Thank you for trying Sticky AMP!!

আফ্রিকায় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে ভুয়া তথ্য

আফ্রিকায় হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ভুয়া তথ্য ছড়ানোর মাত্রা বাড়ছে। ছবি: এএফপি

আফ্রিকার দেশ নাইজেরিয়ার রাজধানী আবুজা। এই শহরে ট্যাক্সি চালান ম্যাথিউ স্ট্যানলি। ফোন হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ঢুকেই একটি ভিডিও দেখতে পেলেন তিনি। ভিডিওটি দেখে যেন ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলেন। নাইজেরিয়ার মুসলিম ধর্মাবলম্বী প্রেসিডেন্ট দেশটির খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করার পরিকল্পনা করছেন, এমন বার্তা না কি দেওয়া হচ্ছে ভিডিওতে। তবে ভিডিওর এমন বার্তা শুরুতেই বিশ্বাস করলেন না স্ট্যানলি। ফোনের দিকে চোখ রেখেই বললেন, ‘আমার মনে হয় এটা ভুয়া খবর। আগে আমাকে খবরটির উৎস জানতে হবে।’

তবে আফ্রিকার সবাই কিন্তু স্ট্যানলির মতো সন্দেহপ্রবণ নন। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বিশ্বব্যাপী প্রায় দেড় শ কোটি মানুষ হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু আফ্রিকার মতো এত প্রভাব বোধ হয় পৃথিবীর আর কোনো প্রান্তেই ফেলতে পারেনি হোয়াটসঅ্যাপ। নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে হোয়াটসঅ্যাপ সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। পশ্চিমা বিশ্বে হোয়াটসঅ্যাপের পাশাপাশি প্রচুর মানুষ ফেসবুক-টুইটারও ব্যবহার করেন। কিন্তু আফ্রিকার দেশগুলোতে ইন্টারনেট ব্যবস্থা অন্য মহাদেশের মতো এতটা শক্তিশালী নয়। তাই হোয়াটসঅ্যাপকেই বেছে নেন বেশির ভাগ আফ্রিকান। সহজে অডিও বার্তা আদান-প্রদান করা যায় বলে তুলনামূলক কম শিক্ষিত আফ্রিকানরাও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেন। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপের এই জনপ্রিয়তাই একে রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত করেছে।

গত ফেব্রুয়ারি-মার্চে নাইজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও প্রাদেশিক নির্বাচনের দিকে তাকালেই রাজনৈতিক কাজে হোয়াটসঅ্যাপকে ব্যবহারের বিষয়টা পরিষ্কার হয়। সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে, নাইজেরিয়ার মানুষের হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারের প্রবণতায় মূলত দেশটির সামাজিক কাঠামোরই প্রতিফলন ঘটে।

নাইজেরিয়ার উত্তর দিকের একটি শহর কানো। দুজন গবেষক এ শহরে করা এক গবেষণায় দেখতে পেয়েছেন, বেশির ভাগ মানুষ কোনো না কোনো হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের সদস্য। গ্রুপগুলোতে গড়ে ৫০ জনের মতো সদস্য আছেন। গ্রুপের আকার যত বড় হয়, তথ্যও তত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রুপগুলো বন্ধুস্থানীয় ব্যক্তি কিংবা সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত হয়, গ্রুপে শেয়ার করা খবরের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও তাই সন্দেহ করেন না অধিকাংশ মানুষ।

হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারের ধরন থেকে নাইজেরিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। নাইজেরিয়ার নির্বাচন শতভাগ স্বচ্ছ না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় বেশ। নীতিনির্ধারণী দক্ষতা দিয়ে নয়, বরং প্রভাব-প্রতিপত্তি দিয়েই নির্বাচনে জিততে চান বড় বড় নেতারা। সবশেষ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রধান দুই প্রার্থী মুহাম্মাদু বুহারি ও আতিকু আবুবকর, দুজনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ বড় দল নিয়োগ করেছিলেন। তাঁদের ভালোভাবেই জানা ছিল, হোয়াটসঅ্যাপকে যে যত ভালো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, নির্বাচনে জয়ের পথে তিনি ততটাই এগিয়ে যাবেন। দেশটির ৩৬টি প্রদেশ এবং ৭৭৪ টি মিউনিসিপ্যালিটির প্রত্যেকটির সমর্থকদের জন্য আলাদা আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলার ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁরা।

