Thank you for trying Sticky AMP!!

শাহ আলমের মতো অ্যাথলেট আর আসে না

প্রয়াত অ্যাথলেট শাহ আলম।

সাফল্যবুভুক্ষু বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনকে একাধিকবার জয়ের আনন্দে ভাসিয়েছেন তিনি। ১০০ মিটার স্প্রিন্টে পরপর দুবার রেকর্ড গড়ে সোনা জিতে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন।

কিন্তু দেশের ইতিহাসে সেরা অ্যাথলেট চলে গেছেন অসময়ে। মাত্র ২৮ বছর বয়সেই নিভে যায় শাহ আলমের জীবনপ্রদীপ। ১৯৯০ সালের ২৯ মে, অর্থাৎ আজকের দিনে গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী থেকে মোটরসাইকেলে ঢাকায় ফিরছিলেন। কিন্তু পথে পাবনার দাড়িয়াপুরে তেলবাহী ট্রাকের ধাক্কায় মর্মান্তিকভাবে প্রাণ হারান তিনি।

শাহ আলমের মৃত্যু সে সময় হতবিহ্বল করে দিয়েছিল গোটা দেশকে। দুর্ঘটনায় সঙ্গে সঙ্গে শাহ আলম প্রাণ হারিয়েছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অ্যাথলেটের মৃতদেহ শনাক্ত হয়েছিল অনেক পরে।

শাহ আলম নামটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে প্রথম আলোচনায় আসে ১৯৮৪ সালের কাঠমান্ডুতে প্রথম সাফ গেমসে। সেবার সাইদুর রহমান ডন, আফতাব মোল্লা ও মুজিবুর রহমান মল্লিকের সঙ্গে জিতেছিলেন ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলের দলীয় সোনা।

সেবারই ফটোফিনিশে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে বাংলাদেশে আফতাব মোল্লাকে হারিয়ে হারিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন ভারতের আদিল সুমনওয়ালা।
আফতাবের সেই অপূর্ণতা ভুলিয়ে দিতে সময় নেননি শাহ আলম। পরের বছরই ১৯৮৫ ঢাকায় দ্বিতীয় সাফ গেমসে আদিল সুমনওয়ালার গড়া ১০.৯০ সেকেন্ডের রেকর্ডটি ভেঙে (১০.৮০) দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ‘দ্রুততম মানব’ হয়েছিলেন শাহ আলম।

শাহ আলমের (বাঁয়ে) মতো অ্যাথলেট আর আসবেন না বলে মনে করেন অনেকেই।

দেশে তখন সাড়া পড়ে যায়। দুই বছর পর ১৯৮৭ কলকাতা সাফ গেমসে নিজের রেকর্ড ভেঙে ১০.৭৯ সেকেন্ড সময় নিয়ে টানা দ্বিতীয়বার ১০০ মিটার স্প্রিন্টে দক্ষিণ এশিয়ার মুকুট মাথায় তোলেন বাংলাদেশের এই কৃতী অ্যাথলেট। দক্ষিণ এশীয় স্প্রিন্টে বাংলাদেশের তখন জয়জয়কার। শাহ আলম নিজে গর্বিত ছিলেন, তাঁকে পেয়ে গর্বিত হয়েছিল গোটা দেশ।

১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে মুকুট হারিয়ে কোনো মতে ১০০ মিটারে ব্রোঞ্জ জেতেন শাহ আলম। দ্রুততম মানবের খেতাব হারিয়ে বিচলিত শাহ আলম নিজেকে ফিরে পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ১৯৯০ বেইজিং এশিয়ান গেমসকেই নিজের ফেরার মঞ্চ করতে চেয়েছিলেন। তাই সে বছর আজকের দিনে বাড়ি থেকে ঢাকা আসছিলেন এশিয়ান গেমসের প্রস্তুতি শুরু করতে। কিন্তু সেই প্রস্তুতিতে আর নামা হয়নি তাঁর। ৩১ বছর আগে চলে যান না–ফেরার দেশে।

শাহ আলমের পর দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুততম মানব হয়েছিলেন বাংলাদেশের বিমল চন্দ্র তরফদার। ১৯৯৩ ঢাকা সাফে বিমল জিতে নেন ১০০ মিটার স্প্রিন্ট। সেই সফল অ্যাথলেট বিমল আজ প্রবাসজীবনে। দেশের অ্যাথলেটিকসের সঙ্গে তাঁর কোনো যোগাযোগই নেই। এরপর মঞ্চে আগমন আরেক প্রতিভাবান অ্যাথলেট মাহবুব আলমের, যিনি ১৯৯৫ মাদ্রাজ সাফ গেমসে ২০০ মিটার স্প্রিন্টে সোনা জেতেন।

