Thank you for trying Sticky AMP!!

মহামারিতে ওগরানো রসের হাঁড়ি

১৬৩০ সালে নিকোলাস পৌসিনের আঁকা `দ্য প্লেগ অব অ্যাশডডে` ইওরোপিয় প্লেগের ভয়াবহতা।

‘মরিতে চাহি না আমি এ সুন্দর ভুবনে।’ তা ‘মরিতে চাহিবার’ কী কারণ আছে? অবশ্য, শেক্‌সপিয়ারকৃত রোমিও–জুলিয়েট কিংবা মনসুর বয়াতিকৃত দেওয়ানা–মদিনা পালা বা অনুরূপ কেচ্ছার নায়ক–নায়িকাদের কথা আলাদা। কথায় কথায় তারা প্রাণ দিয়ে দিত, তা–ও কিনা প্রেমের জন্য। প্রাণময় রূপকথার যুগ পেরিয়ে এই সব তথাকথিত বড়দের সাহিত্যের জগতে ঢুকে তাই রীতিমতো ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতে হয়। মনে হয়, এত দিন তবে ভুল ছিল জানাশোনা! প্রেম তবে প্রাণবিসর্জনময়! কিন্তু পরক্ষণেই যখন বিশ্বের জনসংখ্যাটি চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে দুলতে থাকে, তখন কোনটি রূপকথা, আর কোনটি অরূপকথা—তা নিয়ে গোল বেধে যায়।

এই সব কুটকচালির কারণে শেষ পর্যন্ত এই বুঝতে হয় যে মানুষ মূলত অন্য প্রাণের মতো করে এই মরতে না চাওয়ার বিষয়টিতেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী ছিল। বলতে হয়, একেবারে মাটি কামড়ে বাঁচতে চায় সে। কিন্তু যখন মৃত্যু অনিবার্য হয়ে যায়, যখন আর উপায় থাকে না, তখন একটা পর্যায়ে গিয়ে এই মৃত্যুই হয়ে ওঠে তামাশার বিষয়। যুদ্ধ ও মড়কের সময় মানুষের মধ্যে এই তামাশা করার প্রবণতা অনেক বেড়ে যায়। যেমন এই সময়েও হচ্ছে। এর কোনোটি হয়তো মহামারি, কোনোটি এই সময়ের নেতাদের কার্যকলাপ, কোনোটি সাধারণ মানুষের আচরণকে লক্ষ্য করে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এ ক্ষেত্রে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই একটি প্রপঞ্চ। তিনি নিজে যেমন অনেক তামাশার জন্ম দিচ্ছেন, তেমনি তাঁকে নিয়েও তৈরি হচ্ছে বিস্তর কৌতুক।

ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে তৈরি কৌতুকগুলোর মধ্যে একটিতে তো আবার হাজির হয়েছেন কিউবা বিপ্লবের নেতা ফিদেল কাস্ত্রোও। বৈশ্বিক রাজনীতির খোঁজখবর রাখা লোকেরা নিশ্চয় বুঝতে পারছেন। অনেক হত্যা ও অভ্যুত্থানচেষ্টা এবং প্লেগ ও ফ্লুয়ের বারবার আঘাতের পরও টিকে থাকা ফিদেল মারা যান ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বর। কারণ কী? ফিদেল বলছেন—‘ওহ ট্রাম্পের দুনিয়ায় ভাই থাকতে পারব না।’ এমন হাজারো কৌতুক খুঁজে পাওয়া যাবে এখনকার নেট দুনিয়ায়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিমুহূর্তে কেউ না কেউ করোনার দিকে তির্যক হাসি ছুড়ে দিয়ে তামাশা করে যাচ্ছে।

আবার বাস্তবিকই এমন অনেক ঘটনা ঘটছে, যা কৌতুকের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। এই যেমন থানকুনি কেস। এ তো এই বঙ্গেই ঘটে গেছে। তা–ও আবার তপন রায় চৌধুরী কথিত ‘বীরভূমি’ বরিশালে। এক রাতের মধ্যে থানকুনির বংশ উদ্ধার করা হয়েছে। কিংবা তাকানো যাক ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে, যেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে মাস্ক, গ্লাভস পরে দুই দল মারামারি করেছে। কারণ, লুডু খেলায় চুরি! কিংবা তাকানো যাক কোয়ারেন্টিন বস্তুটা কী, তা বুঝতে শত মানুষের ভিড় করার ঘটনাপঞ্জির দিকে। এই সবই ঘটেছে এই সময়ে। এমন ঘটনা কিন্তু এমন সময়েই ঘটছে না শুধু। রোগ নিয়ে জানাবোঝায় গলদ, বা আবেগের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মানুষ বরাবরই এমন নানা অদ্ভুতুড়ে কাণ্ড করে আসছে।

