Thank you for trying Sticky AMP!!

রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানো হয়েছে

মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ, গণহত্যার বিচার হবে

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গাম্বিয়া যে মামলা করেছে, সে বিষয়ে নেপিডোর আপত্তি নাকচ করে দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)। দ্য হেগে শুক্রবার বিকেলে ঘোষিত এ রায়ের ফলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানির পথ খুলে গেল। গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলার শুনানি প্রশ্নে মিয়ানমারের সামরিক সরকার আপত্তি জানিয়েছিল।

১৬ সদস্যের আদালত ১৫-১ ভোটে গাম্বিয়ার দায়ের করা গণহত্যার মামলা বিচারের জন্য গ্রহণ করেছেন। ভিন্নমত পোষণকারী হলেন চীনের বিচারপতি শোয়ে হানচিন। বিচারপতি শোয়ে মামলা দায়ের করার সময় গাম্বিয়া ও মিয়ানমারের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল কি না, সে প্রশ্নেও আদালতের অপর ১৫ জন বিচারপতির সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। আদালতের প্রেসিডেন্ট জোয়ান ডনাহিউ রায় পড়ে শোনান।

গত ২১ ফেব্রুয়ারি মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তির ওপর শুনানি শুরু হয়। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার দিন বিষয়টির ওপর আদালত উভয় পক্ষের যুক্তি ও পাল্টাযুক্তি শোনেন। আদালতে মিয়ানমারের প্রাথমিক আপত্তির শুনানিতে দেশটির প্রতিনিধিত্ব করেন আন্তর্জাতিক সহযোগিতাবিষয়ক মন্ত্রী কো কো হ্ল্যাং। এর আগে একই আদালত গাম্বিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করেছিলেন।


শুক্রবার আদালতের দেওয়া রায়কে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বিচার আদালত মিয়ানমারের প্রাথমিক চার আপত্তিই নাকচ করে দিয়েছেন। বাংলাদেশ মনে করে, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধান বের করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেন পিয়ারসন এক বিবৃতিতে বলেন, আইসিজের সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার হত্যার অভিযানের বিষয়ে জবাবদিহির পথ খুলে দিয়েছে।

মিয়ানমারের চার আপত্তিই নাকচ

মিয়ানমারের উত্থাপন করা প্রাথমিক আপত্তি ছিল চারটি বিষয়ে এবং আদালত সব কটিই প্রত্যাখ্যান করেছেন। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণের কারণে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ যেখানে আইসিজেতে মামলা করেনি, সেখানে গাম্বিয়া ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ না হয়েও মামলা করার অধিকার রাখে না বলে মিয়ানমার যে আপত্তি জানিয়েছিল, তা আদালত খারিজ করে দিয়েছেন। আদালত বাংলাদেশে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার আশ্রয় নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, এ ঘটনা গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী অন্য কোনো দেশের গণহত্যা প্রতিকারের সামগ্রিক স্বার্থে মামলা করার অধিকার ক্ষুণ্ন করে না। সনদের ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলাদেশের আপত্তি–সম্পর্কিত যুক্তি এখানে বিচার্য নয়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় রোহিঙ্গাদেরে বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়


গাম্বিয়া ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্রতিভূ হিসেবে মামলা করেছে বলে এটি গ্রহণের এখতিয়ার আদালতের নেই বলে মিয়ানমার যে আপত্তি জানিয়েছিল, সে বিষয়ে আদালত বলেন, তাঁদের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যে গাম্বিয়া নিজের সিদ্ধান্তেই মামলা করেছে। গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী হিসেবে দায়িত্ববোধ থেকে গণহত্যা প্রতিরোধে গাম্বিয়া আদালতের আশ্রয় নিয়েছে। ওআইসির সহায়তা নেওয়ার প্রশ্নে আদালত বলেন যে মামলা করার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার কাছ থেকে আর্থিক বা রাজনৈতিক সহায়তা নেওয়ার অধিকার গাম্বিয়ার রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে আবেদন করার সময় দুই পক্ষের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না বলে মামলাটি আদালত গ্রহণ করতে পারেন না বলে মিয়ানমার যে আপত্তি জানিয়েছিল, আদালত তা-ও প্রত্যাখ্যান করেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নির্মূলের লক্ষ্যে অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে গণহত্যা সনদের লঙ্ঘন ঘটছে এবং তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা গাম্বিয়া ২০১৮ ও ২০১৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বলেছে। মিয়ানমারও তার বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছে। এসব উল্লেখ করে আদালত বলেন, এসব বিবৃতিতে স্পষ্ট বিরোধ প্রতীয়মান হয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের তথ্য অনুসন্ধানকারী দলের দুটি রিপোর্ট সাধারণ পরিষদে উত্থাপনের পর গাম্বিয়া ওই প্রতিবেদনের আলোকে গণহত্যার অভিযোগ এনেছে, কিন্তু মিয়ানমার প্রতিবেদনগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। গাম্বিয়া মামলা করার আগে কূটনৈতিক চিঠি (নোট ভারবাল) দিয়ে মিয়ানমারকে গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণের অনুরোধ জানিয়েছে এবং এক মাস অপেক্ষা করার পরও মিয়ানমার তার কোনো জবাব দেয়নি। রায়ে বলা হয়, এসব কিছু প্রমাণ করে আদালতের আশ্রয় নেওয়ার সময় বিরোধ বিদ্যমান ছিল, তাই মিয়ানমারের আপত্তি প্রত্যাখ্যান করা হলো।

