Thank you for trying Sticky AMP!!

জি-২০ ও নাগোইয়া দুর্গের হোমমারু প্যালেস

হোমমারু প্রাসাদের প্রবেশ পথ। ছবি: লেখক

পশ্চিম জাপানের ওসাকা শহরে জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বসেছিল বিশ্বের ২০টি অগ্রসর অর্থনীতির দেশের নেতাদের শীর্ষ সম্মেলন। মূল সম্মেলন শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখনো কাটেনি জি-২০-এর আমেজ। সম্মেলনের বাইরে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা জাপানের বিভিন্ন শহরে বৈঠকে মিলিত হয়ে নিজ নিজ বিষয়ের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। সেই ধারাবাহিকতায় আগামী অক্টোবরে ওকাইয়ামা শহরে বসছে স্বাস্থ্য, শ্রম ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের বৈঠক এবং নভেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে নাগোইয়ায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক।

এরপর নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে হোক্কাইদোর কুচান শহরে পর্যটনমন্ত্রীদের বৈঠকের মধ্যে দিয়ে জাপানে প্রায় সারা বছর ধরে চলা জি-২০ সম্মেলনকে ঘিরে নানাবিধ আয়োজন শেষ হতে যাচ্ছে।

মন্ত্রী পর্যায়ের সব কটি বৈঠকের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠককে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ এতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যার ওপর আলোকপাত করা হবে। এ ছাড়াও সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় হঠাৎ করে দেখা দেওয়া উত্তেজনা নিরসনের উপায় নিয়েও আলোচনা হবে। সমাধান আদৌ পাওয়া যাবে কি না, তা প্রশ্নসাপেক্ষ। কারণ এসব সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তের আইনগত কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তাই আলোচনা খুব বেশি ফলপ্রসূ হয় না। কাঠামোগত দিক থেকে এসব বৈঠক অনেকটাই হয়ে থাকে কেবলই আনুষ্ঠানিকতা। তবে তা সত্ত্বেও নভেম্বর মাসের ২২ ও ২৩ তারিখে নির্ধারিত জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনের প্রস্তুতি এখন মধ্য জাপানের নাগোইয়া শহরে পুরোদমে এগিয়ে চলেছে।

কাঠের প্যানেলে কানো স্কুলের শিল্পীদের আঁকা বাঘের ছবি। ছবি: লেখক

আয়োজক কমিটি জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক উপলক্ষে নাগোইয়ায় সমবেত হতে যাওয়া অতিথিদের সম্মেলনের বাইরে শহরের বিভিন্ন স্থাপনা ও বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এই তালিকায় আছে নাগোইয়া দুর্গের হোমমারু প্রাসাদ। সপ্তদশ শতকের সূচনালগ্নে জাপানের প্রভাবশালী তোকুগাওয়া সামুরাই পরিবারের শক্ত ঘাঁটি হিসেবে নাগোইয়া দুর্গ তৈরি হয়েছিল। তোকুগাওয়া পরিবার পরবর্তী সময়ে জাপানের সর্বময় কর্তৃত্ব নেয়। এরপর দুর্গ এবং সংলগ্ন হোমমারু প্রাসাদ হয়ে ওঠে জাপানের শিল্পকলার সমৃদ্ধ ধারা।

১৮৬৮ সালে মেইজি পুনরুত্থানের মধ্যে দিয়ে তোকুগাওয়া শোগুন প্রশাসন ক্ষমতাচ্যুত হয়। এরপর নাগোইয়া দুর্গ আকর্ষণ হারিয়ে ফেলে। তার পরও এটি দুর্গকেন্দ্রিক স্থাপত্য ও জাপানের শিল্পকলা অগ্রযাত্রার সমৃদ্ধ নিদর্শন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের অন্য অনেক শহরের মতো নাগোইয়াও মার্কিন বিমান হামলার লক্ষ্যে পরিণত হয়। বিমান হামলায় একসময় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল জাপানের অন্যতম প্রধান এই দুর্গটি। হোমমারু প্রাসাদ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হওয়ায় ঝুঁকির মুখে পড়েছিল জাপানের সমৃদ্ধ অনেক শৈল্পিক নিদর্শন। স্থায়ী কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত কাঠের নানা রকম শিল্পকর্ম ছিল হারিয়ে যাওয়া সমৃদ্ধ বিভিন্ন কারুকাজের অন্তর্ভুক্ত।

