Thank you for trying Sticky AMP!!

মধ্যপ্রাচ্যে কি শান্তি আসবে?

১৪ মে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে প্রাণ হারায় প্রায় ৬০ জন ফিলিস্তিনি। ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষরণের শুরু ৭০ বছর আগে ১৯৪৮ সালের ১৫ মে। এদিন ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়। তখন নিজ ভূমি পুনরুদ্ধারে ফিলিস্তিনিরা আন্দোলনে নামে। কিন্তু মানবতা রক্ষায় বিশ্ববাসী জোরালো অবস্থান নিয়ে এগোয়নি। এমনকি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও তারা মুসলিম বিশ্বের পূর্ণ সমর্থন পায়নি।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, পূর্ব জেরুজালেমে ইসরায়েলের উপস্থিতি বেআইনি দখলদারি হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় তারা পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়। এরপর গত পাঁচ যুগের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনায় ১৯৬৭ সালের আগের অবস্থানে ইসরায়েলের পিছু হটার কথা বলা হয়েছে। অথচ বর্তমান ট্রাম্প প্রশাসন আমেরিকার ক্ষমতায় আসার পর ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির পরিবর্তন ঘটে। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেয়। এর ধারাবাহিকতায় ১৪ মে তেল আবিব থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হয়। আর ট্রাম্পকে এই সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেন যুক্তরাষ্ট্রের ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা।

জেরুজালেমে আমেরিকার দূতাবাস চালুর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ফিলিস্তিনিরা। ১৪ মে গাজা সীমান্তে ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে প্রাণ হারায় প্রায় ৬০ জন ফিলিস্তিনি।

জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করার পরের দিন এক বৈঠকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আমেরিকার ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের কাছে জানতে চান, এরপর তাঁরা কী করতে চান। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে ওই বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সেখানে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ওপর চাপ সৃষ্টি করে দূতাবাস স্থানান্তর করার জন্য নেতানিয়াহু ধর্মযাজকদের ধন্যবাদ জানান।

নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই বৈঠকে নেতানিয়াহু কতগুলো দেশের নাম উল্লেখ করে জানতে চান, এরপর কোন দেশের দূতাবাস স্থানান্তর হবে? আমেরিকাকে অনুসরণ করে গুয়াতেমালা, প্যারাগুয়ে ও হন্ডুরাস ইতিমধ্যে তাদের দূতাবাস জেরুজালেমে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু ব্রাজিল, ভারত ও চীনের কী খবর?

বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মায়ামির একটি গির্জার কিউবান-আমেরিকান যাজক ও ট্রাম্পের সমর্থক মারিও ব্র্যামনিক। তিনি বলেন, ‘বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অত্যন্ত উত্তেজিত।’

জেরুজালেমের বিষয়ে তদবিরে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল দীর্ঘদিন নির্ভরশীল ছিল ইহুদিদের ওপর। কিন্তু সম্প্রতি নেতানিয়াহু সরকার তার ঐতিহাসিক ও কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করে প্রভাবশালী ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আমেরিকান ইহুদিদের ইসরায়েলের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার ঝুঁকির মধ্যেই নেতানিয়াহু এ অবস্থান নেন।

বেশির ভাগ ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানের বিশ্বাস, ঈশ্বরের কাছে ইসরায়েল বিশেষ মর্যাদার। এভাবে অনেকে ইহুদি রাষ্ট্রটিকে কট্টর সমর্থন দেন। তাঁরা একই সঙ্গে যুক্তি দেন, পাপ মুক্তির জন্য যিশুকে ত্রাতা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

ওয়াশিংটন নেতানিয়াহুর শক্তিশালী মিত্র। সেখানে ক্ষমতাগ্রহণে ট্রাম্প ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের সমর্থন বেশ ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছেন। ট্রাম্পের ইভাঞ্জেলিক্যাল উপদেষ্টাদের অনেকে গত সপ্তাহে জেরুজালেমে দূতাবাস প্রতিষ্ঠা ও নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকে যোগ দেন। কিন্তু উদারপন্থী ইসরায়েলিরা সতর্ক করেন যে ইসরায়েলি ডানপন্থী ও খ্রিষ্টান ডানপন্থীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা মেরুকরণ জোরদার করছে। ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন একটা দলীয় রূপ পাচ্ছে। এর ফলে দূতাবাস প্রতিষ্ঠার অনুষ্ঠানে ডেমোক্রেটিক কোনো আইনপ্রণেতা যোগ দেননি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, উদারপন্থী ইহুদিরা ইসরায়েলের প্রতি দ্বৈত নীতির অভিযোগও এনেছেন। তাঁরা বলেন, নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকার বামপন্থী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে ধর্মান্ধতার অভিযোগ এনে কঠোর অবস্থান নেন। অথচ রক্ষণশীল সমর্থকদের প্রতি সদয় আচরণ করেন। ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা সংগঠন অ্যান্টিডিফেমেশন লিগের আন্তঃধর্মীয় সম্পর্কবিষয়ক পরিচালক র‍াবাই ডেভিড স্যান্ডমেল বলেন, ‘ইভাঞ্জেলিক্যাল ভোটার কম নয়। তাই ইসরায়েল সরকার বলতে পারে, আমরা সমস্যাপূর্ণ এমন কোনো বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাই না যাতে ভোটে প্রভাব পড়ে।’