প্রতীকী ছবি

যেমন ২৪৯ সালে রোমান সাম্রাজ্যে হানা দেওয়া সাইপ্রিয়ান প্লেগের সময় মনে করা হতো যে সংক্রমিত কারও মুখের দিকে তাকালেই এ রোগ হতে পারে। এখন শুনলে যতই হাস্যকর লাগুক, ওই সময়ে কিন্তু এটিই ছিল বাস্তবতা। ঠিক একই রকম বহু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিংবা তারও আগে হোমারের ‘ইলিয়াডে’ যেমনটা বর্ণনা করা হয়েছে, প্লেগের প্রকোপের পেছনে রয়েছে অ্যাপোলোর রোষ। অ্যাপোলো এক অদৃশ্য তির ছুড়ে দিচ্ছেন। এই তির যার যার গায়ে লাগছে, সেই প্লেগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিংবা আরও এগিয়ে আসা যাক। একটা সময় যক্ষ্মাকে বিবেচনা করা হতো রাজকীয়, অভিজাত ও সৃষ্টিশীল রোগ হিসেবে। নানা সাহিত্যেই এমন বর্ণনা পাওয়া যাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। এখানে উল্লেখ করা যায় বিখ্যাত উপন্যাস ‘আঙ্কেল টমস কেবিন’–এর কথা, যেখানে শুধু দাসযুগের বয়ানই হাজির হয়নি; যা একই সঙ্গে ছিল যক্ষ্মারও আখ্যান।

সবচেয়ে বেশি ভুল ধারণা সম্ভবত ছিল যক্ষ্মা নিয়েই। না, যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই—ধরনের ভুল ধারণার কথা বলা হচ্ছে না। এ বিষয়ে ‘দ্য নিউইয়র্কারে’ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও ওষুধের ইতিহাস বিষয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ফ্রাঙ্ক এম স্নোডেন বলেন, ‘মানুষ খুবই মজার প্রাণী।’ এই বক্তব্যের সপক্ষে যুক্তি হিসেবে তিনি জানাচ্ছেন, ‘উনিশ শতক পর্যন্ত মনে করা হতো যে যক্ষ্মা একটি অভিজাত রোগ। এ রোগে শিল্পী এবং সুন্দর ও শুদ্ধ ব্যক্তিরা আক্রান্ত হয়, যা তাদের আরও সুন্দর করে তোলে।’ স্নোডেন বলছেন, এই ধারণা থেকেই ফ্যাশন দুনিয়া বিশেষত নারীকে মেকআপ দিয়ে আরও ফ্যাকাশে ও আরও রোগা করে উপস্থাপনের চেষ্টা করে। স্নোডেন বলছেন, এমনকি ভিক্টর হুগোকে তাঁর বন্ধুরা বলেছিল যে লেখক হিসেবে তাঁর একটি বড় খুঁত রয়েছে। আর তা হলো, তাঁর যক্ষ্মা হয়নি। ফলে তাঁর পক্ষে তেমন মহান লেখক হওয়াটা সম্ভব হবে না।’

উনিশ শতকের শেষ দিকের মার্কিন চিন্তাবিদ ও লেখক আর্থার সি জ্যাকবসনের ধারণা ছিল, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র জিনিয়াস কবি–সাহিত্যিক–শিল্পী ও চিন্তাবিদের অভাব বোধ করবে। কারণ কী? কারণ, যক্ষ্মা রোগটিই কমে যাচ্ছে। ফলে আগের মাপের ব্যক্তিত্ব পাওয়া যাবে না। এখন যত হাসিই আসুক, এ ধারণা কিন্তু ভীষণভাবে চালু ছিল। এর ভূরি ভূরি প্রমাণ পাওয়া যাবে সাহিত্য, চিত্রকলাসহ নানা গবেষণাপত্রে। কী দারুণ সব ম্যাজিক মানুষের বাস ছিল সেকালে, তাই না? তা একালেও কম কী? একজন ট্রাম্পই তো যথেষ্ট, যিনি করোনা–সংক্রমিত ব্যক্তিদের জীবাণুনাশক খেয়ে বাঁচতে বলেন।

একটু ফরাসি দেশ ঘুরে আসা যাক। সাল ১৩৪৮। ফ্রান্সের রাজা ষষ্ঠ ফিলিপ তখনকার চিকিৎসাশাস্ত্রবিদদের ডেকে বুবোনিক প্লেগের কারণ জানতে চাইলেন। রাজার আজ্ঞা বলে কথা। শাস্ত্রজ্ঞরা লেগে পড়লেন। শেষে জানালেন—নক্ষত্রের দোষে মানুষ মরছে। তাঁরা সুনির্দিষ্টভাবে জানালেন, ‘১৩৪৫ সালের ২০ মার্চ শনি, মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহ পরস্পরের খুব কাছাকাছি আসে। একই সময়ে হয়েছিল চন্দ্রগ্রহণও। আর এরই ফল ভোগ করছে সবাই।’

