Thank you for trying Sticky AMP!!

করোনা যেভাবে সামাল দিল জাপান

শিনজো আবে। ছবি: এএফপি

জাপানের স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৫ জানুয়ারি চীনের উহান শহর থেকে ফিরে আসা দেশের একজন জাপানি নাগরিকের প্রথম করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হওয়া শনাক্ত করার খবর দিয়েছিল। এরপর থেকে জাপানে রোগের সংক্রমণ এড়াতে কী করা যায়, তা নিয়ে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বিভিন্ন সংগঠন ও কার্যালয় পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। কিন্তু হঠাৎ করে টোকিওর পাশের ইয়োকোহামা বন্দরে নোঙর করা প্রমোদতরি ডায়মন্ড প্রিন্সেস জাপানের জন্য পরিস্থিতি জটিল করে তোলে।

এর আগে অবশ্য উহানের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সম্পর্কিত আরও কয়েকটি করোনা সংক্রমণের ঘটনা ধরা পড়ে। এর পরপরই জাপান দ্রুততার সঙ্গে চীনের হুবেই প্রদেশ থেকে পর্যটক আগমনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং উহান ও আশপাশের কয়েকটি শহরে অবস্থানরত জাপানি নাগরিকদের বিশেষ বিমানে করে দেশে ফিরিয়ে আনে। দেশে ফিরে আসা জাপানিদের কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থাও নিয়মানুযায়ী করা হয়। এসবই ছিল প্রথম দিকে নেওয়া সঠিক এবং সময়োচিত পদক্ষেপ।

তবে ডায়মন্ড প্রিন্সেসের অনাহূত ঘটনায় সরকারের পদক্ষেপ ছিল বিভ্রান্তিকর ও অগোছালো। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জাপানে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং সেই সঙ্গে মৃত্যুর সংখ্যা। বলা যায় তখন থেকে সরকারের বিভিন্ন মহল নড়েচড়ে বসতে শুরু করে। স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার মতো তড়িঘড়ি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টায় সার্বিকভাবে নিয়োজিত হয়। তারপরও বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এই মহামারির হাত থেকে জাপান শুরুতে নিজেকে সেভাবে রক্ষা করতে পারেনি।

পরবর্তীকালে নেওয়া নানা রকম পদক্ষেপের আলোকে অবশ্য অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় জাপানের সাফল্য এখন একেবারে অবজ্ঞা করার মতো নয়। ১৫ জানুয়ারি প্রথম রোগ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের সংখ্যা ১ হাজার ৮০০ ছাড়িয়ে গেছে। এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৫২ জন। পশ্চিমা অনেক দেশের তুলনায় এটা তেমন কিছু নয়; বরং জাপানের মতো বয়স্ক মানুষের সংখ্যাধিক্যের দেশে এই মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক যথেষ্ট কম। কারণ, করোনাভাইরাসে বয়স্কদের জীবন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ থাকে।

বিশেষজ্ঞ প্যানেল ও করোনা মোকাবিলার সুপারিশ
সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কল্যাণে করোনার সংক্রমণ আপাতত সামাল দেওয়ার বা সীমিত রাখা জাপানের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। তবে এর জন্য অন্যদিক থেকে আবার অর্থনীতির গতি মন্থর হয়ে পড়ার মতো যথেষ্ট মাত্রার পরোক্ষ মূল্য জাপানকে দিতে হচ্ছে। তবে তারপরও বলতে হয়, দেরিতে হলেও সরকারের এগিয়ে আসা এবং সেই সঙ্গে নাগরিকদের সক্রিয় সহযোগিতা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই জাপান সরকার চিকিৎসাবিজ্ঞান ও সংশ্লিষ্ট পেশার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি প্যানেল গঠন করে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি সামাল দিতে প্যানেলের নানা রকম সুপারিশ ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে। প্যানেলের সুপারিশের মধ্যে প্রধানত ছিল নাগরিকদের জন্য করণীয় বেশ কিছু পরামর্শ। এসব সুপারিশ ঠিক করে নেওয়ার আগে দেশের ভেতরে করোনা সংক্রমণের উৎস খুঁজে দেখতে হয়েছে।

