Thank you for trying Sticky AMP!!

মোসাদ কি ফিলিস্তিনি বিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে?

গত শনিবার কুয়ালালামপুরে ফাদি আল-বাতশকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি তড়িৎ প্রকৌশলের প্রভাষক ছিলেন। ছবি: এএফপি

গত শনিবার মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে গুলি করে হত্যা করা হয় ফিলিস্তিনের এক তরুণ বিজ্ঞানীকে। ফাদি আল-বাতশ (৩৫) নামের ওই বিজ্ঞানী ঘটনার দিন ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যাচ্ছিলেন। পথে অস্ত্রধারীরা তাঁর ওপর অতর্কিত গুলি চালায়। ফাদি আল-বাতশকে উদ্দেশ্য করে ১০টি গুলি ছোড়া হয়। এর মধ্যে চারটি গুলি তাঁর শরীরে বিদ্ধ হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান তরুণ বিজ্ঞানী।

এ হত্যাকাণ্ডের পর নিহত ব্যক্তির পরিবার দাবি করে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের দুই গুপ্তঘাতকের গুলিতেই নিহত হয়েছেন ফাদি। একই অভিযোগ তুলে ফিলিস্তিনের গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসও দাবি করে, ফাদি আল-বাতশ তাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তবে ফাদি আল-বাতশকে হত্যায় মোসাদের জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছে ইসরায়েল।

কে এই ফাদি আল-বাতশ?
গাজাতে তড়িৎ প্রকৌশল বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করেন ফাদি আল-বাতশ। এরপর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য যান মালয়েশিয়া। তরুণ এই বিজ্ঞানী ছিলেন জ্বালানি ও শক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এসব বিষয়ে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পেপারও প্রকাশ করেছিলেন তিনি। অর্থাৎ ফিলিস্তিনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ ও উদীয়মান ব্যক্তিত্ব ছিলেন এই ফাদি আল-বাতশ।

ফাদি আল-বাতশ ‘অনুগত সদস্য’ ছিলেন—এমনটা জানিয়েছে হামাস। সেই সদস্যকে তারা শহীদ বলে বর্ণনা করেছে। হামাস ‘শহীদ’ শব্দটি সাধারণত ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকে। তারা জানায়, ফিলিস্তিনের যুব পণ্ডিতদের বিজ্ঞানী ছিলেন ফাদি আল-বাতশ। তিনি জ্বালানি বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরামে অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাদি আল-বাতশের বাবা বলেন, তাঁর ছেলের হত্যার পেছনে মোসাদের হাত আছে বলে সন্দেহ করছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তদন্ত করে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচিত করার জন্য মালয়েশিয়া সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন তিনি।

কেন এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মোসাদের সম্পৃক্ততা আছে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে? এ বিষয়ে ইসরায়েলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদক রোনেন বার্গম্যান বলেন, ফাদি আল-বাতশের হত্যাকাণ্ডটি যেভাবে করা হয়েছে, এমনভাবে হত্যাকাণ্ড মোসাদ করে থাকে। রোনেন বার্গম্যান ইসরায়েলের এই গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রমের বিষয়ে বেশ ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। এ বিষয়ে তার একটি বইও আছে—‘রাইজ অ্যান্ড কিল ফার্স্ট’।

আল-জাজিরাকে ফোনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বার্গম্যান বলেন, হত্যাকারীরা মোটরসাইকেলে করে এসে অতর্কিতে গুলি চালিয়ে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে, যা মোসাদের জড়িত থাকার বিষয়টিই ইঙ্গিত করে।

ইসরায়েলের মোসাদ, যার পূর্ণ নাম সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অব কো-অর্ডিনেশন। মোসাদকে আখ্যায়িত করা হয় বিশ্বের সবচেয়ে নিখুঁত গুপ্তহত্যার মেশিন হিসেবে। ইসরায়েলি তথা ইহুদি রাষ্ট্রবাদীবিরোধী সক্রিয় নেতা অথবা ব্যক্তি, যাদের দ্বারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে অথবা হতে পারে—এমন ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সাধারণত এই গুপ্তহত্যার পথ বেছে নেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর খুব অল্প সময়ে মোসাদ তাদের বিস্তৃতি সারা বিশ্বে ছড়িয়েছে। বার্গম্যান তাঁর বইয়ে মোসাদের গুপ্তহত্যার প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদভাবে লিখেছেন। তবে সত্যি বলতে কি, মোসাদ সম্পর্কে মানুষ ঠিক ততটাই জানে, যতটা মোসাদ জানতে দেয়। আল-জাজিরা সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে বার্গম্যানের বইয়ের কিছু বিষয় উল্লেখ করে ফাদি আল-বাতশের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পর্যালোচনা করেছে।

লক্ষ্য শনাক্তকরণ
গুপ্তহত্যার টার্গেট নির্ধারণ করে ইসরায়েলের গোয়েন্দারা। মোসাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংগঠনিক ধাপ পেরিয়ে টার্গেট নির্ধারণ করা হয়। ব্যাপকভাবে বলতে গেলে এতে গোয়েন্দা ও রাজনৈতিক নেতাদের যোগসূত্র থাকে। কখনো কখনো ইসরায়েলের অন্য গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীও লক্ষ নির্ধারণ করে। ফাদি আল-বাতশের ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা হলো, হামাসকে নজরে রাখে ইসরায়েলের যেসব গোয়েন্দা সংস্থা ও মিলিটারি বাহিনী, তারাই তাঁকে বেছে নেয়।

