Thank you for trying Sticky AMP!!

কী হতে যাচ্ছে মিয়ানমারে

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংসতার মুখেও আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভকারীরা

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ভেবেছিল, পথটা তাদের জন্য সহজ হবে। তারা অতীতের মতো ‘নির্বিঘ্নে’ বছরের পর বছর সেনাশাসন চালিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু মিয়ানমারের জান্তার ধারণা যে ভুল, তা এখন তারা টের পাচ্ছে। ১ ফেব্রুয়ারি সেনা অভ্যুত্থানের পরপরই মিয়ানমারে আন্দোলন শুরু হয়। দ্রুত এই আন্দোলন পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই আন্দোলন এখন অনেকটাই ‘গণ-আন্দোলনে’ রূপ নিয়েছে।

মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের দুই মাস পেরিয়ে গেছে। অং সান সু চির নির্বাচিত সরকার উৎখাত করে ক্ষমতা দখলের পর দেশটির সেনাবাহিনী দম ফেলার সময় পায়নি। তার আগেই তারা প্রতিবাদের মুখে পড়ে। দুই মাসের বেশি সময় ধরে মিয়ানমারজুড়ে বিক্ষোভ, ধর্মঘট, অসহযোগের মতো আন্দোলন চলছে। বিশেষ করে ধর্মঘট ও অসহযোগে মিয়ানমার প্রায় বিপর্যস্ত। দেশটির প্রশাসন, অর্থনীতিসহ প্রায় সব খাতে এই কর্মসূচির মারাত্মক প্রভাব লক্ষণীয়। জনগণের টানা আন্দোলনে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চাপ অনুভব করছে। তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে।

শুরুর দিকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ভেবেছিল, এসব আন্দোলন-বিক্ষোভ বেশি দূর এগোবে না। অচিরেই থেমে যাবে। কিন্তু দিন যত গড়ায়, আন্দোলনের তীব্রতা ততই বাড়তে থাকে। বিক্ষোভকারীদের দমাতে শক্তি প্রয়োগের পথ বেছে নেয় সেনাবাহিনী। সামরিক জান্তার সহিংস দমন–পীড়নের পরিণতিতে মিয়ানমারে এখন পর্যন্ত ৫৮০ জনের বেশি বিক্ষোভকারী নিহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার-আটক কয়েক হাজার।

মিয়ানমারে এত মৃত্যু, এত রক্ত ঝরার পরও দেশটির বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কোনো ভয়ভীতি নেই; বরং তাঁরা প্রতিদিন দ্বিগুণ সাহস নিয়ে রাজপথে নামছেন। সেনাশাসনের বিরুদ্ধে তুমুল আওয়াজ তুলছেন। বুক চিতিয়ে দিচ্ছেন জান্তার বন্দুকের নলের সামনে। বুলেট দিয়ে গণতন্ত্রের দাবিকে স্তব্ধ করতে চাইছে দেশটির সামরিক জান্তা। কিন্তু দেশটির জনগণ স্পষ্টই মৃত্যুকে আর পরোয়া করছে না।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী শক্তিশালী ও নৃশংস হওয়া সত্ত্বেও তারা যে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পেরে উঠছে না, তার নানা আলামত স্পষ্ট। তারা বারবার বিক্ষোভকারীদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখানোর চেষ্টা করছে। বিক্ষোভে যোগ দিলে প্রাণহানির শঙ্কা আছে বলে সতর্ক করছে। ধর্মঘট-অসহযোগকে অবৈধ বলছে। ধর্মঘট-অসহযোগে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের দেশের ‘শত্রু’ বলে অভিহিত করছে। আন্দোলনকারীরা মিয়ানমারকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে বলে আন্দোলন থেকে তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টা করছে সেনাবাহিনী।

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পুরোনো কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইছে। কিন্তু তারা মিয়ানমারের জনগণের ‘পালস’ বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। দেশটির জনগণের মধ্যে গণতন্ত্রের জন্য তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। যার কারণে তারা অকাতরে প্রাণ দিতেও কুণ্ঠাবোধ করছে না। এর মধ্যে দেশটির ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগঠনগুলোও সেনাশাসনের বিরুদ্ধে এক হয়েছে। এ কারণে দেশটির জান্তা সরকার নানামুখী প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

মিয়ানমারে চলমান সেনাশাসনবিরোধী আন্দোলনকে ‘গণ-আন্দোলন’ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষক খিন জাও উইন। তাঁর পর্যবেক্ষণ হলো, মিয়ানমারের সেনাশাসনবিরোধী বিক্ষোভ শুধু আকারেই বড় নয়; বরং তা বৈচিত্র্যের দিক দিয়েও স্বতন্ত্র। বিস্ময়কর বিষয় হলো, মিয়ানমারের নানা শ্রেণি, পেশা, বিশ্বাস, নৃগোষ্ঠীসহ সব অঙ্গনের মানুষ একটি সাধারণ লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আর তা হলো স্বৈরশাসনের পতন।

মিয়ানমারের জান্তা যতই নতুন নির্বাচন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিক, যতই দমন-পীড়ন চালাক, তারা কোনোভাবেই আর সামরিক অভ্যুত্থানকে জায়েজ করতে পারবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যাশলে সাউথের মতে, পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা মিয়ানমারের জান্তার জন্য অসম্ভব।

সু চির দল এনএলডির যেসব এমপি গ্রেপ্তার এড়াতে পেরেছেন, তাঁরা সামরিক অভ্যুত্থানবিরোধী একটি কমিটি গঠন করেছেন। তাঁরা ইতিমধ্যে নিজেদের মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে দাবি করেছে। এই কমিটি দেশটির জনগণকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।

দেশটির পুলিশ ও প্রশাসনের অনেকে জান্তার পক্ষ ত্যাগ করছে। এসব লক্ষণ বলে দিচ্ছে, এবার জান্তার অবস্থা আগের মতো আর শক্তপোক্ত নয়। মিয়ানমারে রক্তপাত হয়তো বাড়বে, কিন্তু জান্তার পক্ষে নির্বিঘ্নে ক্ষমতা ধরে রাখাটা কঠিনই হবে।

আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের সেনা কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলেই মনে হয়। এ অবস্থায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে একমাত্র দেশটির জনগণই ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে পারে। এ প্রসঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমারবিষয়ক উপদেষ্টা রিচার্ড হোরসির মত হলো, সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করার উপায় দেশটির জনগণের হাতেই রয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের শক্তিই হবে আসল শক্তি।

গার্ডিয়ান, ইকোনমিস্ট, দ্য ডিপ্লোম্যাটসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের ফ্রিল্যান্স ফরেন করেসপনডেন্ট টম ফাথ্রপ মিয়ানমারের বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপটে ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। আর তা হলো জন-আকাঙ্ক্ষাকে কখনো দমানো যায় না। জনগণই শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়।