দেশের ভেতরে শুরুতে পশ্চিম জাপানের ওসাকায় ব্যাপকভাবে করোনা সংক্রমণ দেখা যায়। মূলত ওসাকা ও আশপাশের এলাকায় সংক্রমণের উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা জানতে পারেন, যেসব কনসার্ট হলে গায়ক এবং দর্শকেরা কাছাকাছি অবস্থান করে গানবাজনার তালে নাচে অংশ নিচ্ছেন, সেখান থেকে রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে তাৎক্ষণিকভাবে সে রকম কনসার্টের আয়োজন বন্ধ করে দেওয়া হয়। পাশাপাশি বিনোদনের জনবহুল জায়গাগুলো এড়িয়ে চলার পরামর্শ দেওয়া হয় নাগরিকদের। এ ছাড়া ওই ধরনের স্থানে যাঁরা গিয়েছেন, তাঁদের অবিলম্ব স্থানীয় জনস্বাস্থ্য কেন্দ্রের শরণাপন্ন হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।

সেই পথ ধরে জাপান সরকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন বাতিল করে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করা ছাড়াও স্কুল বন্ধ রাখার মেয়াদ বাড়িয়ে নেয় এবং সারা দেশের সব কটি বিশ্ববিদ্যালয়কে ১ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস কমপক্ষে তিন সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানায়। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি কার্যালয়গুলোতে কর্মীদের বাড়িতে বসে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়ার আহ্বান জানান হয়।

পাশাপাশি নাগরিকদের জন্য নিজেকে জীবাণুমুক্ত রাখার সহজ উপায় সম্পর্কে নিয়মিত পরামর্শ প্রদান বিরতিহীনভাবে চলতে থাকে। এই কাজে সম্প্রচারমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মতো প্রচলিত প্রচার পথের বাইরে বাইরে অন্যদেরও জড়িত করা হয়। কমিউটার ট্রেন, পাতালরেল ও বাসের যাত্রীরা আজকাল যেমন চালকের নিয়মিত ঘোষণার বাইরে মাস্ক পরে চলাচল করা এবং বাইরে থেকে ফিরে গিয়ে নিয়মিতভাবে সাবান দিয়ে হাত ধোয়া ও জীবাণুনাশক ব্যবহার করে হাত জীবাণুমুক্ত করে নেওয়ার উপদেশ শুনে আসছেন।

অন্যদিকে সামান্য জ্বর কিংবা গলাব্যথা অনুভব করলে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণের উপদেশ দেওয়া হচ্ছে। মানুষের ভিড় যেসব জায়গায় বেশি, সেখানে পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ঘাটতি থাকলে ওই স্থান থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকার সুপারিশও করা হচ্ছে। এ ছাড়া খুব কাছে থেকে একে অন্যের সঙ্গে কথা বলা এড়িয়ে যাওয়ার সুপারিশও প্যানেল করে।

এ রকম বহুমুখী পদক্ষেপ এবং সেই সঙ্গে নাগরিকদের সহযোগিতামূলক আচরণের কল্যাণে করোনাভাইরাসের বিস্তার সীমিত পর্যায়ে ধরে রাখতে পেরেছে জাপান। এখন পর্যন্ত সম্ভব হলেও ভাইরাসের বিস্তার নতুন করে বিপজ্জনক মাত্রায় উন্নীত হওয়ার আশঙ্কা সরকারের বিশেষজ্ঞ প্যানেল উড়িয়ে দিচ্ছে না। ফলে নজরদারি ব্যবস্থা বহাল রাখা এবং উপদেশ মেনে চলায় নাগরিক সহায়তার আহ্বান জানানো প্যানেল অব্যাহত রেখেছে।

প্রয়োজন হয়নি দেশজুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণার

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া বন্ধ করতে জাপানকে অবশ্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়নি। এ ছাড়া ঢালাওভাবে নাগরিকদের করোনাভাইরাসের পরীক্ষাও জাপান কার্যকর করেনি। কেননা সে রকম অবস্থায় মাত্রাতিরিক্ত চাপের মুখে জনস্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে। এর বিপরীতে শারীরিক অসুস্থতা অনুভব করলে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখে স্বাভাবিক চিকিৎসা গ্রহণের অনুরোধ করা হয় নাগরিকদের। সবকিছুর ঊর্ধ্বে ভীতসন্ত্রস্ত না হয়ে স্বাভাবিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পরামর্শ নাগরিক জীবন স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক হয়েছে। সুপারমার্কেট ও অন্যান্য দোকানপাট আগের মতোই খোলা আছে এবং পণ্যের ঘাটতিও সেখানে তেমন নেই।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া বন্ধ করতে জাপানকে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে হয়নি। ছবি: রয়টার্স