Also Read: মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতাকে গণহত্যার স্বীকৃতি দিল যুক্তরাষ্ট্র

মিয়ানমার গণহত্যা সনদের অনুচ্ছেদ ৯ অনুসমর্থন করেনি বলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আনা আবেদন বিচারের এখতিয়ার আন্তর্জাতিক আদালতের নেই বলে দেশটি যে আপত্তি জানিয়েছিল, আদালত তাঁর রায়ে বলেছেন, আদালতের এখতিয়ার প্রশ্নে সনদের কোনো একটি অনুচ্ছেদ সমর্থন না করার কোনো প্রভাব নেই। আদালত তাই এখতিয়ার প্রসঙ্গে মিয়ানমারের আপত্তি প্রত্যাখ্যান করেন।

রায়ের প্রেক্ষাপট

গাম্বিয়া ২০১৯ সালের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দেওয়ার নির্দেশনা চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিল। সে সময় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি অন্তর্বর্তী আদেশ চাইলে আদালত পূর্ণ শুনানির পর ২০২০ সালের ২৩ জানুয়ারি সংখ্যালঘু হিসেবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে গণহত্যার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য মিয়ানমারের প্রতি একটি অন্তর্বর্তী আদেশ জারি করেছিলেন। ওই শুনানিতেও আদালতের এখতিয়ার এবং গাম্বিয়ার মামলা করার অধিকারের প্রশ্নে মিয়ানমার আপত্তি জানিয়েছিল এবং আদালত সেগুলো নিষ্পত্তি করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী আদেশ দেন।

গণহত্যার বিষয়ে মূল মামলার বিষয়ে আদালত গাম্বিয়াকে ২০২০ সালের ২৩ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের লিখিত আরজি পেশ করার নির্দেশ দেন। আদালত মিয়ানমারকে তার জবাব দেওয়ার জন্য সময় দেন ২০২১ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। করোনা মহামারির কারণে গাম্বিয়া অতিরিক্ত সময় প্রার্থনা করলে তাদের ২০২০ সালের ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এবং মিয়ানমারকে তার জবাবের জন্য ২০২১ সালের ২৩ জুলাই পর্যন্ত সময় বাড়িয়ে দেন আদালত। গাম্বিয়া তার আরজি ২০২০ সালের ২৩ অক্টোবরের মধ্যে পেশ করলেও মিয়ানমার ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি তাদের প্রাথমিক আপত্তির আবেদন জানায়। ওই বছরের ডিসেম্বরে আদালত প্রাথমিক আপত্তির ওপর শুনানির তারিখ নির্ধারণ করলেও মিয়ানমার করোনা মহামারির কারণে তা পিছিয়ে দেওয়ার আবেদন জানায়। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে আপত্তির ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইনে সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধন, নৃশংস দমন-পীড়ন, জ্বালাও-পোড়াওয়ের মুখে লাখো রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ওই বছরের ২৫ আগস্ট থেকে কয়েক মাসে বাংলাদেশে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে। এর আগে থেকে লাখ চারেক রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছিল বাংলাদেশে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ১২ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে।

Also Read: রোহিঙ্গা গণহত্যায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করেছে গাম্বিয়া

Also Read: গাম্বিয়ার মামলাটি কেন গুরুত্বপূর্ণ