আবার এই প্লেগকে কেন্দ্র করেই এসেছিল ‘বদ–হাওয়া’ তত্ত্ব। এটা এতটাই প্রভাবশালী তত্ত্ব ছিল যে, ১৬৬০–এর দশকে হানা দেওয়া প্লেগের সময় কর্মরত চিকিৎসকদের অনেকেই সুগন্ধিযুক্ত মাস্ক ব্যবহার করতেন সুস্থ থাকার জন্য।

শিল্পীর চোখে মহামারির সময়কার লন্ডনের দৃশ্য। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

এগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তো ছিলই, যেমনটা এখনো আছে। মারি বরাবরই মানুষে মানুষে অবিশ্বাস ছড়িয়ে দেয়। মধ্যযুগে ইউরোপে প্লেগ ছড়িয়ে পড়লে এর কারণ হিসেবে ইহুদি সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করে বলির পাঁঠা বানানো হলো। বলা হলো—শয়তানের সঙ্গে যুক্তি–পরামর্শ করে পানির উৎসগুলোকে ইহুদিরা কলুষিত করে ফেলেছে। আর এই বিশ্বাস থেকে, প্লেগের প্রতিটি ঢেউয়ে ইহুদিরা আক্রান্ত হয়েছে। ১৯ শতকে ইউরোপে কলেরা ছড়িয়ে পড়লে একই রকম অবিশ্বাস দেখা দেয় একই সম্প্রদায়ের পৃথক শ্রেণির মধ্যে। দরিদ্র শ্রেণি মনে করল যে তাদের হত্যার উদ্দেশ্যে অভিজাতদের ষড়যন্ত্র এটি। রাশিয়া থেকে শুরু করে ইতালি ও যুক্তরাজ্য পর্যন্ত বহু স্থানে এই ভাবনা সহিংসতার রসদ জোগাল। তা এই সময়ও কম যায় কিসে? নতুন করোনাভাইরাসকে ‘চীনা ভাইরাস’ মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের চীনা অভিবাসীসহ হরদম এশীয়দের ওপর আক্রমণ বেড়েছে বলে বিভিন্ন মাধ্যমেই খবর এসেছে।

এভাবে বরাবরই মহামারিকালে নানা ধরনের ভুল ধারণা নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছে, যার অনেকগুলোকেই এই সময়ে বসে ভীষণ রকম হাস্যকর মনে হবে। মানুষ বাঁচতে চেয়েই এসব ভুল ধারণাকে আঁকড়ে ধরেছে বারবার। তার মনের ওই ইচ্ছা, যা তাকে এই সুন্দর ভুবনে বেঁচে থাকার কথা বলে, তাই তাকে দিয়ে এমন নানা কাণ্ড ঘটিয়ে নেয়। এই ইচ্ছাটির নামই হলো জীবনস্পৃহা, যা তাকে দিয়ে তামাশারও নির্মাণ করে। এই তামাশা দুদিক থেকেই নির্মিত হয়। কর্তাব্যক্তিরা নিরাপদ বলয়ে বসে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি নিয়ে এমন সব তামাশা করেন, যা ভয়াবহ রকমের প্রাণসংহারী হয়ে ওঠে। ফলে খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচতে চাওয়া সাধারণ মানুষের পক্ষে এমন সব ঘটনার জন্ম দেওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না, যা তাকে বা তাদের নিরাপদ বলয়ে থাকা মানুষের কাছে তামাশার বস্তুতে পরিণত করে।

এটি যখন ঘটে, তখন সেই বৃহৎ সাধারণের মধ্যেও একসময় কর্তাব্যক্তিদের অবহেলা ও নিজের নড়বড়ে জীবন নিয়ে তামাশার শক্তিটি জন্ম নেয়। জনস্বাস্থ্যের এই বিরাট দুঃসময়ে কর্তাব্যক্তিদের নানা কর্মকাণ্ডকে কৌতুকের দৃষ্টিতে দেখার যোগ্যতাটি এই জীবনস্পৃহা দিয়েই সে অর্জন করে, যা বড়দের সাহিত্যের জাঁহা জাঁহা প্রেমিকদের থাকে না। অথচ বাস্তবিক এই রূপকথার জগতে জীবনস্পৃহাই একমাত্র সত্য। মারিকালে বিস্তৃত জনপরিসরে বিদ্যমান মশকরা ও ম্যাজিক–বাস্তবতার পেছনের কার্যকারণটি আদতে তাই একই।