞ্চলের খেলোয়াড় তৈরির আঁতুড়ঘর। সেখানেই ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে আজহারুলের প্রতিষ্ঠিত ‘আজহার স্পোর্টস একাডেমি’-তে শেখানো হয় অ্যাথলেটিকস, ভারোত্তোলন ও বক্সিং। মাঝেমধ্যে কাবাডিও। সপ্তাহে ছয় দিন সকাল ৭টা থেকে ১০টা পর্যন্ত খেলা শেখান আজহারুল।

আজহার স্পোর্টস একাডেমিতে শেখানো হয় অ্যাথলেটিক্‌স, ভারোত্তোলন ও বক্সিং

একাডেমির ভর্তি ফি ৫০০ ও মাসিক বেতন ২০০ টাকা। ১৫-২০ জন খেলোয়াড় তা-ও দিতে পারে না। কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে আজহারুল বলছিলেন, ‘টাকা দেওয়ার নাম শুনলে অনেকে পিছটান দেয়। আমিও টাকার ব্যাপারে জোর করি না।’ উল্টো মাঝেমধ্যে খেলোয়াড়দের পেছনে খরচ করেন আজহারুলই। তাদের উজ্জীবিত করতে অনুষ্ঠান করেন। বিভিন্ন জায়গায় খেলা বা ট্রায়ালে যান নিজ খরচে। ভারোত্তোলনের কিছু সরঞ্জাম কিনেছেন, কিছু দিয়েছে ভারোত্তোলন ফেডারেশন। আজহারুল বলেন, ‘সংকট থাকলেও কাজটা করে যাচ্ছি। আমার সে অর্থে কোনো পারিশ্রমিক নেই।’

চাকরির আশায় খেলতে আসা

ছাত্রছাত্রীদের ৯০ শতাংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের। তাদের লক্ষ্য একটা চাকরি। সেই লক্ষ্যও পূরণ হচ্ছে আজহারুলের একাডেমিতে এসে। তিন বছরে আজহার একাডেমি থেকে সেনাবাহিনীতে ভারোত্তোলনে চাকরি পেয়েছেন ৪ জন, চাকতি নিক্ষেপে ১ জন। একই বাহিনীতে চুক্তিভিত্তিক আছেন ৩ জন। অধুনা লুপ্ত বিজেএমসির ক্রীড়া দলে ২ জন, বাংলাদেশ জেল ও বিমানবাহিনীতে চাকরি পান ১ জন করে। সবার আগে বাংলাদেশ জেল দলে চাকরি পাওয়া ডিসকাস থ্রোয়ার আলপনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশ জেল দলে পাওয়া চাকরিটা আমার জীবন ঘুরিয়ে দিয়েছে।’

কিশোরগঞ্জে সাড়া ফেলেছে আজহার একাডেমি।

মারজিয়া আক্তার গত বছর ঢাকায় জাতীয় ভারোত্তোলনে সোনা পেয়ে বাংলাদেশ দলের সঙ্গে উজবেকিস্তান সফরে যান। তিনি বলেন, ‘আজহার স্যারের একাডেমিতে না এলে এত দূর আসতে পারতাম না।’ সুরাইয়া আক্তারের কথা, ‘মা আমাকে এখানে দিয়ে গেছেন। ভারোত্তোলন খেলাটা খেলে যেতে চাই।’ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক খেলোয়াড় কিশোরগঞ্জের মেয়ে মাজেদা বেগম স্থানীয় মেয়েদের ফুটবল শেখান। কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামে দাঁড়িয়ে এই প্রতিবেদককে বলছিলেন, ‘আজহার একাডেমি এই অঞ্চলে সাড়া ফেলেছে। অন্য কোনো জেলায় এমনটা নেই।’

