Thank you for trying Sticky AMP!!

প্রবাসের বিজয়ায় হৃদয়ে নামে স্তব্ধতা

টরন্টো দুর্গাবাড়িতে সাংস্কৃতিক পরিবেশনা

শুক্লপক্ষের দশম দিন অর্থাৎ দশমী। অশুভ শক্তির বিপক্ষে শুভ শক্তির জয়, তাই বিজয়া দশমী। এই দিনটিতে দেবী দুর্গা মর্ত্যবাসীকে ছেড়ে কৈলাসের পথে যাত্রা করেন। তবে এই যাত্রা বিচ্ছেদের নয়, পরের বছরের জন্য আরেকটি মিলনের অপেক্ষা। আবেগী মন অনেক সময় তা মানতে চায় না। এ প্রসঙ্গে কথামৃতে গল্প পাওয়া যায়, রানি রাসমণির জামাতা মথুরবাবু একবার দশমীতে বেঁকে বসলেন, কোনো অবস্থাতেই মাকে বিসর্জন দেওয়া যাবে না। এই অবস্থায় ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণ, মথুরবাবুকে শান্ত করলেন এই বলে; এই পাঁচ দিন মা দুর্গা বাহির বাড়িতে পূজা নিয়েছেন, এবার তিনি অন্তর বাড়িতে পূজা নেবেন। যার মানে, মনকে মন্দির করে পূজা করা। ‘মিথ্যা শুনিনি ভাই, এই হৃদয়ের চেয়ে বড় মন্দির-কাবা নাই’ ঠাকুরে-কাজীতে খই আর দইয়ের মাখামাখি। সমাজ-সংসারে এই মাখামাখি খুব একটা দেখা মেলে না।
এবার শারদীয় উৎসবের বিজয়া দশমীর দিনে উপস্থিত ছিলাম টরন্টো হিন্দু-কালচারাল মন্দিরের সিঁদুর খেলায়। যদিও আমার স্মৃতির পূজাগুলোতে সিঁদুর খেলারা খুব একটা উঁকিঝুঁকি মারে না। এটা কলকাতা কালচার আর বাংলাদেশি কালচারের ফিউশন। বিদায়কে সেলিব্রেট করা। পুরো মন্দিরজুড়ে শত-শত সিঁদুর লেপা ফরসা মুখের কলতান, ঢাকের বোল। অনুপদা-অপর্ণা বৌদি সিঁদুর রাঙিয়ে আশীর্বাদ করে গেলেন। ছোট ভাই লিটনের ঢাকের বোল, আর বন্ধুবর বড়ভাই সুকোমল রায়ের কাঁসরের তালে, কোমর দুলেছে আমারও। মুহুর্মুহু জয়ধ্বনি আর কোনো-কোনো দিদি-বৌদিদের ঊর্ধ্ব গগনে হাত উঁচিয়ে সেলফিতে বন্দী হওয়ার উচ্ছ্বাস, ধীরে-ধীরে মিলিয়ে গেল এক সময়। সবাই দাঁড়িয়ে গেল প্রসাদের লাইনে।
মেঝেতে আলপনার ওপর পড়ে থাকা সিঁদুরের কৌটো, যা একটু আগেও হাত ঘুরে-ঘুরে সেলফির উপজীব্য হয়ে উঠেছিল, পায়ের নিচে পিষ্ট হওয়া দেবতার ফুল, বেদির কাছে অগোছালো ভোগের থালি, কোনায় জ্বলা ঠাকুরের প্রদীপখানি, একটু সময়ের ব্যবধানে বড় একা হয়ে গেল। প্রজন্ম জানে না সেই বিষাদের গল্প; শুধু নতুন জামা, সেলফি, আর অতিথি শিল্পীদের গানেই মত্ত হয়ে রইল। আমরা তাদের জানাইনি, এমনকি জানানোর প্রয়োজনও মনে করিনি, নবমীর সেই লম্বা রাত আর বিষাদের কাহিনি।
স্মৃতির ফ্ল্যাশব্যাকে, ছোট্টবেলার শিশিরবিন্দু ভেজা নবমীর সকাল, মনের কোলে আনন্দের মাঝেও বিষাদে স্যাঁতসেঁতে সারা বেলা। পরের দিন ভোর হলেই সাঙ্গ হবে মেলা।
