Thank you for trying Sticky AMP!!

রুয়ান্ডা গণহত্যা: ১০০ দিনে ৮ লাখ মানুষ হত্যা

রুয়ান্ডায় ২৫ বছর আগে শুরু গণহত্যার শিকার অধিকাংশ মানুষই ছিলেন সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের। ছবি: বিবিসি

১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত ১০০ দিনের মধ্যে প্রাণ হারিয়েছিল রুয়ান্ডার প্রায় আট লাখ নাগরিক। ২৫ বছর আগে শুরু গণহত্যার শিকার অধিকাংশই সংখ্যালঘু তুতসি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল। গণহত্যা পরিচালনাকারীরা ছিল হুতু সম্প্রদায়ের। যদিও রুয়ান্ডাতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার, কিন্তু তারপরও এত অল্প সময়ে বিশালসংখ্যক মানুষকে হত্যা করার কথা চিন্তা করাও ছিল কল্পনাতীত।

দীর্ঘদিন শাসনক্ষমতায় থাকা তুতসিরা হুতুদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ছিল। দেশটির মানুষের মধ্যে ৮৫ শতাংশ হুতু।

বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, ১৯৫৯ সালে তুতসি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে হুতুরা। তখন হাজারো তুতসি প্রতিবেশী কয়েকটি দেশে পালিয়ে যায়। ২০০৩ সাল পর্যন্ত চলা গণহত্যায় প্রায় ৫০ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রতিষ্ঠা হয়েছে ২০০২ সালে। এর অনেক আগে রুয়ান্ডার গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। ফলে, এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করতে পারবেন না এই আদালত। তবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ওই হত্যাযজ্ঞের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিচারের জন্য তানজানিয়ার আরশা শহরে একটি আদালত স্থাপন করেছে। এ আদালতের নাম ‘রুয়ান্ডার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত’। দীর্ঘ এবং ব্যয়বহুল বিচারের পর গণহত্যার জন্য এখন পর্যন্ত ৯৩ জনের বিচার হয়েছে। এঁদের অনেকেই হুতু সরকারের আমলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ছিলেন। সবাই হুতু সম্প্রদায়ের।

সামাজিক আদালত গাসাসা
গণহত্যায় অভিযুক্ত লাখো মানুষের বিচার দ্রুত করার জন্য রুয়ান্ডা সামাজিক আদালত তৈরি করেছে। এর নাম গাসাসা। বিচার শুরু হওয়ার আগেই অন্তত ১০ হাজার অভিযুক্ত ব্যক্তি কারাগারে মারা গেছেন। ২০১২ সাল পর্যন্ত ১২ হাজার গাসাসা আদালত বসেছেন। প্রায় ১২ লাখ মামলার বিচার করার চেষ্টা করছেন গাসাসা। সাধারণত, বাজার বা কোনো গাছের নিচে এসব আদালত বসেন। তাঁদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্য বের করা, বিচার এবং পুনর্মিলন ঘটানো। রুয়ান্ডার ভাষায় গাসাসার অর্থ হলো একত্রে বসা এবং আলোচনা করা।

২০১৭ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন পল কাগামি। ছোট্ট ও বিধ্বস্ত দেশটির পুনর্গঠনে কাজ করে যাচ্ছেন কাগামি। তাঁর নীতির কারণে দেশটির দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটেছে। তিনি রুয়ান্ডাকে একটি প্রযুক্তির কেন্দ্র বানানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি নিজেও টুইটারে সক্রিয়। তাঁর অনুসারীও অনেক। তবে তাঁর সমালোচকেরা বলছেন, তিনি বিরোধিতা সহ্য করতে পারেন না। দেশে–বিদেশে তাঁর বেশ কয়েকজন বিরোধী অপ্রত্যাশিতভাবে মারা গেছেন।

