Thank you for trying Sticky AMP!!

জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধন, ইসরায়েলি স্নাইপারের গুলিতে প্রাণ গেল ৫৮ ফিলিস্তিনির

আন্দোলনকারীদের দিকে গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে গতকাল সোমবার গাজায় অন্তত ৫৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। পবিত্র জেরুজালেমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস খোলাকে কেন্দ্র করে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভ দমনে ইসরায়েলি সেনারা গুলি চালায়। এতে প্রাণ গেল অন্তত ৫৮ ফিলিস্তিনি নাগরিকের। হতাহত ব্যক্তিদের স্মরণে মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের শোক পালনের ঘোষণা দিয়েছে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ।

সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর ভয়াবহ হামলার পর সেখানে এত বেশি হতাহত হওয়ার ঘটনা আর ঘটেনি।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক কমিশনার জেইদ বিন রাদ জেইদ আল হুসেইন বলেছেন, যারা এ জঘন্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী, তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

ক্ষোভে ফেটে পড়া ছাড়া ফিলিস্তিনিদের আর পথ ছিল না। হাজারো মানুষের সেই বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলি চালাল ইসরায়েলি বাহিনী। এতে প্রাণ গেল অন্তত ৫৮ ফিলিস্তিনির। গুলি-বোমায় আহত আরও ২ হাজার ৭০০ জন। হতাহত হওয়ার সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। বিক্ষোভের মধ্যেই সোমবার জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়। এতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মেয়ে ইভানকা ট্রাম্প, জামাতা জ্যারেড কুশনারসহ ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তা পাঠান ট্রাম্প।

বাইরে রক্তগঙ্গা বইছে, আর জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাসের উদ্বোধন হচ্ছে। ছবি: এএফপি

লক্ষ্যভেদী অত্যাধুনিক ইসরায়েলি স্নাইপারে (বিশেষ একপ্রকার বন্দুক, যা দিয়ে দূরের লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুল নিশানা হয়) অন্তত ৫৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থাপনকে কেন্দ্র করে ভূমি দিবসের চলমান বিক্ষোভ আরও জোরালো হয়। মুক্তির লড়াইয়ে অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনির আত্মাহুতির পাশাপাশি কর্মসূচি সফল করতে গিয়ে আহত হন অন্তত ২ হাজার ৭০০ মানুষ। হতাহত ব্যক্তিদের স্মরণে মঙ্গলবার থেকে তিন দিনের শোক পালন করা হবে।

দূতাবাস স্থানান্তরের দিনকে ট্রাম্প ‘ইসরায়েলিদের জন্য বিশেষ দিন’ আখ্যায়িত করে টুইটারে লিখেছেন, ‘পূর্বাঞ্চলীয় সময় সকাল নয়টায় (দূতাবাস উদ্বোধন) অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ইসরায়েলিদের জন্য বিশেষ একটা দিন!’

‘প্রত্যাবর্তনের মহামিছিল’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে সকাল থেকে হাজারো ফিলিস্তিনি গাজার সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্তে কড়া সুরক্ষিত সীমান্তবেড়া অতিক্রম করার চেষ্টা করে। ১৯৪৮ সালে যে এলাকা থেকে ফিলিস্তিনিরা জোরপূর্বক উৎখাত হয়েছিল, সেখানে প্রত্যাবর্তনে গাজার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ হামাসের নেতৃত্বে কয়েক সপ্তাহব্যাপী চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে গতকালের ওই বিক্ষোভ। সোমবার ছিল নাকবার (মহাবিষাদ) বার্ষিক স্মরণ কর্মসূচির আগের দিন।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বিবিসি ও এএফপি বলছে, নিহত ৫৮ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে শিশুও রয়েছে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২ হাজার ৭০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হন।

ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীদের ঠেকাতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে ইসরায়েল। ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারীরা ওই সেনাসদস্যদের লক্ষ্য করে পাথর ও আগুনবোমা ছোড়েন। ইসরায়েলি বাহিনী গুলি ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়ে পাল্টা জবাব দেয়। এতে হতাহত হওয়ার ওই ঘটনা ঘটে।

ফিলিস্তিনিদের লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো কাঁদানে গ্যাসের শেল ছোড়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। গাজা, ১৪ মে। ছবি: এএফপি