নবমীর সমবেত অঞ্জলি শেষে, বারোয়ারি পূজার ভোগ খুঁজে দেওয়া, আকাশে সাদা মেঘের ছোটাছুটি, আর মণ্ডপে সাদা আর লালপেড়ে শাড়ির নিচে নূপুর পরা পায়ের হাঁটাহাঁটি, ভেজা চুলের পবিত্র গন্ধ আবেশ ছড়াত। অলস দুপুরে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা, মাইকে বাজানো পূজার গান ‘আমার পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে তুমি যেন ভুল বুঝো না।’
সন্ধ্যার শাখ-কাঁসর-উলু আর মাগরিবের আজানের ধ্বনি আকাশজুড়ে সর্বজনীনতা পেত। এই হলো আবহমান কালের বাংলার উৎসব।
পূজার একমাত্র ও শুধুই একমাত্র প্রধান আকর্ষণ ছিল সন্ধ্যা আরতি। হ্যাজাকের আবছা আলোয়, ক্রাশ খেয়েছি কাজল চোখে সেই আরতি প্রতিযোগিতার ভিড়ে। এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ভক্তিরসে ভরপুর; বয়োজ্যেষ্ঠদের চোখে দেখতাম বিষাদের সুর ‘ওরে নবমী নিশি! না হৈওরে অবসান, শুনেছি দারুণ তুমি না রাখো শতের মান।’
দশমীর ভোরে স্নান শেষে, শুরু হতো গুরুজনদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেওয়ার পালা। বেজে উঠত বিদায়ের ঘণ্টা, একে একে মায়ের মূর্তি জমায়েত হতো নদীর ঘাটে অপরাহ্ণবেলা। ভাসান শেষে শরতের সন্ধ্যার কুয়াশায়, সঙ্গে নিয়ে বিদায়ের শোক-অশ্রুজল, বন্ধু সকল কোলাকুলির মাধ্যমে শুভেচ্ছা বিনিময়।
প্রতিবেশীদের ঘরে-ঘরে নারিকেলের নাড়ু আর দুধের সন্দেশ খেয়ে জমিয়ে আড্ডা মেরে ঘরে ফেরার পথে, কাশের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়ে কথা হতো; আবার হবে আগামী বছর।
ফ্ল্যাশব্যাকের তাল কাটতেই, ততক্ষণে এসে পৌঁছালাম বার্চমাউন্টের ওপর টরন্টো দুর্গাবাড়িতে। ওখানে মেলা ভঙ্গের মাঝে দুর্গা প্রণাম করতে গিয়ে বলতে হলো একই কথা—আবার হবে আগামী বছর।
ফেসবুকের নোটিফিকেশন খুলতেই একের পর এক দেখাতে লাগল বিজয়ার শুভেচ্ছা। আমরা প্রজন্মকে বিজয়া চেনাচ্ছি হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকে। ওরা হয়তো কখনই দেখবে না, নদীর ঘাটে অশ্রুসজল ত্রিনয়নী মাকে।
এবার বিজয়ার বার্তা, মা দুর্গার কৈলাস গমনের বিষাদের সঙ্গে, প্রিয় কিছু মানুষের না ফেরার দেশে চলে যাওয়ায়; হৃদয় জুড়ে নেমে আসে স্তব্ধতা। অভিমানে আকাশে উড়াল দিলেন আইয়ুব বাচ্চু। টরন্টোতে অবস্থানরত স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের কণ্ঠ সৈনিক রঙ্গলাল দেব চৌধুরী ও টরন্টো ফিল্ম ফোরামের সুহৃদ, চিত্রশিল্পী, ছবির হাটের অন্যতম রূপকার রবি খানের মৃত্যুর সংবাদে, টরন্টোতে বাঙালি কমিউনিটির বিজয়ার সুরে বেজে চলেছে শুধুই বিসর্জনের বাজনা।
‘ভালোবাসার এই কিরে খাজনা, ফাঁকি দিয়ে ওরে পাখি উড়ে গেলে আর আসে না’।
উৎসবের সর্বজনীনতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপের দেহ ছেড়ে, আমাদের প্রতিদিনকার যাপিত জীবনে প্রতিস্থাপিত হোক।

লেখক: টরন্টো, কানাডা।