Thank you for trying Sticky AMP!!

চাকরি আর টাকায় কী হয়, ভালোবাসা চাই

ঘটকালি পার্টিতে টেবিলে টেবিলে ঘুরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সাক্ষাৎ নিচ্ছেন জাপানি তরুণ-তরুণী ও তাঁদের অভিভাবকেরা। খুঁটিয়ে দেখছেন তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত। ছবি: এএফপি।

সবাই পরিপাটি। গায়ে সুন্দর পোশাক। সাজসজ্জার কমতি নেই। টেবিলে টেবিলে ঘুরছেন। চলছে হালকা আলাপচারিতা। উল্টেপাল্টে দেখছেন জীবনবৃত্তান্ত। যদি না মনের মতো জীবনসঙ্গী মিলে যায়।

টোকিওর কনফারেন্স কক্ষটি ইতিমধ্যে ঠাসা। জীবনসঙ্গী খুঁজে নিতে তরুণ-তরুণীরা ভিড় করেছেন সেখানে। তাঁদের সবাই এসেছেন মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে। পরিচয় প্রকাশ না করে ৩৮ বছরের এক তরুণী বললেন, বর খুঁজে নেওয়ার মতো ‘সাহস তাঁর নেই’। আবার মাকে ছাড়া কোথাও যান না। তাই ঘটকালির পার্টিতে মাকে সঙ্গে করেই এনেছেন। তিনি বলেন, ‘জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার মতো খুব বেশি সুযোগ হয়নি আমার। কারণ, আমার কর্মস্থলে নারীর সংখ্যা অনেক, কিন্তু পুরুষের সংখ্যা কম।’

সরকারি হিসাবে, জাপানে ২০ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মানুষের একটা বড় অংশ একা। তাঁরা এখনো বিয়ে করেননি। অনেকে বিয়ে করার আগ্রহ প্রকাশ করলেও ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক চাপের কারণে তাঁদের আর বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়নি।

জাপানে বিয়ের আগ পর্যন্ত মা-বাবার সঙ্গে থাকার মানে হচ্ছে জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়ার মতো চাপ তাঁদের সন্তানদের তেমন নেই। টোকিওর চুয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক মাসাহিরো ইয়ামাদা বলেন, চাহিদা পূরণ করতে পারবে না—এমন কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়াটা জাপানি তরুণ-তরুণীর কাছে সময় নষ্ট ছাড়া আর কিছুই নয়। তাঁর মতে, এসব তরুণ-তরুণী ‘পরাশ্রয়ী একলা’।

মাসাহিরো ইয়ামাদার মতে, স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে থাকতে গেলে তাঁর দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাকে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু মা-বাবাকে সঙ্গে নিয়ে থাকার মতো সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের ব্যবস্থা করাটা তরুণ-তরুণীদের জন্য কঠিনই বটে।

৪৬ বছরের ছেলের জন্য যোগ্য কনে খুঁজতে ঘটকালি পার্টিতে এসেছিলেন ৭৪ বছরের এক বৃদ্ধ। তাঁর মতে, জাপানের তরুণ-তরুণীদের বিয়েতে আগ্রহ না থাকার পেছনে আরও একটি কারণ হচ্ছে ‘লজ্জা’। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে পেশায় একজন বিক্রেতা। ক্রেতাদের ভালোই সামলান তিনি। কিন্তু নারী ক্রেতারা এলেই তিনি ঘাবড়ে যান।’ তিনি জানান, তাঁর ছেলে কাজ নিয়ে এতটাই ব্যস্ত থাকেন যে নিজের বউ পর্যন্ত নিজে পছন্দ করতে আসতে পারেননি। তাঁর বড় মেয়ে বিয়ে করলেও ছোট মেয়ে এখনো বিয়ে করেননি। তিনি পেশায় চিকিৎসক। বয়স ৩৪ বছর। থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। এখন ছোট মেয়েকে নিয়েই যত চিন্তা তাঁর। বলেন, ‘আমি শুনেছি, নারী চিকিৎসকদের জন্য জীবনসঙ্গী খুঁজে নেওয়াটা কঠিন।’

