Thank you for trying Sticky AMP!!

‘তুমি স্ত্রী, মেরে ফেললেও তোমার বিচ্ছেদের অধিকার নেই’

নারী নির্যাতন

স্বামীর অত্যাচার সইতে সইতে অনেক আগেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল বানুর (ছদ্মনাম)। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস করতে পারেননি তিনি। এই বন্ধন তখন তাঁর গলার কাঁটা। গিলতেও পারেন না, বেরও করতে পারেন না। এ নিয়ে নিজের মনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই চলতে থাকে তাঁর। একপর্যায়ে ভাবেন, এর চেয়ে আর কী খারাপ হতে পারে তাঁর জীবনে! গত বছর একদিন সাহস করে আদালতে গিয়ে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন তিনি।

আফগানিস্তানের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে ৩২ বছরের এই নারী আল–জাজিরাকে বলেন, ‘চার বছর ধরে প্রতিদিন সে আমাকে মারধর করত ও প্রতি রাতে ধর্ষণ করত। বাধা দিলে আরও বেশি মারত। আমাদের সন্তান না হওয়ার জন্যও আমাকেই দায়ী করত।প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত ও অপমানিত করত। চিকিৎসক জানাল, সমস্যা তার (স্বামী), এ জন্য তাকে চিকিৎসা নিতে হবে। বাড়ি ফিরে সে আমাকে বন্ধ্যা বলে গালি দিয়ে লাথি কষে।’

বানুর এই মামলা এখন তাখার প্রদেশে শুনানির অপেক্ষায় আছে। অথচ মামলার শুরুতে যে বিচারক ছিলেন, তিনি এখন নেই। কারণ, এরই মধ্যে তালেবান ক্ষমতা দখল করে নিয়ে নতুন সরকার গঠন করেছে।

বানু বলেন, ‘বিচারকেরা চলে গেছেন, আইনজীবীরাও নেই। এখন তালেবানের সহযোগিতা নিয়ে আমার স্বামী তার বাড়িতে ফিরে যেতে চাপ দিচ্ছে। আর না করলে আমার পরিবারকে হত্যা করার হুমকি দিচ্ছে।’

ক্ষমতায় এসেই তালেবান বিদ্যমান বিচারব্যবস্থা ভেঙে দেয়। তাদের নিজস্ব বিচারক নিয়োগ করে এবং ইসলামি আইনের নিজস্ব ধরন প্রয়োগ করে।

আমরা এখন পর্যন্ত তাঁদের (নারী বিচারক) প্রয়োজন অনুভব করছি না। তাই তাঁদের ফিরে আসার প্রয়োজনীয়তাও বুঝতে পারছি না
—হিজবুল্লাহ ইব্রাহিমি, তালেবান সুপ্রিম কোর্টের গবেষণা ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধান

মারজিয়া নামের এক নারী বিচারপতি, যিনি এখন পলাতক, বলেন, মামলা পরিচালনা করার মতো কোনো নারী আইনজীবী নেই। আর নারী বিচারপতিদের কাজে ফেরার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না।

তালেবানের পক্ষপাত

আফগানিস্তানে ৩০০ জনের বেশি নারী বিচারক ছিলেন। তাঁরা নারীদের সমস্যা থেকে শুরু করে ফৌজদারি এবং সন্ত্রাস-সম্পর্কিত মামলার সবই বিচার করতেন। এখন কয়েক শ বিচারক অন্য দেশে পালিয়ে গেছেন এবং প্রায় ৭০ জন নারী বিচারক আত্মগোপনে রয়েছেন।

মারজিয়া বলেন, ‘তাদের (তালেবান) বিশ্বাস, আমরা (নারী আইনজীবী এবং বিচারক) অযোগ্য এবং এ ক্ষেত্রে কাজ করার জন্য আমাদের ইসলামিক আইন সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান নেই।’

গত সেপ্টেম্বরে তালেবান একটি সংবাদ সম্মেলনে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে। তারা সেখানে নারী বিচারকের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে জানায়। সেখানে তালেবান সুপ্রিম কোর্টের গবেষণা ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের প্রধান হিজবুল্লাহ ইব্রাহিমি উপস্থিত ছিলেন।

আফগানিস্তানে ৩০০ জনের বেশি নারী বিচারক ছিলেন। এখন কয়েক শ বিচারক অন্য দেশে পালিয়ে গেছেন এবং প্রায় ৭০ জন নারী বিচারক আত্মগোপনে রয়েছেন।

হিজবুল্লাহ ইব্রাহিমি বলেছিলেন, আগের ব্যবস্থায়, নারী বিচারকেরা নির্দিষ্ট আইন ও বিলের ভিত্তিতে মামলার রায় দিতেন। আইনশাস্ত্র এবং শরিয়া নীতি সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল না। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত তাঁদের (নারী বিচারক) প্রয়োজন অনুভব করছি না। তাই তাঁদের ফিরে আসার প্রয়োজনীয়তাও বুঝতে পারছি না।’

মারজিয়া মনে করেন, তালেবান নারীদের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে। তারা ইসলামে নারীকে তালাকসহ যেসব অধিকার দিয়েছে, তা প্রদানেও ব্যর্থ।