এদিকে রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গণহত্যার স্মরণে ৮ এপ্রিল একটি সমাবেশ হবে। রুয়ান্ডা একসময় যাদের কলোনি ছিল, সেই বেলজিয়ামের প্রেসিডেন্ট চালর্স মাইকেল, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট কাগামি, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ, উগান্ডার প্রেসিডেন্ট উয়োরি মুসেভেনিসহ কয়েকটি আফ্রিকান দেশের সরকারপ্রধানেরা উপস্থিত থাকবেন।

রুয়ান্ডার রাজধানী কিগালিতে গণহত্যার স্মরণে সমাবেশে যোগ দিতে এসেছেন ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ। তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছেন রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট পল কাগামি। ছবি: সংগৃহীত

ঘটনার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
গণহত্যা কেন হয়েছিল, এর প্রধান কারণ জানতে হলে ফিরে যেতে হবে পেছনে। ১৯১৬ সালে বেলজিয়াম সেনাবাহিনী দখল করে নেয় পূর্ব আফ্রিকার ছোট সবুজঘেরা দেশটিকে। জাতিগতভাবে রুয়ান্ডাতে সংখ্যাগুরু হুতু এবং সংখ্যালঘু তুতসি দুই সম্প্রদায়ের লোক বাস করত। চালচলন ও আচার-আচরণের দিকে থেকে দুই সম্প্রদায়ের লোকই একই রকম ছিল। তারা একই ভাষায় কথা বলত, একই এলাকায় থাকত, কিন্তু দেখতেই কেবল কিছুটা ভিন্ন ছিল। তুতসিরা ছিল হুতুদের চেয়ে কিছুটা লম্বা এবং চিকন গড়নের। কথিত আছে, তুতসিদের আদি বাসস্থান ইথিওপিয়া। সেখান থেকে আদি পুরুষেরা রুয়ান্ডায় পাড়ি জমান। এই নিয়ে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক আগে থেকেই দ্বন্দ্ব বিদ্যমান ছিল।

বেলজিয়াম ক্ষমতা দখলের পর রুয়ান্ডার নাগরিকদের সম্প্রদায়ের ওপর ভিত্তি করে দুই রকম পরিচয়পত্র দেওয়ার নিয়ম প্রচলন করে। এতে তুতসি ও হুতুদের মধ্যে ভেদাভেদ তৈরি হয়। যেখানে তাদের একমাত্র পরিচয় হওয়ার কথা ছিল রুয়ান্ডার নাগরিক, সেখানে তারা এখন আনুষ্ঠানিকভাবে হুতু এবং তুতসি দুই গোত্রে বিভক্ত হয়ে গেল। বেলজিয়ানরা তুতসিদের বেশি প্রাধান্য দিত হুতুদের চেয়ে এবং বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন মনে করত। বেশি সুযোগ-সুবিধা পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই তুতসিরাও বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছিল।

বৈষম্যের স্বীকার হুতু সম্প্রদায়ের মধ্যে ধীরে ধীরে ক্ষোভ জমতে থাকে। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫৯ সালে। সে বছর হুতু ও তুতসিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ হারায় প্রায় ২০ হাজার তুতসি। অনেকেই পালিয়ে পাশের দেশ বুরুন্ডি, তানজানিয়া ও উগান্ডায় যায়। ১৯৬২ সালে বেলজিয়ান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলে নিজেদের স্বাধীনতা ফিরে পায় রুয়ান্ডা। স্বাধীনতা পাওয়ার পরপরই হুতুরা তাদের হারিয়ে ফেলা ক্ষমতা আবার ফিরে পায়।

১৯৭৩ সালে তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে রুয়ান্ডার দায়িত্ব গ্রহণ করেন হুতু নেতা একনায়ক জুভেনাল হাবিয়ারিমানা। তাঁর শাসনামলে রুয়ান্ডার অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়ে। একই সময়ে পল কাগামির (বর্তমান রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট) নেতৃত্বে উগান্ডায় পালিয়ে যাওয়া তুতসিরা রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ) নামে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহী দল গঠন করেন। প্রেসিডেন্ট হাবিয়ারিমানাকে ক্ষমতাচ্যুত করে তুতসিদের নিজে দেশে ফিরিয়ে আনাই এই ফ্রন্টের উদ্দেশ্য ছিল।