বরং সতর্কতার কারণে প্রয়োজন ছাড়া মানুষ বাইরে না বেরোনোয় বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কম। এ কারণে করোনাভাইরাসের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়েছে জাপানে অর্থনীতির ওপর। অর্থনীতির সব কটি খাত ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে সবচেয়ে বড় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে রেস্তোরাঁ ও খুচরা কেনাকাটার ব্যবসার বাইরে দেশের পর্যটনশিল্প ও হোটেল ব্যবসাকে। সংকটকবলিত এসব খাতকে দুর্যোগের সময় কীভাবে সাহায্য করা যায়, সেই চিন্তা করছেন দেশের নীতিনির্ধারকেরা।

সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি না করা হলেও জাপানের উত্তরের জেলা হোক্কাইডোর গভর্নর অবশ্য নিজে থেকে তাঁর জেলায় জরুরি অবস্থা জারি করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। শুরুতে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের অধিকাংশ হোক্কাইডোবাসী হওয়ায় জেলা গভর্নর বিলম্ব না করে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। জাপানের স্থানীয় বিভিন্ন প্রশাসন যথেষ্ট মাত্রায় স্বায়ত্তশাসিত। তবে জরুরি অবস্থা ঘোষণা স্থানীয় প্রশাসনের এখতিয়ারের বাইরে। তা সত্ত্বেও জেলা গভর্নর আগ বাড়িয়ে সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এর আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকা সত্ত্বেও নাগরিকেরা নিজেদের কল্যাণের কথা ভেবে তা মেনে নেন। এর ফলে হোক্কাইডোতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির নাটকীয় অগ্রগতি লক্ষ করা গেছে।

করোনার অন্য শিকার
তবে জাপানে করোনাভাইরাসের সবচেয়ে বড় শিকার হতে হয়েছে দেশের অর্থনীতিকে। লোকজন স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নিজেদের ঘরে আটকে রাখায় রেস্তোরাঁ ব্যবসা লাটে ওঠার পথে। অন্যদিকে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে আসা পর্যটকের সংখ্যা একেবারে তলানিতে ঠেকায় খুচরা বিক্রি ও হোটেল ব্যবসাকে টিকে থাকার সংগ্রামে হিমশিম খেতে হচ্ছে। একই অবস্থা গাইডেড ট্যুর পরিচালনা করা বিভিন্ন কোম্পানি, রেল এবং বিমান চলাচল খাতের বেলাতেও।

সংকটকবলিত এসব খাতকে উদ্ধার করতে জাপান সরকার এখন থোক সহায়তা প্যাকেজ ঠিক করে নিচ্ছে। সহায়তা প্রদান কর্মসূচির জন্য সরকারের সরাসরি খরচের পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ লাখ কোটি ইয়েনের বেশি। এর বাইরে আরও আছে সুদমুক্ত বা স্বল্পসুদের ঋণ প্রদানের মতো সরাসরি ব্যয়বহির্ভূত অন্যান্য খরচ। সবকিছু যোগ করা হলে থোক সহায়ক কর্মসূচির জন্য খরচ করতে হওয়া অর্থের মোট পরিমাণ ৩০ লাখ কোটি ইয়েন ছাড়িয়ে যাবে বলে কর্মকর্তারা অনুমান করছেন।

অন্যদিকে আর্থিক সংকটের মুখে ভোক্তা ব্যয় হ্রাস পেলে সরকারের রাজস্ব আয় যথেষ্ট মাত্রায় কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব কিছুই জাপানের অর্থনীতিকে মন্দা অবস্থার মুখে ঠেলে দিতে পারে। বেসরকারি খাতের গবেষণা প্রতিষ্ঠান দাই-ইচি লাইফ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাম্প্রতিক এক হিসাবে দেখানো হয়েছে, করোনাভাইরাস সংক্রমণ এককভাবে জাপানের ৫৪০ লাখ কোটি ইয়েনের অর্থনীতি থেকে ৩ লাখ ৮০ হাজার কোটি ইয়েন ছেঁটে নিতে পারে।

অন্যদিকে থোক সাহায্য কর্মসূচির জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে সরকারকে আবারও বাজারে বন্ড ছাড়ার ওপর নির্ভর করতে হবে। ফলে তা রাষ্ট্রীয় ঋণের পরিমাণ আরও বাড়িয়ে দেবে। এমনিতেই ঋণভারে জর্জরিত দেশ জাপান। এর বাইরে আবার টোকিও অলিম্পিক বিলম্বিত বা বাতিল হয়ে গেলে আরও যে বিশাল অঙ্কের লোকসানের মুখে জাপানকে পড়তে হতে পারে, সেই হিসাব কিন্তু এখনো করা হয়নি।