কয়েকটি সূত্র থেকে আল-জাজিরা পর্যালোচনা করে দেখেছে যে গাজা, ইস্তাম্বুল (তুরস্ক) এবং বৈরুতে (লেবানন) মধ্যে হামাসের যোগাযোগের বিষয়টি ইসরায়েলের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কঠোর নজরদারিতে রাখে। প্রাথমিকভাবে ওই নেটওয়ার্কই বেছে নিয়েছে ফাদি আল-বাতশকে। ফাদি আল-বাতশের এক বন্ধু নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, হামাসের সঙ্গে যোগসূত্র থাকার বিষয়টি ফাদি আল-বাতশ কখনোই লুকাতেন না। ফিলিস্তিনি কমিউনিটিতেও এই বিষয়টি অজানা ছিল না।

হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়া
একবার যখন কাউকে টার্গেট করা হয়, তখন মোসাদের মূল কাজ থাকে কোথায় কীভাবে তাঁকে হত্যা করা হবে, সেই বিষয়টি পর্যালোচনা করা। এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে কী সুবিধা পাওয়া যাবে এবং হত্যার সবচেয়ে সুবিধাজনক উপায় নিয়ে ভাবে তারা। টার্গেটের বিষয়ে সব তথ্য নিয়ে মোসাদের বিশেষ ইউনিট তাদের ফলাফল ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস কমিটি—ভারাসকে দেয়। ভারাস তখন অপারেশনের বিষয়ে ইনপুট ও পরামর্শ দেয়। তবে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা এর নেই।

কেবল ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী এই ধরনের গুপ্ত হত্যায় অনুমোদন দিতে পারেন। বার্গম্যান মনে করেন, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী সাধারণত রাজনৈতিক কারণে নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করেন না। বেশির ভাগ সময়ই এই বিষয়ে আরও দু-একজন মন্ত্রীকে যুক্ত করা হয়। তবে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পরামর্শই বেশির ভাগ সময় নেওয়া হয়। অনুমোদনের পর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার কাজটি চলে যায় মোসাদের হাতে। মোসাদ হত্যার পরিকল্পনা করে। অনেক সময় এটা করতে সপ্তাহ, মাস এমনকি সাত বছরও লেগে যায়।

সিজারিয়া বিভাগ

মোসাদের গোপন অপারেশন গুলো করে থাকে ‘সিজারিয়া বিভাগ’। বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে গুপ্তচর নিয়োগ এবং গুপ্তচরবৃত্তির দায়িত্বে থাকে এই বিভাগ। ১৯৭০ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন ইসরায়েলের জনপ্রিয় ব্যক্তি মাইক হারারি। টার্গেটের সব তথ্য নিতে এবং তাঁর ওপর নজর রাখতে সিজারিয়া বিভাগ আরব ও মধ্যপ্রাচ্যে তার বিশাল গুপ্তচর নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। মোসাদের সিজারিয়া বিভাগের একটি ইউনিট হলো কিডন। এই ইউনিটটিই মূলত গুপ্তচরবৃত্তির কাজ করে। এতে নিয়োগ পায় ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনীর সৈনিকেরা। অসম্ভব গোপনীয়তা রক্ষা করা হয় এই ইউনিটে। আল-জাজিরার ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণা করা হচ্ছে, কিডন বাহিনীর সদস্যরাই ফাদি আল-বাতশের হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়।

ইসরায়েল অতীতেও হামাসের সদস্যদের বিদেশের মাটিতে হত্যা করেছে বলে অভিযোগ আছে। হামাস অভিযোগ করে, ২০১৬ সালে তাদের একজন ড্রোন বিশেষজ্ঞ এবং তিউনিসিয়ার নাগরিক মোহাম্মদ জাওয়ারিকে গাড়িতে বসা অবস্থায় গুলি করে হত্যার ঘটনার পেছনে ছিল মোসাদ। এ ছাড়া দুবাইয়ে একটি হোটেলে হামাস সদস্য মাহমুদ আল-মাবহার মৃত্যুর ঘটনার পেছনেও মোসাদের হাত ছিল। ১৯৯৭ সালে জর্ডানে মোসাদের গুপ্তচরেরা হামাস নেতা খালিদ মিশালের কানের ভেতর বিষ ছিটিয়ে দিয়ে হত্যার এক ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। ইসরায়েল বা মোসাদ কখনোই এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটাই করেনি।

বার্গম্যান বলেন, ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত বা প্রথম ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েল ৫০০ গোপন অপারেশন চালায় যেসব অপারেশনে নিহত হয় এক হাজারেও বেশি মানুষ। ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন ইন্তিফাদা শুরু হয়েছিল ১৯৮০ সালের দিকে। মূলত আশির দশকের শেষ দিকে এবং নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে পশ্চিম তীর এবং গাজা এলাকায় ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে প্রথম ইন্তিফাদা শুরু হয়। পরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সময় ইসরায়েল প্রায় এক হাজার গুপ্ত অপারেশন চালায়। তার মধ্যে ১৬৮টি সফল হয়।

আল-জাজিরা, এএফপি ও বিবিসি অনলাইন অবলম্বনে শাকিলা হক