Thank you for trying Sticky AMP!!

‘বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা বাড়বে ভবিষ্যতে’

এশিয়ার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ইন্দোনেশিয়ার ফুটবল লিগে কোচ হিসেবে কাজ করেছেন ১৪ বছর। বর্তমানে কাজ করছেন বাংলাদেশের ফুটবল লিগে। দুটো লিগকে কীভাবে দেখছেন মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের বর্তমান কোচ রাজা ইসা বিন রাজা আকরাম শাহ? ইন্দোনেশিয়ার লিগে কাজ করার অভিজ্ঞতাই-বা কেমন? প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেসব কথাই বলছেন এই মালয়েশিয়ান কোচ—
প্রশ্ন

ইন্দোনেশিয়ার লিগ সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা আছে। ইউটিউবে ওই লিগের উন্মাদনা সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে কোচ হিসেবে কাজ করেছেন আপনি। অভিজ্ঞতা কেমন সে লিগে কাজ করার?

রাজা ইসা: আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অভিজ্ঞতা হয়েছে সেখানে। ইন্দোনেশিয়ার লিগকে আপনি নানাভাবে দেখতে পারেন। তবে দিন শেষে এটিকে আমি পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর লিগ বলব।

প্রশ্ন

নিষ্ঠুর কেন বলছেন? সেটা কি মারামারি বা হিংস্রতার জন্য?

রাজা ইসা: মারামারি বা হিংস্রতার কথা ভেবে কথাটা বলছি না। ইন্দোনেশিয়ান লিগে পান থেকে চুন খসলেই বিপদ। কোচ সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সঁপে দেন দলের জন্য, না হয় চলে না। জয় ছাড়া ওই লিগে কোচের টিকে থাকা কঠিন।

অন্য দেশের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পার্থক্যটা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ায় ক্লাবগুলো হার মানতে একেবারেই নারাজ। একটা উদাহরণ দিই। ২০১২ সালের লিগে ৭ ম্যাচ অপরাজিত ছিলাম আমি। অষ্টম ম্যাচটা নিজেদের ঘরের মাঠে হেরে যাই। এই এক হারের জন্য আমার চাকরি চলে যায়। সে সময় আমার দল পিএসএমএস মাদান জয় ছাড়া আর কিছু বুঝত না।
রাজা ইসা, মুক্তিযোদ্ধার ইন্দোনেশিয়ান কোচ
প্রশ্ন

ফল খারাপ হলে কোচদের চাকরি যায় সব দেশেই। ইন্দোনেশিয়ায় ব্যতিক্রম কী? আপনার কবার বরখাস্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে?

রাজা ইসা: অন্য দেশের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়ার পার্থক্যটা হচ্ছে, ইন্দোনেশিয়ায় ক্লাবগুলো হার মানতে একেবারেই নারাজ। একটা উদাহরণ দিই। ২০১২ সালের লিগে ৭ ম্যাচ অপরাজিত ছিলাম আমি। অষ্টম ম্যাচটা নিজেদের ঘরের মাঠে হেরে যাই। এই এক হারের জন্য আমার চাকরি চলে যায়। সে সময় আমার দল পিএসএমএস মাদান জয় ছাড়া আর কিছু বুঝত না। তাই এক হারেই আমাকে বিদায় দেয় তারা। এভাবে বিদায়ের অভিজ্ঞতা আমার এই একবারই। ইন্দোনেশিয়ায় সাধারণ প্রবণতা হলো, নিজের মাঠে আপনি হারতে পারবেন না। কোচকে সেরাটা দিতে তৈরি থাকতে হয় সব সময়।

প্রশ্ন

কোচদের সেরাটা দিতে হয় যেকোনো লিগেই। ইন্দোনেশিয়ার লিগটা কোচদের কাছে আলাদা কোন জায়গায়?