জাপানে বিয়ের হার কমে যাওয়ার পেছনে ‘সমান ঘরে অথবা উচ্চশ্রেণি বা জাতিতে বিয়ে করার প্রবণতা’কে দুষছেন চুকিয়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক শিগেকি মাতসুদা। তিনি বলেন, জাপানি তরুণীদের প্রবণতা হচ্ছে ভালো চাকরি ও শিক্ষিত তরুণদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। তরুণীরা নিজের চেয়ে কম উপার্জনের পুরুষকে বিয়ে করতে আগ্রহ দেখান না। তাঁরা এই সিদ্ধান্ত না বদলালে দেশেও অবিবাহিত নারী-পুরুষের হার কমবে না।

তা ছাড়া অনেকের ক্ষেত্রেই ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীর সঙ্গে কর্মস্থলেই সাক্ষাৎ হয়ে যায়। এটাও বিয়ে না হওয়ার একটা বড় কারণ। জাপানে চাকরির নিরাপত্তা কমে আসছে। তাই নিরাপত্তাহীন একজন চাকরিজীবীর সঙ্গে নিজের জীবনকেও অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে চান না তাঁরা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান তার অর্থনীতিকে ব্যাপকভাবে পুনর্গঠন করেছে। জীবনের তাগিদে অতি নিবেদিত কর্মীদের কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এটা একটা বিপদও ডেকে এনেছে। কাজের ধরনে বড় পরিবর্তন আসায় সেখানে চাকরির নিরাপত্তাও কমে যাচ্ছে।

দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ১৯৯০–এর দশকের গোড়া থেকে সেখানে অস্থায়ী ও চুক্তিভিত্তিক চাকরিজীবীর হার বেড়েছে। ১৫ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ৪০ শতাংশে পৌঁছায় এই শ্রেণির সংখ্যা।

কম আয় ও অনিশ্চিত চাকরি—এই দুটি কারণেই জাপানের তরুণ-তরুণীরা বিয়ে করতে বা সংসার বাঁধতে সাহস দেখান না। এক সরকারি হিসাবে, ভালো বেতনে চাকরি করেন এবং বয়স ৩০ থেকে ৩৪ বছর—২০১৭ সালে এমন ১০ জন জাপানি তরুণের মধ্যে ৬ জনই বিয়ে করেছেন। আর একই সময়ে একই বয়সের চুক্তিভিত্তিক কর্মী বিয়ে করেছেন মাত্র ২২ শতাংশ।

এমনকি টোকিওর ঘটকালির পার্টিতেও যাঁরা এসেছেন, তাঁরাও কিছুটা ভাগ্যবান। কারণ, কম আয়ের কেউ এই পার্টিতে আসার কথা চিন্তাও করেন না।

এত সব বাধার পরও এ ধরনের পার্টি কোনো কাজে আসে কি না, এমন প্রশ্নে পার্টির আয়োজন প্রতিষ্ঠানের প্রধান সোজি ওয়াকি সাকা বলেন, কিছু সফলতা তো আসেই। কিন্তু সেটা খুবই সীমিত। অংশগ্রহণকারীদের মাত্র দুজন জীবনসঙ্গী খুঁজে পান।

কঠিন এসব বাস্তবতার মধ্যেও জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনার একটা উপায় বাতলে দিয়েছেন ঘটকালি পার্টির অন্যতম কাউন্সেলর নোরিকো মিয়াগোসি। আর সেটি হলো ‘ভালোবাসা’। তিনি বলেন, ‘খুব বেশি শর্ত দিয়ে জীবন চলে না। আমি মনে করি, আপনি এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবেন, যাকে আপনি সত্যিই অনুভব করেন এবং আপনি যার সঙ্গে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারবেন।’ তথ্যসূত্র: এএফপি