Thank you for trying Sticky AMP!!

আজব ভাইরাসের বিচিত্র লক্ষণ

>

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com

করোনা শব্দটা শুনেছি গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে। ১৫ বছর ধরে বিলেতে ডাক্তার হিসেবে কাজ করার সুবাদে ‘এপিডেমিক’ শব্দটার সঙ্গেও সুপরিচিত। সিজনাল ফ্লু, সার্স, জিকা ভাইরাস, ইবোলা—এসব আসে, কিছুটা ভোগায়, তারপর আবার সব স্বাভাবিক। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতেও যখন সপরিবার মরক্কো বেড়াতে গেলাম, তখনো এয়ারপোর্টে অতিরিক্ত কোনো স্ক্রিনিং হয়নি। এর ভয়াবহতা বুঝতে পারলাম মার্চ মাসে এসে।

স্পেশিয়াল্টি ডাক্তার হিসেবে বেলফাস্টের একটি ইউনিভার্সিটি টিচিং হসপিটালে আমি কাজ করছি। আমার কাজের এলাকা মূলত স্ট্রোক আর মেডিসিন। আমার স্বামী নাশিদ আলমও ডাক্তার। সে কনসালট্যান্ট ফিজিশিয়ান আর স্ট্রোক স্পেশালিস্ট। করোনায় জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর আমাদের কাজের ধরন অনেকটাই পাল্টে গেছে। বহির্বিভাগের রুটিন সব কাজ বন্ধ।

আমার দায়িত্ব স্ট্রোক ওয়ার্ডে। ওয়ার্ডের অর্ধেক এখন করোনা রোগীদের জন্য বরাদ্দ। প্রত্যেক স্বাস্থ্যকর্মীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়েছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী বা পিপিই তো পরতেই পারে। প্রতিটি রোগী দেখার পরে পিপিই বদলাতে হয়। করোনা রোগী দেখার জন্য এক সময়ে একজন ডাক্তার বা সেবিকা ঢোকার নিয়ম। বিশেষ করে যেটা বলার, প্রত্যেক করোনা রোগীকে এখানে আলাদা কক্ষে রাখা হয়। এসব কক্ষের নিরাপত্তার জন্য বাতাসের নিরন্তর পরিশোধন অসম্ভব জরুরি। সে জন্য কক্ষগুলোতে নেগেটিভ প্রেশার ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা আছে।

আমার স্বামী আপাতত করোনা রোগীদের মুখ্য চিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে হচ্ছে। বলা বাহুল্য, নিজের আর পরিবারের সবার স্বাস্থ্য আর নিরাপত্তা নিয়েই বেশি চিন্তায় আছি। বাসায় আসার আগে হাসপাতালেই গোসল করে কাপড় বদলে আসি। হাসপাতালের লন্ড্রিতে কাপড় ধুতে দিয়ে আসি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মানবজাতির ওপর এত বড় বালাই আর আসেনি। এ যেন জৈব অস্ত্রে ছারখার একটি পৃথিবী। এই ভাইরাস চীন, ইতালি, স্পেন আর যুক্তরাষ্ট্রে মরণতাণ্ডব চালানোর সময় বিলেতেও মৃত্যুহার বাড়তে থাকে। মার্চের শুরুতে সরকারি ঘোষণা আসে, এ মুহূর্তে লকডাউন না করলে বিলেতে মৃতের সংখ্যা ৫ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তারপর খালি বাজার–সদাই করার জন্য সুপারমার্কেট ছাড়া আর সব বন্ধ।

আমি আর আমার স্বামী দুজনই ডাক্তার। ফ্রন্ট লাইনে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে কাজ করি। সব সাধারণ ডাক্তারদের টেলিফোনে সেবা দেওয়ার নির্দেশ এল। খুব অসুস্থ না হলে কারও হাসপাতালে আসা মানা। সব রুটিন সার্জারি আর বর্হিবিভাগের কাজ বন্ধ।

আমার প্রথম দেখা করোনা রোগীর কথা কখনোই ভুলব না। ৩৮ বছরের সুস্থ এক ভদ্রলোক হাসপাতালে এলেন জ্বর আর খিঁচুনি নিয়ে। শ্বাসের কোনো সমস্যা নেই। কোভিড টেস্ট পজিটিভ এল। তাঁর কোভিড এনকেফালাইটিস, মস্তিষ্কের প্রদাহ।

কোভিডের কত বিচিত্র রূপই যে দেখলাম। অনেকেরই ধারণা, কোভিড মানেই জ্বর আর শ্বাসকষ্ট। একদমই ঠিক নয়। যাঁরা একটু বয়োজ্যেষ্ঠ, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের বিচিত্র লক্ষণ দেখছি—ক্ষুধামান্দ্য, অত্যধিক কফ, ডায়রিয়া, বমি বমি ভাব, গন্ধহীনতা, নাক দিয়ে পানি ঝরা, ভুলভাল বকা, কম রক্তচাপ এবং মাথা, পেট বা বুক ব্যথা ইত্যাদি। এসবের সঙ্গে জ্বর থাকতে পারে, না–ও পারে। তাই এসব সমস্যা থাকলেও কোভিড টেস্ট প্রয়োজন হতে পারে।

কোভিডের কোনো টিকা বেরোয়নি, সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসার উপায়ও নেই। সব চিকিৎসাই উপসর্গ উপশমের চেষ্টা। অবস্থার অবনতি হলে আইসিইউতে যাওয়াও আশাব্যঞ্জক নয়। যুক্তরাষ্ট্রে আইসিইউতে কোভিডে মৃত্যুহার ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ, বিলেতে ৫০।

তাই টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধই এর একমাত্র প্রতিকার। তাই পুরো নিয়ম মেনে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করাই একমাত্র পথ। করোনা নিজে করুণা না করলে বাঁচা মুশকিল। তাহলে শুধু শুধু ঘুরেফিরে এই আজব গজবের খপ্পরে পড়ার কী দরকার? বাড়িতে থাকুন, সুস্থ থাকুন।