একদিকে সরিয়ে নেওয়া দরজায় শিল্পীর আঁকা আরেকটি অসাধারণ ছবি। ছবি: লেখক

যুদ্ধকালীন বিমান হামলায় হোমমারু প্রাসাদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যায়। সেখানে সংরক্ষিত বিপুল ঐতিহাসিক নিদর্শন অবশ্য সময়মতো নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া হয়। দীর্ঘ বিরতি শেষে হোমমারু প্রাসাদের পুনর্নির্মাণ কাজ শেষ হলে সেসব শিল্পকর্ম এখন আবারও নতুন করে তৈরি হওয়া পুরোনো জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব অমূল্য সম্পদের মধ্যে আছে ১ হাজার ৪৯টি স্ক্রিন, দেয়াল ও ছাদচিত্রের প্যানেল। এর মধ্যে ১ হাজার ৪৭টি জাপানের মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদের তালিকাভুক্ত।

২০১৩ সাল থেকে শুরু হওয়া হোমমারু প্রাসাদের তিন পর্বের পুনর্নির্মাণের কাজ চলতি বছরের জুলাইতে শেষ হয়েছে। নাগোইয়ার নগর কর্তৃপক্ষ জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক উপলক্ষে শহরে আসা অতিথিদের জাপানের মূল্যবান এসব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখার সুযোগ করে দিতে চায়।

ঘরের এলকোভ বা সাজসজ্জার অংশে আঁকা ছবি। ছবি: লেখক

জি-২০ পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের আগে চলতি মাসে টোকিওভিত্তিক বিদেশি সাংবাদিকদের একটি দলকে নগর প্রশাসন নিয়ে গিয়েছিল জাপানের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে। হোমমারু প্রাসাদজুড়ে জাপানের মধ্যযুগের চিত্রকলার চমৎকার সব নিদর্শন রয়েছে। এগুলো মুগ্ধ করার মতো। বিশেষ করে কানো স্কুল নামে পরিচিত দেয়াল ও স্ক্রিন ছবির শিল্পীদের অসাধারণ কিছু কাজ সহজেই প্রমাণ করতে পারে, জাপানের ছবি আঁকার সেই বিশেষ ধারাটি কতটা সমৃদ্ধ ছিল।

কানো স্কুলের জনক হিসেবে গণ্য করা হয় কানো মাসানোবুকে (১৪৩৪-১৫৩০)। কিওতোভিত্তিক এই শিল্পী জীবজন্তু, পাখি আর ফুল-লতাপাতার ছবি আঁকায় নিজস্ব যে রীতি চালু করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুসারীরা বংশানুক্রমে সেই ধারা অব্যাহত রেখে শিল্পকলার শীর্ষে সেটাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। হোমমারু প্রাসাদের চিত্রকলার প্রায় সবই এই কানো স্কুলের শিল্পীদের আঁকা।

পশ্চিমের দেশগুলোতে নামী শিল্পীদের আঁকা চিত্রকলা সাধারণত অবস্থাপন্ন ব্যক্তিরা দুটি উদ্দেশ্য নিয়ে সংগ্রহ করেন। প্রথমত, এগুলো হচ্ছে এক ধরনের বিনিয়োগ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দাম বাড়ার মধ্যে দিয়ে বাড়তি মুনাফা মালিকের জন্য নিয়ে আসতে পারে। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের সংগ্রহের নামীদামি চিত্রকলা ঘরে সাজিয়ে রাখার মধ্যে দিয়ে সংগ্রহ কতটা সমৃদ্ধ, অন্যদের সেটা দেখিয়ে দিতে পারে। ধনীদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। এতে চিত্রকলার মূল্যবৃদ্ধিতে শিল্পীরাও সহায়ক ভূমিকা পালন করেন। শিল্পীরা লাভবান হচ্ছেন। ক্রেতার অভাবে ছবি আঁকার জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে না পারার হতাশায় তাঁদের আর ভুগতে হচ্ছে না। পশ্চিমের দেশগুলোতে বিশেষ করে ইউরোপে এই প্রবণতা কয়েক শ বছর ধরে প্রচলিত। এর মধ্যে দিয়ে চিত্রকলায় সমৃদ্ধ এক স্থায়ী বাজার ইউরোপের দেশগুলোতে তৈরি হয়েছে।