দলগুলোর দাবি, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে তারা কোনো মিথ্যা তথ্য ছড়ায় না। বাস্তবতা হলো, দলগুলোর নিজ উদ্যোগে ভুয়া খবর ছড়ানোর প্রয়োজনও পড়ে না। নাইজেরিয়ায় রাজনীতিবিদদের সুনজরে আসার সবচেয়ে নিরাপদ উপায় হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁদের হয়ে প্রচারণা চালানো। শুধু যে সুনজরে আসা যায় তাই নয়, রোজগারটাও মন্দ হয় না। রাজনীতিবিদদের সন্তুষ্ট করার জন্য অনেকে তাই স্বপ্রণোদিত হয়েই ‘প্রোপাগাণ্ডামূলক’ বিষয়বস্তু তৈরি করেন। ছবি, ভিডিও, মিম বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে তাঁরা মাসে ৮৪ ডলারের মতো উপার্জনও করে।

‘প্রোপাগাণ্ডামূলক’ কনটেন্ট তৈরি করা লোকেদের আকাঙ্ক্ষা, তাঁদের তৈরি করা কোনো একটি মিম ভাইরাল হবে, এবং সেটি কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক নেতার চোখে পড়বে। এতে করে কোনো বোনাস, চুক্তি এমনকি চাকরিও জুটে যেতে পারে। ভুয়া তথ্য সংবলিত এই কনটেন্টগুলো তারপর ছড়িয়ে দেওয়া হয় গ্রুপ থেকে গ্রুপে, আর লোকজনও সেগুলো বিশ্বাস করে ভালোভাবেই।

কিন্তু এই ভুয়া তথ্যগুলো মানুষকে কতটা প্রভাবিত করে? গবেষকেরা বলছেন, ভুয়া খবর কতজনের কাছে পৌঁছে সেটি নির্ণয় করাই মুশকিল, আর কতজন বিশ্বাস করেন সেটি বের করা তো আরও কষ্টসাধ্য। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই, মিথ্যার বেড়াজাল ভেদ করে সত্য তথ্য পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেকটা সময় লাগে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট নামের একটি গবেষণা সংস্থা পাঁচজনকে নিয়োগ দেয়, যাদের কাজ ছিল মিথ্যা তথ্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। কিন্তু ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হার এত বেশি ছিল যে, তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

নাইজেরিয়াই একমাত্র আফ্রিকান দেশ নয়, যেখানে এ রকম রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু আছে। একজন গবেষক দেখিয়েছেন, ২০১৮ সালে সিয়েরা লিওনে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়া ভুয়া তথ্য দেশটির রেডিওর টক শোতে পর্যন্ত প্রচারিত হয়েছিল। কেনিয়ায় ২০১৭ সালের নির্বাচনের আগে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে সদস্যদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল একটি সংস্থা।

ভুয়া তথ্য ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে হোয়াটসঅ্যাপকে ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পর হোয়াটসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষও কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিল। হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ এখন সর্বোচ্চ পাঁচজনকে পাঠানো যায়। এই ব্যবস্থার ফলে গুজব ছড়ানো কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হলেও পুরোপুরি প্রতিকার হয়নি। চিজম্যান নামের এক গবেষক বলেছেন, ‘আপনি তথ্য ছড়ানোর কাজটা যথাসম্ভব কঠিন করে তুলতে পারেন। কিন্তু তার মানে এই না যে ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধ হয়ে যাবে। পার্থক্য এটুকুই, আগের চেয়ে একটু বেশি সময় লাগবে কেবল।’

নাগরিকদের সচেতন করতে কিছু কিছু দেশ এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় সর্বশেষ নির্বাচনের আগে সাধারণ মানুষের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছিল, হোয়াটসঅ্যাপে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে দেখলেই যেন তাঁরা নির্দিষ্ট নম্বরে সেটি পাঠিয়ে দেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যত দিন তথ্য শেয়ার করার সুযোগ থাকবে, ভুয়া তথ্যও তত দিন ছড়াবে। কেবল ব্যবহারকারীরা সচেতন হলেই ভুয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধ করা যাবে, এমনটাও বলছেন তাঁরা। তাঁদের ভাষ্য, আফ্রিকায় হোয়াটসঅ্যাপ যেমন সবচেয়ে জনপ্রিয়, তেমনি সবচেয়ে বিপজ্জনকও।