বাঁ দিক থেকে আব্দুল হান্নান, ফরিদ খান চৌধুরী, কাজী শাহ্ আলম ও প্রয়াত শাহ্ আলম। ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলে। ১৯৮৯ জাতীয় ন্যাশনাল।

তখন ভাবা হয়েছিল, শাহ আলমের যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজে পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে ফটোফিনিশে ২০০ মিটারের সোনা হাতছাড়া হয়ে যায় মাহবুবের। সেই মাহবুব ২০১০ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান। কুমিল্লা থেকে মাইক্রোবাসে ঢাকা ফেরার পথে কাঁচপুরের কাছে ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে মাহবুবের মাইক্রোবাস দুমড়েমুচড়ে যায়। শাহ আলমের মতো অকালে চলে যান দেশের আরেক কৃতী অ্যাথলেট।

দেশের অ্যাথলেটিকসে অনেকেই আসা–যাওয়ার মধ্যে ছিলেন। হাল আমলে অ্যাথলেটদের টাইমিং কমেছে। বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা এখন ১০.৬০ বা ১০.৭০ সেকেন্ডের আশপাশে ১০০ মিটারে দৌড়ান। যদিও দক্ষিণ এশিয়ার মানের চেয়েও বেশ কম। এই টাইমিংয়ে আর দক্ষিণ এশিয়ায় সেরা হতে পারেন না কেউ। দক্ষিণ এশিয়ার স্প্রিন্ট থেকে অনেক পেছন পড়ে গেছেন বাংলাদেশের অ্যাথলেটরা। জেতেন না কোনো পদকও।

এর কারণ হয়তো শাহ আলমের মতো অ্যাথলেট আর আসে না। আসবে না বলে রায় দিয়ে দিলেন সত্তর দশকে দেশের দ্রুততম মানব মোশাররফ হোসেন শামীম। তিনি বলছেন, ‘বাংলাদেশে আর অ্যাথলেট আসবে না। কারণ, এ দেশে অ্যাথলেটিকস বলে আর কিছু নেই।’

সড়ক দুর্ঘটনা কেড়ে নিয়েছিল দেশের দুই ইতিহাস-সেরা স্প্রিন্টার শাহ আলম ও মাহবুব আলমকে।

এমন মনে করার ব্যাখ্যাও দেন তিনি, ‘সেই একই দল সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, আনসার খেলছে এখন। কিন্তু ভালো মানের অ্যাথলেট আসতে হলে সিভিল ছাড়া হবে না। শাহ আলমের মতো বাহিনীর দু-একজন বাদে বাংলাদেশের সেরা অ্যাথলেটরা সবাই এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ থেকে। এখন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলা নেই। অ্যাথলেট কোথা থেকে আসবে?’

সাবেক এই দ্রুততম মানবের মনে বিস্তর ক্ষোভ দেশের অ্যাথলেটিকস নিয়ে, ‘এখন জেলায় খেলা হয় না। বিকেএসপিও পিছিয়ে পড়েছে। অন্যান্য খেলায় তবু চেষ্টা আছে ভালো কিছু করার, কিন্তু অ্যাথলেটিকস ফেডারেশনের সেটাও নেই, তারা পরিকল্পনাহীন। কোনোমতে একটা মিট করে দায়িত্ব শেষ।’

অ্যাথলেট উঠে না আসার উদাহরণও দেন তিনি, ‘একজন অ্যাথলেট টানা ১২ বার সোনা পাচ্ছে। তার মানে নতুন অ্যাথলেট আসছে না। এটা চরম হতাশার।’

তবে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন বলছে, নতুন কিছু অ্যাথলেট সম্ভাবনার বার্তা ঘোষণা করেছেন। ‘দেশে অ্যাথলেটিকস বলে কিছুই নেই’—এমন ঢালাও মন্তব্যের সঙ্গে তারা একমত নয়। তবে একটা বড় শূন্যতা যে রয়েছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। এই শূন্যতার মধ্যেই শাহ আলমের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করেন তাঁর সময়ের সাবেক অ্যাথলেটরা।