ট্রাম্প প্রশাসন তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে সরিয়ে আনল। ফিলিস্তিনিরা মনে করে, এই দূতাবাস খোলার অর্থ পুরো জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে ইসরায়েলকে ওয়াশিংটনের স্বীকৃতি দেওয়া। এতেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে ফিলিস্তিনিরা।

গাজার ক্ষমতায় থাকা কট্টরপন্থী সংগঠন হামাস ছয় সপ্তাহ ধরে ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ চালিয়ে আসছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রায় ৪০ হাজার ফিলিস্তিনি বিক্ষোভ করছেন। তাঁরা ‘সহিংস দাঙ্গা’ শুরু করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে সেনাবাহিনী। ফিলিস্তিনিরা গাজা-ইসরায়েল সীমান্তে ১৩টি স্থানে নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে ফেলে কাছের ইহুদি পরিবারগুলোর ওপর আক্রমণ চালানোর চেষ্টা করে।

এদিকে দূতাবাস উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পাঠানো ভিডিও বার্তা ট্রাম্প বলেন, ‘ইসরায়েল একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। নিজের রাজধানী নির্ধারণ করার অধিকার তার আছে। কিন্তু বহুদিন আমরা এই সুস্পষ্ট বিষয়টির স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হয়েছি।’

মার্কিন নতুন দূতাবাসের সামনেও ফিলিস্তিনি পতাকা হাতে বিক্ষোভ করেছে ফিলিস্তিনিরা। এই সময় ইসরায়েলি পুলিশ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটক করে নিয়ে যায়।

ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে যুক্তরাষ্ট্রের ইসরায়েলি দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করবেন। গত ৬ ডিসেম্বরে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন ট্রাম্প। এই ঘোষণার পর ফিলিস্তিনিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে ট্রাম্পের ঘোষণার সমালোচনা শুরু হয়। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে ট্রাম্পের স্বীকৃতি প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ভোটাভুটি হয়। তাতে ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাখ্যাত হয়। ভোটাভুটিতে ১২৮ সদস্য ট্রাম্পের ঘোষণা প্রত্যাহারের পক্ষে ভোট দেয়। বিপক্ষে ভোট দেয় মাত্র নয়টি দেশ। ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। তারপরও নিজের নীতিতে অনড় থেকে জেরুজালেমে দূতাবাস স্থানান্তর করলেন ট্রাম্প।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময় প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা এক ফিলিস্তিনি তরুণের। গাজা, ১৪ মে। ছবি: এএফপি

সোমবার বাইরে যখন রক্তগঙ্গা বইছে, তখন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাসের উদ্বোধন হচ্ছে। হোয়াইট হাউসের দুই গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার ও মেয়ে ইভাঙ্কা ট্রাম্প সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ করেন। আর ওই স্থান থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে ফিলিস্তিনিরা তখন হতাহত ব্যক্তিদের নিয়ে ব্যস্ত। বিক্ষোভরত ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে একে নৃশংস হত্যাকাণ্ড আখ্যা দিয়েছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। হতাহতদের স্মরণে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেন তিনি।

এই জেরুজালেম মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদি-সবার কাছেই পবিত্র বলে বিবেচিত। শত শত বছর ধরে জেরুজালেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে স্থানীয় বাসিন্দা, আঞ্চলিক শক্তি ও আক্রমণকারীরা লড়াই করেছে। এর মধ্যে ছিল মিসরীয়, ব্যাবিলনীয়, রোমান, মুসলিম, ক্রুসেডার, অটোমান, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো। সর্বশেষ এই পবিত্র ভূমি দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছে দখলদার ইসরায়েল।

১৯১৭ সালে ‘বেলফোর ঘোষণার’ পর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ইসরায়েল। ওই বছরই আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডসহ বেশ কিছু আরবভূমি দখল করে নেয় ইসরায়েল। এরপর ১৯৬৭ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে ফিলিস্তিনের প্রায় পুরোটাই ও মিসরে সিনাইয়ের কিছু ভূমিও দখল করে ইসরায়েল। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘ একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সীমানা বরাদ্দ রেখেছিল, বর্তমানে তার অর্ধেকও ফিলিস্তিনিদের নিয়ন্ত্রণে নেই। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে ফিলিস্তিনিদের হটিয়ে তাদের জমির ওপর প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ইহুদিবসতি গড়ে তুলেছে দখলদার ইসরায়েল।