রাজা ইসা: ইন্দোনেশিয়ার লিগে প্রতিদিন, প্রতি ম্যাচে কোচদের ভালো করা চাই। আরও বেশি সৃজনশীল হওয়া চাই। এর কোনো বিকল্প নেই। কোচদের জন্য এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এবং আমি মনে করি কোচ হিসেবে নিজেকে তৈরি করার জন্য ইন্দোনেশিয়ার লিগ সেরা এক জায়গা।

দাঙ্গা ইন্দোনেশিয়ান লিগের নিত্য ঘটনা।
প্রশ্ন

এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার লিগে ৭৪ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। সেখানকার লিগ ম্যাচ নিয়ে এত উন্মাদনার কারণ কী?

রাজা ইসা: অনেক কারণ। ফুটবল সেখানে ধর্মের মতো। প্রতিটি ম্যাচে গ্যালারি উপচে পড়ে। একটা সাধারণ ম্যাচেও ৩০-৪০ হাজার দর্শক হয়। এমনকি ছোট দলের অনুশীলনেও ৩-৪ হাজার লোক চলে আসে। মাইকেল এসিয়েন যখন এল, ১০-১২ হাজার সমর্থক শুধু অনুশীলন দেখতে চলে আসত। বুঝুন অবস্থা (এসি মিলান, রিয়াল মাদ্রিদ ও চেলসির সাবেক ঘানাইয়ান মিডফিল্ডার মাইকেল এসিয়েন ২০১৭ সালে যোগ দেন ইন্দোনেশিয়ার ক্লাব পার্সিব ব্যানডুংয়ে)।

প্রশ্ন

ইন্দোনেশিয়ায় ফুটবল তার ঐতিহ্য এবং আকর্ষণ ধরে রাখতে পেরেছে। এর কারণ কী মনে হয়?

রাজা ইসা: ইন্দোনেশিয়া বিশাল একটি দেশ (আয়তন প্রায় ১১ লাখ বর্গকিলোমিটার। বাংলাদেশের চেয়ে ৭ গুণের বেশি বড়। লোকসংখ্যা ২৭ কোটির ওপর)। ফুটবল নিয়ে দেশটিতে মানুষের আবেগ আর আঞ্চলিকতার টান তীব্র। বিভিন্ন আঞ্চলিক ক্লাব রয়েছে সেখানে, যেটা বাংলাদেশে নেই। ইন্দোনেশিয়ায় আমি যা দেখেছি, এটাই সত্যিকার ফুটবল জীবন। ফুটবলে ওরা খায়, ঘুমায়।

প্রশ্ন

একসময় বাংলাদেশেও এমন অবস্থা ছিল। আজ হয়তো আপনি গ্যালারির অনেকটা অংশ ফাঁকা দেখছেন, কিন্তু নব্বই দশক পর্যন্ত এখানেও উন্মাদনার কমতি ছিল না ফুটবল ঘিরে। ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে কী ধরনের পার্থক্য দেখছেন বাংলাদেশে?

রাজা ইসা: পার্থক্য অনেক। এখানে দর্শক তেমন নেই। খেলা নিয়ে উন্মাদনার অভাব, যা পুরো ইন্দোনেশিয়ার লিগের বিপরীত। কাজেই আমার কাছে দুরকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে। আমি বলব ইন্দোনেশিয়ার লিগ এশিয়ার সেরা লিগ।

ইন্দোনেশিয়ায় প্রচুর আঞ্চলিক ক্লাব রয়েছে সেখানে, যেটা বাংলাদেশে নেই। ইন্দোনেশিয়ায় আমি যা দেখেছি, এটাই সত্যিকার ফুটবল জীবন। ফুটবলে ওরা খায়, ঘুমায়।
রাজা ইসা, মুক্তিযোদ্ধা কোচ
প্রশ্ন

সেটা কিসের ভিত্তিতে বলছেন?

রাজা ইসা: সবকিছু মিলিয়েই। সম্ভবত ২০০৮ সালে এক সমীক্ষায় দেখেছি, ইন্দোনেশিয়ার লিগ এশিয়ার ষষ্ঠ সেরা লিগ। করোনার কারণে এখন লিগ বন্ধ আছে, দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, একটু ভাটার টান আছে। তবু আমি আশাবাদী করোনা সমস্যা মিটে গেলে আবার আগের উন্মাদনা দেখা যাবে। ইন্দোনেশিয়ায় ২০২৩ সালে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ হচ্ছে। বুঝতেই পারছেন, সেখানে ফুটবলীয় অবকাঠামো কতটা ভালো।

ইন্দোরেশিয়া লিগের একটি ম্যাচে মাঠে পুলিশের সাঁজোয়া গাড়ি।
প্রশ্ন

আপনি যে ২০০৭ সাল থেকে সেখানে কোচ হিসেবে কাজ করেছেন, সমস্যায় পড়েছেন কখনো?

