Thank you for trying Sticky AMP!!

শরণার্থীবান্ধব ভারত এ ভূমিকায় কেন?

মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোয় আজ বুধবার যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অং সান সু চি ও নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারের দক্ষিণাঞ্চলে মানবিক সংকটের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার হুমকির মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশটিতে সফরে গেছেন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অব্যাহত ওই সহিংসতার কারণে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা পাশের বাংলাদেশে পালিয়েছে।

নরেন্দ্র মোদি ও মিয়ানমারের নেতা অং সান সু চি বুধবার এক যৌথ বিবৃতিতে এ সমস্যাকে ‘সন্ত্রাসবাদের সমস্যা’ বলে অভিহিত করে একসঙ্গে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
সু চি বলেন, ‘কয়েক সপ্তাহ আগে আমাদের দেশে সন্ত্রাসী যে হুমকি এসেছে, এ ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় আমরা ভারতকে ধন্যবাদ জানাই।’
মিয়ানমারের সরকারি কর্মকর্তারা বলে আসছেন, রাখাইনে সমস্যা চলমান সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলাফল। বার্মিজদের রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের তথ্যমতে, রোহিঙ্গা জঙ্গিরা ২৫ আগস্ট হামলা চালিয়ে ১২ জন নিরাপত্তা কর্মকর্তাকে হত্যা করার পরই বর্তমান অবস্থার শুরু হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং অং সান সু চি আজ বুধবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে সাক্ষাৎ করেন।
সু চি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, একসঙ্গে কাজ করলে আমরা নিশ্চিত যে আমাদের ভূমিতে সন্ত্রাসবাদের অনুমতি কেউ পাবে না এবং প্রতিবেশী দেশগুলোও এ অনুমতি দেয় না।’
কয়েক সপ্তাহ ধরে চরমপন্থীদের জন্য সহিংসতাকে দায়ী করে সু চি যা বলেছেন, নরেন্দ্র মোদিও তারই সমর্থক।
মোদি বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যে চরমপন্থী সহিংসতার জন্য আমরা চরম উদ্বিগ্ন; বিশেষ করে নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং নিরীহ মানুষ কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং কীভাবে নিহত হয়েছে, এ বিষয়ে উদ্বেগের কথা আমরা জানিয়েছি।’
জাতিসংঘের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে আনুমানিক ১ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। যারা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে গেছে, তারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধ্বংস এবং হত্যার গল্প নিয়ে গেছে।
বাংলাদেশকে বাদ দিলে ভারতেই আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। সে ক্ষেত্রে চলমান সংঘাত নিরসনে ভারতের একটি স্বার্থও রয়েছে। তবে বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভূ-রাজনৈতিক নানা বিবেচনা এ বিষয় নিয়ে তাদের উচ্চবাচ্য থামিয়ে রেখেছে। ভারতের অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ ফেলো কে. ইয়োহম বলেন, ‘ভারত এখন তার পূর্বমুখী নীতি বাস্তবায়নে তৎপর। আর এ কারণে দেশটি বঙ্গোপসাগরের আশপাশে একটি বলয় গড়ে তুলতে চায়। আর এখানে মিয়ানমারের অবস্থানটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
চীনের সঙ্গে ভারতের বৈরিতা দীর্ঘদিনের। আর এই বৈরী প্রতিপক্ষকে সামলাতে মিয়ানমারকে গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করে ভারত। এর কারণ, এ অঞ্চলের বৃহৎ দুই শক্তি ভারত ও চীন এখানে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
ইয়োহম বলেন, ‘মিয়ানমার প্রতিপক্ষের বলয়ে চলে যাক, ভারত তা চায় না।’
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের তুলনামূলক নীরব কূটনীতির পেছনে নিজস্ব কিছু বিবেচনাও আছে ভারতের। গত মঙ্গলবার মোদির মিয়ানমার সফরের সময় ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রেজিজু স্থানীয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বলতে চাই, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের নীতির নিরিখে রোহিঙ্গারা নিবন্ধিত হোক বা না হোক, আইন অনুযায়ী তারা এ দেশে অবৈধ অভিবাসী। তাদের ফেরত পাঠানো হবে।’
তবে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে বলেছে, রোহিঙ্গাদের নিয়ে ভারতের পরিকল্পনার বিষয়ে তারা দাপ্তরিকভাবে কোনো কিছু জানতে পারেনি। আর নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের বের করে দেওয়ার কোনো ঘটনাও তাদের জানা নেই।

বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে কিছুদিন থাকার পর ২০১৩ সালে নিরাপত্তার খোঁজে ভারতের দিল্লিতে পাড়ি জমান রোহিঙ্গা শরণার্থী নিজামুদ্দিন। এরপর কেটে গেছে পাঁচ বছর। কিন্তু এখনো নিরাপত্তার দেখা তিনি পাননি। বরং তার অনিরাপত্তাবোধ আগের থেকে আরও অনেক বেড়েছে। নিজের শঙ্কা সম্পর্কে তিনি সিএনএনকে বলেন, ‘তাড়িয়ে দেওয়া হবে, এমন আশঙ্কা সব সময় আমাদের মধ্যে থাকে।’
দিল্লির যে বাড়িতে নিজামুদ্দিন থাকেন, সেখানে তার রোহিঙ্গা পরিচয়টি গোপন নয়। এ জন্য বাড়ির মালিকের কাছ থেকে বৈষম্যমূলক ব্যবহার সহ্য করতে হয় তাঁকে। কিন্তু রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব প্রকাশের পর এর মাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। নিজামুদ্দিন বলেন, ‘তারা বলছে, তোমরা মুসলমানরা সন্ত্রাসী। নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই তোমরা যুদ্ধ করছ। “তোমরা খারাপ” এ কথাটি আমাদের প্রতিদিনই শুনতে হয়।’
ভারতীয় সরকারের তথ্যমতে, দেশটিতে বর্তমানে ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। যদিও ইউএনএইচসিআরের তথ্য ভিন্ন কথা বলছে। সংস্থাটির তথ্যমতে, ভারতে রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১৬ হাজার ৫০০-র কাছাকাছি।
ভারতে শরণার্থী বিষয়ে আইনি কাঠামো পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে দেশটিতে আশ্রিত রোহিঙ্গারা ‘অবৈধ অভিবাসী’ তকমা থেকে কিছুটা নিষ্কৃতি পেয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় স্থানীয় বিভিন্ন অভিবাসন কার্যালয়কে শরণার্থীদের দীর্ঘমেয়াদি ভিসা প্রদানের এখতিয়ার দিয়ে রেখেছে। কিন্তু এটি শরণার্থীদের জন্য খুব একটা আশার আলো হয়ে আসেনি। কারণ এ ভিসা ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি আলাদাভাবে দেওয়া হয়। ফলে আশ্রয়প্রার্থী এসব মানুষ বহু অধিকার থেকে বঞ্চিত। ভারতে রোহিঙ্গা বিষয়টি নিয়ে কাজ করেন এমন আইনজীবীরা এখন এ বিধানকে চ্যালেঞ্জ করছেন। তাঁদের মতে, ভারতের সুপ্রিম কোর্ট শরণার্থীবিষয়ক আন্তর্জাতিক আইনে সম্মতি জানিয়েছে। এ অবস্থায় এমন নিয়ম চলতে পারে না।
ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। সম্প্রতি এখানকার রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের আবেদন জানিয়ে হাইকোর্টে একটি পিটিশন করেন আইনজীবী হুনার গুপ্ত। আবেদনের পক্ষে তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা বিভিন্ন দেশবিরোধী গোষ্ঠী ও মাদক পাচারকারী সংঘের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে অবৈধ অভিবাসীদের আগমন রোধ করা না গেলে এ অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদী কর্মকাণ্ড ও ভারতবিরোধী বিভিন্ন সন্ত্রাসী তৎপরতা বাড়বে।’
জম্মু ও কাশ্মীর হাইকোর্টে হওয়া এ পিটিশনের ওপর শুনানিতে রোহিঙ্গাদের পক্ষ ছিলেন আইনজীবী কলিন গনস্যালভস। শুনানিতে তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্যে আন্তর্জাতিক আইনকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থী বিষয়ে মুখ্য প্রতিজ্ঞাটি হলো, কোনো শরণার্থীকে এমন কোনো দেশে পাঠানো যাবে না, যেখানে তার মৃত্যু, বিচার কিংবা যেকোনো ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।’
শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে ঐতিহাসিকভাবে ভারত গর্ব করে থাকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় ৮০ লাখ উদ্বাস্তুকে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। এর এক দশক পরে চীনের হস্তক্ষেপের কারণে তিব্বত ছেড়ে আসা উদ্বাস্তুরা ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিপুলসংখ্যক শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক সুমিত গাঙ্গুলি বলেন, ‘এমন একটা ভাব করা হচ্ছে যে ভারতে শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার মতো কোনো আইনগত ভিত্তি নেই, তাই আর কি! কিন্তু এটা একেবারেই ডাহা অসত্য।’ তাঁর মতে, ‘প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি মুসলিমবিরোধী ধারণার মধ্যে প্রোথিত।’ ভারতের বর্তমান সরকারের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘তারা এমন একটা ধারণা দেয় যে সব মুসলিমই জঙ্গি। এটা একেবারেই ভিত্তিহীন ধারণা। নিজেদের পক্ষপাতমূলক ও ঘৃণার নীতিকে মান্যতা দিতে জঙ্গি ধারণাটিকে ব্যবহার করছে তারা।’ তথ্যসূত্র: সিএনএন