সাবেক এই বিচারক বলেন, ‘বিচার বিভাগে নারী না থাকলে, নারী ভুক্তভোগীরা আদালত থেকে দাপ্তরিক সাহায্য ও ত্রাণ চাইতে পারেন না। এটা শুধু নারীর অধিকারের জন্যই নয়, সামগ্রিকভাবে মানবাধিকারের জন্য একটি বড় ক্ষতি। দেশের একটি উল্লেখযোগ্য জনগোষ্ঠী আইনি সহায়তা পাওয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।’

তবে বিচারবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল হামিদ জাহাদইয়ার আল-জাজিরাকে বলেন, গত বছর বিবাহবিচ্ছেদ ও পারিবারিক সহিংসতার মামলার শুনানি হয়েছে। শুধু কাবুলেই ৩৪১টি বিবাহবিচ্ছেদের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে কতটি বিচ্ছেদ হয়েছে, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য তিনি দেননি।

আবদুল হামিদ বলেন, ‘যে নারী বিবাহবিচ্ছেদ করতে চায়, তিনি চাইলে একজন পুরুষ আইনজীবী নিতে পারেন। বিচ্ছেদের মামলাগুলোতে প্রথম আমরা দুই পক্ষের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে মিটমাট করতে চাই।’

ব্যাপক বৈষম্য

আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ তালেবানের হাতে আসার পর তারা জানিয়েছিল, দেশটিতে নারীদের অধিকার রক্ষা করা হবে। তবে ওই প্রতিশ্রুতি থেকে তারা দূরে সরে গিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা উইমেন ফর আফগান উইমেন-এর উপনির্বাহী পরিচালক কেভিন শুমাখার বলেন, আফগানিস্তানের বিচারব্যবস্থায় নারীর অনুপস্থিতি দেশটির বিচারব্যবস্থায় একটি বড় ধরনের ব্যবধান তৈরি করেছে।  
তালেবান ক্ষমতা দখল করার আগে সংস্থাটি পারিবারিক আইনি সহায়তা প্রদান এবং নির্যাতনের হাত থেকে পালিয়ে আসা নারী ও শিশুদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করত। পাশাপাশি মনঃসামাজিক পরামর্শ দিত।

শুমাখার বলেন, ‘আমরা কাউন্সেলিং, মধ্যস্থতা, পারিবারিক দিকনির্দেশনা এবং আইনি সহায়তাসহ নিরাপদ আশ্রয় দিয়ে আসছিলাম। পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের জন্য আমাদের যে আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ছিল, সেগুলো জোর করে বন্ধ করার ফলে শত শত নারী আইনি এবং সামাজিক অচলাবস্থায় পড়েছে।’

এখানকার অনেক নারীরই এখন ঘরে ফেরা ছাড়া উপায় নেই। তাঁদের এমন একটি সমাজে ফিরতে হবে, যেখানে তাঁদের জন্য কোনো সামাজিক সমর্থনের নেটওয়ার্ক নেই এবং তাঁদের মামলা লড়তে সাহায্য করার জন্য কোনো উকিল নেই।

যদিও তালেবান ক্ষমতা দখল করার আগেও আফগান নারীদের অবস্থান ঠিক ঠিক ছিল, এমন নয়। তবে শুমাখার এবং মারজিয়া যুক্তি দিয়ে বলেন, এখন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে।

শুমাখার বলেন, তালেবান সরকার ইসলামিক নিয়ম মেনে চলতে চায়, কিন্তু তারা এ আইনগুলোকে বিধিবদ্ধ করে না। এর ফলে কেউ নিশ্চিতভাবে জানে না কীভাবে বিচার চাওয়া বা বাস্তবায়ন করতে হবে। বিচারিক পদ্ধতির ঘাটতির সঙ্গে এখানে নানা অসংগতিও রয়েছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি  পড়েছে নারীদের ওপর। ন্যায়বিচারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে নারীদের।

Also Read: আফগান নারীদের নিয়ে বিশ্বকে সরব হওয়ার ডাক মালালার

কালিমা

মারজিয়া নিজের কর্মজীবনে বেশ কয়েকটি বিবাহবিচ্ছেদের মামলা শুনানি করেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, আফগানিস্তানে একজন নারীর জন্য বিবাহবিচ্ছেদ চাওয়া বরাবরাই চ্যালেঞ্জের। এটিকে নারীদের জন্য কলঙ্কও মনে করা হয়। আর এর কারণ হলো নারীদের মধ্যে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এবং পুলিশ ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে সহানুভূতির অভাব। এসবের পরও কিছু প্রতিষ্ঠান এবং পদ্ধতির কারণে কিছু সুরক্ষা ছিল, যার কারণে নারীরা অন্তত আবেদনটুকু করতে পারত। এখন সেসব সুযোগও নেই।

এখানকার অনেক নারীরই এখন ঘরে ফেরা ছাড়া উপায় নেই। তাঁদের এমন একটি সমাজে ফিরতে হবে, যেখানে তাঁদের জন্য কোনো সামাজিক সমর্থনের নেটওয়ার্ক নেই এবং তাঁদের মামলা লড়তে সাহায্য করার জন্য কোনো উকিল নেই।