রাজা ইসা: অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। তবে সেটাকে আমি মধু বলব, বিষ বলব না। দুটি ঘটনার কথা বলতে পারি। এফএ কাপে অ্যাওয়ে ম্যাচ খেলতে পূর্ব জাভায় যাই। ২-১ গোলে জয়লাভ করি আমরা। আর যায় কোথায়! আমাদের বাসে ঢিল ছোড়া হলো। আমরা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়ে যাই। একবার মালাং সফরে যাই। ৬০ হাজার দর্শকের সামনে আমরা জয়লাভ করি। তখনো প্রতিপক্ষের সমর্থকেরা আমাদের দিকে ঢিল ছুড়ে মারে। অ্যাওয়ে ম্যাচ জিতে আপনি ভালোভাবে ফিরবেন, সেটা আশা করা বাড়াবাড়ি। স্বাগতিক দল হার মানতে পারে না। এই দুটি ঘটনাই আপাতত আমার মনে পড়ল।

বাংলাদেশ ফুটবল উন্নয়নের পথে রয়েছে। প্রিমিয়ার লিগটা ভালোই চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক। যদিও ক্রিকেট এ দেশে ১ নম্বর খেলা। তারপরও আমার মনে হয় যে ভবিষ্যতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পাবে। দরকার কোচদের প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো, লম্বা সময়ের জন্য পরিকল্পনা, ভালো
রাজা ইসা, মুক্তিযোদ্ধা কোচ
প্রশ্ন

এমনিতে ইন্দোনেশিয়ার লিগে কোচদের কাজের স্বাধীনতা কেমন?

রাজা ইসা: কদিন আগে আমি ৫৫ বছরে পা দিয়েছি। ইন্দোনেশিয়ান লিগ আমাকে পরিণত করেছে। আমি জানি কীভাবে চাপ সামলাতে হয়। ইন্দোনেশিয়ার লিগে কাজ করে আমি নিজেকে খুব গর্বিত মনে করি। ব্যক্তিগতভাবে এই লিগ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। আমাকে অনেক উন্নত করেছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের কোচরাও সেখানে কাজ করলে অনেক কিছুর সঙ্গে পরিচিত হবেন। ইন্দোনেশিয়ার লিগটা কোচদের জন্য শেখার সর্বোত্তম এক জায়গা।

প্রশ্ন

কোন দৃষ্টিকোণ থেকে বলছেন ইন্দোনেশিয়ার লিগ কোচদের জন্য শেখার সর্বোত্তম জায়গা?

রাজা ইসা: হাজার হাজার সমর্থকের সামনে কীভাবে চাপ সামলাবেন, সেটা শেখা যায়। এটা একটা বড় ব্যাপার। একজন কোচকে চাপ সামলে ফল বের করে আনার কৌশলটা জানতে হয়।

প্রশ্ন

ইন্দোনেশিয়ার লিগের কাঠামোটা কেন?

রাজা ইসা: লিগ ওয়ানে (শীর্ষ বিভাগ) ১৮টি দল। টু-তে (দ্বিতীয় বিভাগ) ২৪টি। ইন্দোনেশিয়া অনেক বড় দেশ, তাই দলও বেশি। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে খেলা হয়। আর সেখানে খেলা মানে একরকম উৎসবও।

প্রশ্ন

শুনেছি আপনি ব্যাংকার ছিলেন?