একাডেমি সাফল্যও পাচ্ছে। গত বছর জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে তিনটি রুপা জেতে মোহাম্মদ নাসিম। জাতীয় স্কুল ও মাদ্রাসা ক্রীড়ায় নাসিম ও মোসাম্মদ ঝুমা ময়মনসিংহ অঞ্চলে সেরা খেলোয়াড় হয়। ঊর্মি আক্তার বিকেএসপিতে অ্যাথলেটিকসে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। চারজন মেয়ে জাতীয় রাগবিতে কিশোরগঞ্জ জেলার হয়ে খেলেছেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে ঢাকায় সর্বশেষ জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে আসে তিনটি রুপা ও দুটি ব্রোঞ্জ। তবে সবচেয়ে বড় অর্জনটা এসেছে করোনার মধ্যে গত ১১-১২ সেপ্টেম্বর ভারোত্তোলন ফেডারেশন আয়োজিত অনলাইন আন্তক্লাব ভারোত্তোলনে। যেখানে ১৬ ক্লাবের মধ্যে ৬টি সোনা ও ২টি রুপা জিতে চ্যাম্পিয়ন আজহার একাডেমি।

আজহারুল বলেন, ‘কিশোরগঞ্জের ডিসি সাহেবসহ অনেকের সহযোগিতা পেয়ে এত দূর এসেছি।’ আজহারুলকে কিশোরগঞ্জ স্টেডিয়ামের মাঠ ব্যবহারের অনুমতি দেন জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ। ভারোত্তোলনের জন্য বরাদ্দ দেন স্টেডিয়ামের একটি কক্ষ। এ ছাড়া সরঞ্জাম কিনতে দেন নগদ ৫০ হাজার টাকা। জেলা প্রশাসক সারওয়ার মুর্শেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আজহারের মতো চ্যাম্পিয়ন খেলোয়াড় সব জেলায় নেই। তিনি আমাদের জেলার সম্পদ।’ মাঠপর্যায়ে সহযোগিতা করেন স্থানীয় ক্রীড়া কর্মকর্তা ও সাবেক ক্রীড়া সাংবাদিক আল-আমিন।

ম্যালেরিয়ার ভয়ে খেলাধুলায়

চাকরি না করলে হয়তো কৃষিকাজ করতেন ৯ ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয় আজহারুল। কৈশোরে বাবা জালাল উদ্দিন খানকে কৃষিকাজে সহায়তা করতেন। কিন্তু ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় ফসল না হওয়ায় অভাবের মধ্যে পড়েন তাঁরা। কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজমাঠে হাঁটতে হাঁটতে আজহারুল বলেন জীবনের গল্প, ‘তখন আমি মাদ্রাসার ছাত্র। ভাবতাম, একটা চাকরি হলে সংসারের হাল ধরতে পারি। তখন এসএসসি পরীক্ষার আগে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে লোক নিচ্ছিল। সবার আগে লাইনে গিয়ে দাঁড়াই। মনোনীত হয়ে ঢাকায় চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে যাই।’

১৯৮৯ সালের মার্চে সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পেয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করেন। এরশাদের পতনের পর খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় বদলি। আজহারুল বলেন, ‘মাটিরাঙ্গায় ক্যাম্পে সব শক্ত কাজই করতাম। প্রচুর পরিশ্রমেও ভেঙে পড়তাম না। ওই সময়ই ১৭-১৮ বার আমার ম্যালেরিয়া হয়। তখন ভাবতাম, খেলাধুলায় এলে ঢাকায় থাকতে পারব। ম্যালেরিয়া আর হবে না।’

১৯৯৩ সালে আজহারুল চলে আসেন ঢাকায়। সেনাবাহিনী দলে যিনি শটপুট করতেন, একদিন অনুশীলন দেখে তাঁকে চ্যালেঞ্জ করে বসেন আজহারুল। পাঁচ শ টাকা বাজি জিতে মিষ্টি খাওয়ান সবাইকে। ১৯৯৬ সাল থেকে সেনাবাহিনীর হয়ে ষষ্ঠ বাংলাদেশ গেমস দিয়ে জাতীয় প্রতিযোগিতায় খেলা শুরু আজহারুলের। চাকতি নিক্ষেপে সাফল্যের পাশাপাশি শটপুটেও জাতীয় প্রতিযোগিতায় ৬টি সোনা তাঁর। জাতীয় ভারোত্তোলনে একটি রেকর্ডসহ আছে ৩ সোনা। আজহারুল যেন ছোট খেলার এক বড় বিজ্ঞাপন।