সাবেক এই বিচারক বলেন, তিনি শুনেছেন গত বছর তালেবান কোনো নারীকে বিচ্ছেদের অনুমতি দেননি। কারণ তারা মনে করে নারীদের এই অধিকার নেই। এসব নারীকে জোর করে সেই নির্যাতনকারী স্বামীর কাছে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এই নারীরা কেন আদালতে গেল, এর জন্য এখন আরও বেশি নির্যাতনের শিকার হবে।
স্বামীর নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে বানু তালেবান আদালতের সামনে হাজির হলে তাঁকেও একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

টেলিফোনে বানু বলেন, ‘প্রায় দুই মাস আগে, সে আফিম খেয়ে বাড়িতে এসে আমাকে বেশ মারধর করেছিল। আমি চিৎকার করলে সে রান্নাঘরে গিয়ে একটা ছুরি গরম করে আমার বুকে ছ্যাকা দিয়েছিল। এরপর আমাকে শোয়ার ঘরে তালা দিয়ে চলে গেল। ব্যাথা ও জ্বালাপোড়ায় আমি খুব চিৎকার করছিলাম। প্রতিবেশীরা তা শুনতে পেয়ে ঘরের তালা ভেঙে আমাকে ক্লিনিকে নিয়ে যায়।’

Also Read: যেভাবে জীবনটা বন্দী হলো আফগান নারীদের

ফিরে আসার পরও তাঁর প্রতি নির্যাতন কমেনি। নির্যাতন ভিন্ন মাত্রায় রুপ নিল। বানু বলেন,  ‘দুই সপ্তাহ পর আমার জখম তখনো পুরোপুরি সারেনি, সে ওই সময় একটি  বন্য কুকুর নিয়ে আসে। এরপর সে আমাকে বেঁধে মাটিতে ফেলে দেয়, তখন কুকুরটি আমার সারা গায়ে আঁচড় কাটতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে সে হাসছিল আর বলছিল, “আমার বিরুদ্ধে আর মামলা করবি?’’’

বানু সেই রাতটা যন্ত্রণায় ছটফট করছিল আর বারবার স্বামীকে অনুরোধ করছিল যেন তাঁকে সকালে ক্লিনিকে যেতে দেয়। একপর্যায়ে তাঁর স্বামী রাজি হলে তিনি সেই সুযোগে বাড়ি ছাড়েন। পাশের প্রদেশে থাকা ভাইয়ের বাড়ির উদ্দেশে বাসে উঠে বসেছিলেন। বানু বলেন, ‘সেখানে যাওয়ার পর তারা আমার অবস্থা দেখে হতবাক হয়ে পড়েন। আমার মা মাথা ঘুরে পড়ে যান।’ পরে এক ইমামের পরামর্শে তারা তালেবান আদালতে বিষয়টি জানান।

বানু বলেন, ‘আমি তালেবান বিচারকের কাছে গিয়েছিলাম আমার মুখ ও শরীরের ক্ষত দেখাতে। আমরা ভেবেছিলাম আমার স্বামীর নিষ্ঠুরতার লক্ষণ দেখার পরে, তারা আমাকে সুরক্ষা দিতে পারে। কিন্তু উল্টো একজন তালেবান সদস্য আমাকে গালি দিল। আমার মুখ দেখানোর জন্য আমাকে অভিশাপ দিল। আমরা যখন তাদের বললাম যে আদালতে (তালেবান পূর্ববর্তী) বিবাহবিচ্ছেদের জন্য আবেদন করেছি, তখন তারা ‘কাফের আদালতে’ মামলা দায়ের করার জন্য আমার ভাই এবং আমাকে বন্দুকের বাট দিয়ে মারধর করে।’ তারা জানাল তাদের আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মতো কিছু নেই। ‘বিচারক বললেন, তোমার সঙ্গে তোমার স্বামী যেভাবে চায় সেভাবে আচরণ করতে পারে। কারণ তুমি তাঁর স্ত্রী। তোমাকে যদি মেরেও ফেলেও তবু তোমার বিচ্ছেদ পাওয়ার কোনো অধিকার নেই।’

তালেবান তাঁকে আটকে স্বামীর কাছে তুলে দেওয়ার হুমকি দেয়। কিন্তু  তারা তা করার আগেই বানু ও তাঁর ভাই ইমামের সহায়তায় সেই প্রদেশ ছেড়ে পালান। এখন তারা আত্মগোপনে আছেন।

বানু বলেন, ‘আগের আদালতে অল্প সময়ের জন্য হলেও আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে আমার মতো নারীদের জন্য একজন নারী আইনজীবী পাওয়া, নারী বিচারকের সামনে বিষয়টি উপস্থাপন করা ও বিবাহ বিচ্ছেদের অনুমতি পাওয়া যা আমার ইসলামিক অধিকার, তা অনেক সহজ ছিল। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় থাকায়, আবারও নারীদের জীবন দোজখে পরিণত হয়েছে।’