নির্বাসিত তুতসির একটি দল বিদ্রোহী বাহিনী গঠন করেন। এই বাহিনীর নাম রুয়ান্ডান প্যাট্রিয়টিক ফ্রন্ট (আরপিএফ)। ওই বাহিনী ১৯৯০ সালে রুয়ান্ডায় অভিযান শুরু করে এবং ১৯৯৩ সালে শান্তিচুক্তি না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চলে।

১৯৯৪ সালের ৮ এপ্রিল রাতে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুভেনাল হাবিয়ারিমানা এবং বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট সাইপ্রিয়েন নটারিয়ামনাকে—যাঁদের দুজনেই হুতু সম্প্রদায়ের—বহনকারী বিমান গুলি করে ভূপাতিত করা হয়। ওই বিমানে থাকা সব যাত্রী নিহত হন।

এই ঘটনার জন্য আরপিএফকে দায়ী করে হুতু চরমপন্থীরা এবং গণহত্যার সুপরিকল্পিত কর্মকাণ্ড শুরু করে। আরপিএফের দাবি, ওই বিমানকে গুলি করেছে হুতুরাই, যাতে তারা গণহত্যার একটি প্লট তৈরি করতে পারে। অতি সতর্কতার সঙ্গে বিরোধী পক্ষের সরকারি কর্মকর্তাদের তালিকা হুতুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। তালিকা ধরে ধরে তাদের পরিবারের সদস্যসহ হত্যা করা হয়। ওই সময় প্রতিবেশীরা প্রতিবেশীদের হত্যা করে। এমনকি অনেক হুতু স্বামী তাদের তুতসি স্ত্রীদের হত্যা করেছে। এর কারণ হিসেবে হুতুরা দাবি করে, এ হত্যা না করলে তাদের (হুতু) হত্যা করা হতো।

সেই সময় প্রত্যেকের পরিচয়পত্রে গোত্রের নাম উল্লেখ থাকত। এ কারণে চরমপন্থীরা রোড ব্লক বসিয়ে পরিচয়পত্র যাচাই করত এবং তুতসিদের হত্যা করত। বেশির ভাগ সময় এসব হত্যাকাণ্ডে ব্যবহার করা হয়েছে ধারালো ছুরি। হাজারো তুতসি নারীকে আটক করে যৌনদাসী করা হয়।

রুয়ান্ডার তখনকার সরকারি দল এমআরএনডির একটি যুব শাখা ছিল ইন্টেরা হামায়ি। এই যুব শাখার সদস্যরাই পরে চরমপন্থী মিলিশিয়ায় রূপ নেন। তাঁরাই বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছেন। স্থানীয় গ্রুপগুলোর হাতে অস্ত্র এবং হিটলিস্ট তুলে দেওয়া হয়, যারা ভালোভাবে জানত যে এসব মানুষকে কোথায় পাওয়া যাবে।

হুতু চরমপন্থীরা একটি বেতার কেন্দ্র স্থাপন করেছিল, যার নাম ছিল আরটিএলএম। ওই বেতার কেন্দ্র এবং পত্রিকার মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হতো, লোকজনকে হত্যা করার জন্য বলা হতো। যে নামীদামি ব্যক্তিদের হত্যা করা হতো, তাঁদের নাম ওই রেডিওতে পড়ে শোনানো হতো। এই সময় ১০০ দিনের হত্যাযজ্ঞে আট লাখ তুতসি আর প্রগতিশীল হুতুকে হত্যা করা হয়।

আরও পড়ুন
রুয়ান্ডার যুদ্ধশিশুদের কথা