রবার্ট জেফ্রেস ডালাসের একটি গির্জার যাজক ও ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক। জেফ্রেসের প্রার্থনা দিয়ে জেরুজালেমে দূতাবাস উদ্বোধনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘একজন ইহুদি হলেই আপনি রক্ষা পাবেন না। ইহুদিবাদ, হিন্দুত্ববাদ, মর্মনবাদের সমর্থকদের স্থায়ী ঠিকানা হবে নরকে।’

সম্প্রতি জেরুজালেমে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। ছবি: রয়টার্স

উদারপন্থী ইসরায়েলি পত্রিকা হারেতজে গত শুক্রবার প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, এটা ‘অধিকাংশ আমেরিকান ইহুদির জন্য তীব্র আঘাত।’ সম্পাদকীয়তে অভিযোগ করা হয়, ইভাঞ্জেলিক্যাল জোট প্রচলিত ক্ষমতার ভিত্তির বিষয়ে ইসরায়েলের অবস্থানে ক্ষয় ধরিয়েছে। মার্কিন ইহুদিরা মনে করে, ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা ইহুদিদের মূল্যবোধের প্রতি হুমকি এবং তাঁদের বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। আমাদের আগামী নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। তখন মার্কিন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ডেমোক্র্যাটদের হাতে চলে যেতে পারে।

দূতাবাস উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ইসরায়েলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ডেভিড এম ফ্রিডম্যান। তিনি বলেন, ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা ইহুদি সম্প্রদায়ের চেয়ে অনেক বেশি ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এক সাক্ষাৎকারে ফ্রিডম্যান বলেন, ‘আপনারা একটা দেশ পরিচালনা করেন। তাই আপনাদের মিত্র ও জোট প্রয়োজন। আপনাদের জনগণের সুরক্ষা প্রয়োজন।’

উদারপন্থী আমেরিকান ইহুদিদের সঙ্গে নেতানিয়াহুর সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে পড়েছিল। তাঁরা মনে করেন, এটা হয়েছিল অংশত ফিলিস্তিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করতে নেতানিয়াহুর অনাগ্রহের কারণে। এর আরও বড় কারণ ইহুদি ধর্ম গ্রহণ ও জেরুজালেমের ওয়েস্টার্ন ওয়াল বা আল বুরাক এলাকায় প্রার্থনার বিষয়ে সংস্কারপন্থী ও রক্ষণশীল নেতাদের সঙ্গে বিতর্কে ইসরায়েলের আল্ট্রা-অর্থডক্স যাজকদের প্রতি তাঁর মৌন সমর্থন। ইভাঞ্জেলিক্যাল জোট তাঁকে উদার ইহুদিদের খুশি করার প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্ত করতে পারে।

নেতানিয়াহুর জীবনীগ্রন্থের লেখক অ্যানশেল পেফের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁর বিশ্বাস, তাঁরা একীভূত (ইভাঞ্জেলিক্যালদের সঙ্গে) হয়ে যাচ্ছেন এবং ইহুদি পরিচয় দিতে আগ্রহী হবেন না।’ তিনি আরও বলেন, আমেরিকার সংখ্যালঘু অর্থোডক্স ইহুদিরা আগামী এক বা দুই দশকের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান ইহুদি হবে। তাঁর মতে, আমেরিকার ইহুদিরা নয়, রিপাবলিকান ও ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানরা হবে ইসরায়েলের প্রতি প্রকৃত সমর্থনের ভিত্তি।

জনমত জরিপ অনুযায়ী, আমেরিকার ডানপন্থীদের মধ্যে ইসরায়েলের সরকারের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। আর বামপন্থীরা সমালোচনামুখর হচ্ছেন। জনসংখ্যা জরিপ বলছে, আমেরিকায় ইহুদি ভোটার কমছে। এর মধ্যে নন-অর্থোডক্স ভোটার কমছে ব্যাপকভাবে।

বিভিন্ন কর্মসূচিতে ইভাঞ্জেলিক্যালদের উজ্জীবিত করেন ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত রন ডার্মার। তিনি এক সাক্ষাৎকারে ইভাঞ্জেলিক্যালদের ‘ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টান’ আখ্যায়িত করে বলেন, এখন তারা ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের ভিত্তি। তারা আমেরিকার জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হতে পারে এবং সেটা ইহুদি জনগোষ্ঠীর চেয়ে ১০, ১৫ ও ২৫ গুণ বেশি। আর বিশ্বব্যাপী ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের সংখ্যা ভড়কে যাওয়ার মতো। এ সংখ্যা ৬০ কোটি হবে। রন ডার্মার বলেন, ‘ইসরায়েল খুব কমই আমেরিকার উদার ও ডেমোক্র্যাট ইহুদিদের সমর্থন চেয়েছে। আপনি একটা পরিবর্তনের কথা বলতে পারেন। তবে বিস্তৃত ও দ্বিদলীয় শক্তিশালী সমর্থন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আপনি একটি পাখা দিয়ে উড়োজাহাজ উড়াতে পারেন না।’

ট্রাম্প প্রশাসন ও ইভাঞ্জেলিক্যাল খ্রিষ্টানদের সমর্থনে জেরুজালেম ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষিত হতে পারে। একের পর দূতাবাস স্থাপনের মাধ্যমে জেরুজালেমের পক্ষে স্বীকৃতি জোরদার হতে পরে। কিন্তু তাতে কী মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি আসবে? ফিলিস্তিনিদের জন্মভূমি পুনরুদ্ধার ও স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা মিলিয়ে যাবে? না, তা হবে না। জয় হবে না মানবতার। বন্ধ হবে না মধ্যপ্রাচ্যে রক্তক্ষরণ।