রাজা ইসা: আমার জন্ম মালয়েশিয়ায়। ছোট থেকে ফুটবল খেলেছি। ফুটবলার হয়েছি। পাশাপাশি ব্যাংকেও চাকরি করতাম। অল্প সময়ে কোচিংয়ে আসি। ২০০৭ থেকে ইন্দোনেশিয়ান লিগে কোচ হিসেবে কাজ করেছি। ৯টি ক্লাব সামলেছি। লিগ ওয়ানের ৭টি এবং লিগ টুয়ে ২টি। লিগ টুর দলকে লিগ ওয়ানে তুলেছি। আসলে বড়, ছোট, মাঝারি—সব দলই পরিচালনার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। ২০১৪ সাল পর্যন্ত টানা লিগ ওয়ানে কাজ করি। ওই বছর ফিফা ইন্দোনেশিয়াকে নিষিদ্ধ করেছিল সরকারি হস্তক্ষেপের কারণে। ওই সময় আমি প্রো লাইসেন্সের কাজ করি। লাইসেন্সের কাজে সময় দিতে হয়েছে অনেক। তাই তুলনামূলক কম চাপের লিগ-২-এ কাজ করি ২০১৬ থেকে।

প্রশ্ন

লিগ টুয়ের অভিজ্ঞতা কেমন?

রাজা ইসা: ভালোই। ইন্দোনেশিয়ায় লিগ ওয়ানে প্রতি দলের ৩৪টি ম্যাচ। এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপ খেলা। ৬-৭ ঘণ্টাও লেগে যায় বিমানে যেতে। ভ্রমণ করতে অনেক ঝক্কি। এত দূরের পথ সড়কে যাওয়া সম্ভব না। ২০০৭ থেকে টানা ২০১৪ পর্যন্ত লিগ ওয়ানে কাজ করি। লিগ টুয়ে ২০১৯ সালে একটি দলকে অবনমনমুক্ত করি। ২০২০ সালেও ওই দলেই ছিলাম। তবে কোভিডের কারণে মাত্র ১ ম্যাচ পরই লিগ বন্ধ হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশ এসেছি।

প্রশ্ন

লিগ ওয়ানে ইউরোপের কোচরা আসেন? লিগের আর্থিক অবস্থাই-বা কেমন?

রাজা ইসা: হ্যাঁ, স্প্যানিশ, ডাচসহ ইউরোপের অনেক কোচ আসেন। ব্রাজিলিয়ান কোচও আসেন। লিগের আর্থিক অবস্থা ২০০৬ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত খুবই ভালো ছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তখন। পরে আস্তে আস্তে সেটা কমে গেল।

প্রশ্ন

বাংলাদেশের ফুটবল কেমন দেখছেন?

রাজা ইসা: বাংলাদেশ ফুটবল উন্নয়নের পথে রয়েছে। প্রিমিয়ার লিগটা ভালোই চলছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা অনেক। যদিও ক্রিকেট এ দেশে ১ নম্বর খেলা। তারপরও আমার মনে হয় যে ভবিষ্যতে ফুটবলের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পাবে। দরকার কোচদের প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো, লম্বা সময়ের জন্য পরিকল্পনা, ভালো খেলোয়াড় তৈরি করা প্রভৃতি।

প্রশ্ন

বাংলাদেশে রেফারিং নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। এটাকে কীভাবে দেখছেন?

রাজা ইসা: সব দেশেই এটা কমবেশি আছে এবং থাকবে।

প্রশ্ন

মুক্তিযোদ্ধা চলতি প্রিমিয়ার লিগে ১১ ম্যাচে ২ জয় ৩ ড্রয়ে ৯ পয়েন্ট নিয়ে ১১তম স্থানে আছে। অবনমনের ভয় করছেন?

রাজা ইসা: না না, অবনমন হবে না। ১৩ দলে আমরা এখন ১১তম। আমরা ভালো খেলছি কিন্তু সমস্যা হয়েছে ফিনিশিংয়ে। ফিনিশিংটা ভালো হলে আরেকটু ওপরে থাকতে পারতাম। তারপরও দেখা যাক সামনে কতটা এগোতে পারি।

প্রশ্ন

কোচ হিসেবে আপনার দর্শন কী?

জা ইসা: স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন, গাস হিডিংককে আমার ভালো লাগত। ভিয়েতনামের এক কোচকেও পছন্দ করতাম। আক্রমণই দর্শন আমার। একই সঙ্গে ভালো রক্ষণও করা চাই।