তাঁরা একবাক্যই বলেন, শাহ আলম একজনই। তাঁর মতো ক্ষণজন্মা অ্যাথলেট পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। সাবেক অ্যাথলেট ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী যেমন প্রয়াত শাহ আলমের স্মৃতির উদ্দেশে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলছেন, ‘শাহ আলমের সঙ্গে খেলেছি। খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখছি। তাঁর স্টাইল, শারীরিক গঠন, অনুশীলন—সবই ছিল দারুণ। এমন অ্যাথলেট কখনো চোখে পড়েনি। এখনকার অ্যাথলেটরা কোচের চেয়ে বেশি বোঝে। কিন্তু শাহ আলম ছিলেন ব্যতিক্রম। কোচের নির্দেশনা ভালোভাবে পালন করতেন। তাঁর আচার–ব্যবহার ছিল তরুণদের কাছে শিক্ষণীয়। সবাইকে ভালো পরামর্শ দিতেন। এমন অ্যাথলেট আর আসবে কি না, জানি না।’

নোয়াখালীর অ্যাথলেটিকস কোচ রফিক উল্লাহ আক্তার মিলনও শাহ আলমে মুগ্ধ, ‘একজন জাত অ্যাথলেট ছিলেন তিনি। অসাধারণ বললেও কম বলা হবে। আজ কষ্ট হয় শাহ আলমের মতো অ্যাথলেট না দেখে।’

এমন হতাশার মধ্যেই উঠে আসে প্রয়াত শাহ আলমের পরিবারের অসহায়ত্বের গল্প। তাঁর বড় মেয়ে শাহনাজের বিয়ে হয়েছে। মেজ মেয়ে শাহিনাজ এসএসসি পাস করে পড়া আর চালিয়ে যেতে পারেননি অর্থাভাবে। ছোট মেয়ে মানসিক প্রতিবন্ধী।

সন্তানদের নিয়ে স্ত্রী আফরোজা বেগমের জীবন কাটে অনেক লড়াই-সংগ্রামে; উত্তর প্রজন্মের কাছে যা খারাপ এক উদাহরণই। শাহ আলমের পরিবারেরই যদি এই অসহায় অবস্থা হয়, তাহলে নতুন প্রজন্ম কেন অ্যাথলেটিকসে ঝুঁকবে? অথচ বাংলাদেশের ক্রীড়া ইতিহাসে সফল ক্রীড়াবিদদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় থাকবে শাহ আলমের নাম। কিন্তু তাঁর স্ত্রী-সন্তানেরা আজ কষ্টে দিন কাটান। কেউ আর খোঁজ রাখেনি।

সেনাবাহিনীর সদস্য হিসেবে শাহ আলমের মৃত্যুর অনেক বছর পরও আফরোজা বেগম ছেলেমেয়েদের নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ছিলেন। কিন্তু একসময় ছাড়তে হয় বাসা। তিন সন্তানকে নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন ভাবতে থাকেন। সরকার একটা বাড়ি দেবে বললেও দেয়নি। ঢাকায় হকি স্টেডিয়াম মার্কেটে একটা দোকান বরাদ্দ পেয়েছে শাহ আলমের পরিবার। সেই দোকানের মাসিক ভাড়া ১২ হাজার টাকা। কিন্তু করোনাকালে দোকানের ভাড়াও পায় না এখন।

শাহ আলমের এই মলিন ছবিটির মতো তাঁর স্মৃতিও যেন ম্লান হয়ে যাচ্ছে অ্যাথলেটিক ফেডারেশন থেকে।

করোনায় বাংলাদেশ অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন কয়েক লাখ টাকা আর্থিক অনুদান তুলেছে বিভিন্নজনের কাছ থেকে। উদ্দেশ্য দুস্থ অ্যাথলেটদের সহায়তা করা। কিন্তু শাহ আলমের পরিবার তার কোনো অংশ পায় না।

অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রকিব গত বছর শাহ আলমের মৃত্যুদিবসে বলেছিলেন, ‘শাহ আলমের পরিবারের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন না সহায়তার জন্য!’ শুনে শাহ আলমের ছেলে মামুন বলছিলেন, ‘বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে আগে নিয়ম করেই ফেডারেশনে যাওয়া হতো। কিন্তু ওখানে উনাদের আচরণ দেখে নিজেদের খুব ছোট মনে হতো। আমার বাবা নিশ্চয় সেই পর্যায়ের কেউ ছিলেন না।’

শাহ আলমের গুরুত্ব বোঝেনি অ্যাথলেটিক ফেডারেশন। তাঁকে ভুলে গেছে। কিন্তু শাহ আলমকে ভোলেনি এ দেশের খেলাপ্রিয় জনতা। প্রেরণার উৎস হয়ে তিনি আছেন, থাকবেন।