তাতামি মাদুর পাতা শূন্য ঘরে নতুন মাত্রা এনে দেওয়া শিল্পীর আঁকা ছবি। ছবি: লেখক

পুবের দেশগুলোতে বিশেষ করে চীন আর জাপানে চিত্রকলা মূলত টিকে থাকতে পেরেছে সামন্ত প্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতার কল্যাণে। একালে পুবের শিল্পের বাজারে ইউরোপের প্রভাব সহজেই লক্ষ করা গেলেও বিশেষ করে অতীতে জাপানে দীর্ঘ সময় ধরে সামন্ত প্রভুরাই টিকিয়ে রেখেছিলেন শিল্পকলার চর্চা। দৈনন্দিন জীবনে চিত্রকলার ব্যবহারিক প্রয়োগ এর পেছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে। জাপান ও চীন দুই দেশেই মধ্যযুগে এবং এমনকি ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক পর্যন্ত শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতার পেছনে ছিল সামন্ত প্রভুদের ঘরের সাজসজ্জায় এসবের ব্যবহার। জাপানে প্রাক-আধুনিক যুগের চিত্রকলা বলতে প্রধানত বোঝায় ঘরের একদিকে সরিয়ে নেওয়া দরজা কিংবা ভাঁজ করা পার্টিশন বা বিভাজনের জন্য আঁকা ছবি।

জাপানে মধ্যযুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী সমরনায়ক একসময় হয়ে উঠেছিলেন তোকুগাওয়া পরিবারের সদস্যরা। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে ওদা নোবুনাগা ঘনিষ্ঠ এক সহচরের হাতে মারা যান। পরবর্তী সময়ে অন্য এক অনুসারী তয়োতমি হিদেইয়োশির একত্রীকরণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে মধ্য জাপানের আইচি এলাকাভিত্তিক সামন্ত প্রভু তোকুগাওয়া ইয়েইয়াসু ওসাকাভিত্তিক হিদেইয়োশি পরিবারের উত্তরসূরিদের পরাভূত করে জাপানের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে নেন। পরে এই তোকুগাওয়া পরিবার ২৫০ বছর ধরে জাপানে দাপটের সঙ্গে নিজস্ব আধিপত্য ধরে রাখতে সক্ষম হয়। জাপানের ইতিহাসে ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সেই আড়াই শ বছর তোকুগাওয়া যুগ নামে পরিচিত। ওই সময়ে শিল্প ও সংস্কৃতির বিকাশ নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছেছিল।

ছাদ পর্যন্ত উঠে যাওয়া দেয়ালচিত্র। ছবি: লেখক

নাগোইয়া শহর ছিল তোকুগাওয়া সামন্ত প্রভুদের ঘাঁটি এবং ১৬০৯ সালে তোকুগাওয়া ইয়েইয়াসু তৈরি করতে শুরু করেন নাগোইয়া দুর্গ। ১৬১৫ সালে দুর্গসংলগ্ন হোমমারু প্রাসাদ নির্মাণের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় দুর্গের নির্মাণপ্রক্রিয়া। তোকুগাওয়া ইয়েইয়াসু ততদিনে ক্ষমতা সম্পূর্ণভাবে নিজের দখলে নিয়ে আসেন। তিনি প্রশাসনিক কেন্দ্র প্রাচীন শহর কিওতো থেকে এদো টোকিওতে সরিয়ে নিয়েছিলেন। হোমমারু প্রাসাদ তখন হয়ে উঠেছিল শোগুন শাসকের এদো থেকে কিওতোতে সম্রাটের সাক্ষাতে যাওয়ার পথের বিরতিস্থল। সেখানে স্থানীয় প্রজা ও সামন্ত নেতারা সাক্ষাৎ করেন। হোমমারু প্রাসাদের বিভিন্ন কক্ষ তিনি এবং তাঁর উত্তরসূরিরা নিজেদের পছন্দের আঙ্গিকে সাজিয়েছিলেন। এর প্রধান উপকরণ ছিল দরজা, দেয়াল ও ঘরের ভাঁজ করা বিভাজনে সেই সময়ের শিল্পীদের আঁকা ছবি। এসব ছবির বাইরে তাতামি মাদুর পাতা ঘরের সবটাই ফাঁকা। এ ধরনের শূন্যতা ছবিতে নিয়ে আসে ভিন্ন আমেজ।

নাগোইয়া দুর্গ ও হোমমারু প্রাসাদ বোমা হামলায় ধ্বংস হয়ে গেলেও প্রাসাদের কর্মীদের দূরদর্শিতার কল্যাণে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে জাপানের মূল্যবান সেই সব শিল্পসামগ্রী। দীর্ঘ বিরতির পর নতুন করে তৈরি করে নেওয়া প্রাসাদে সেগুলো এখন আবারও ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জনগণের প্রদর্শনের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে হোমমারু প্রাসাদের দরজা। জাপানের সাধারণ নাগরিকদের পাশাপাশি বিদেশি অতিথিরাও এখন সেগুলো দেখার মধ্যে দিয়ে মধ্যযুগের জাপানের সমৃদ্ধ শিল্পকলার মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবেন।