করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনবাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo.com
করোনার খবর, বড় বড় দেশের গৃহবিবাদ, বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিশ্বমন্দা—এসবের পাশাপাশি আমার চোখ চলে যায় রেসিপিতে। পছন্দ হলে সেদিনের পাতা ছিঁড়ে রেখে দিই। ফলে আমার ফোল্ডারও স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠতে লাগল। আমার নজর অল্প উপকরণে, স্বল্প সময়ে, সহজে কী করা যায় তার দিকে। সম্পাদকদেরও যেন লক্ষ্য, কীভাবে স্বল্প আয়োজনে ডিনার তৈরি করা যায়।
কিছুদিন আগেও নিউইয়র্ক টাইমস-এর আন্তর্জাতিক সংস্করণের শেষ পাতায় অনেক সময় ভ্রমণ বিষয়ে লেখা থাকত। খুব প্রিয় ছিল সেসব লেখা। মার্চের শেষ দিকে দেখলাম, ভ্রমণকাহিনির বদলে থাকছে ঘরে কী কী করা যায়, তা নিয়ে লেখা। পাতার শিরোনাম লিভিং। তত দিনে করোনার তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীতে। বেড়ানো দূরের কথা, বাইরে যাওয়ারই সুযোগ নেই। ভ্রমণ নিয়ে দু-একটি লেখা এরপরও যে ছাপা হয়নি, তা নয়। তবে পরিস্থিতির সঙ্গে ঠিক মানাচ্ছিল না, বরং ভালো যাচ্ছিল ঘরে থেকে কী কী করা যায়, সে ধরনের লেখাই। আর তার মধ্যে মূলত ছিল রান্না। কোনো দিন পুরো সপ্তাহের জন্য পাঁচটি পদ, কোনো দিন একটি বা দুটি।
আমি যে রান্না একেবারে পারি না, তা নয়। তবে আমার রান্না মূলত ঘরোয়া, আটপৌরে ধরনের। মায়ের হাতের যেসব রান্নার স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে, তারই দু-একটা স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে তৈরি করার চেষ্টা। তবে রান্নাঘরে ঢোকার জন্য সুযোগের অপেক্ষা করতে হয়। কারণ, সেটা থাকে আমার স্ত্রীর দখলে।
করোনার করুণায় আমরা ঘরবন্দী। নেই ডিনারের নেমন্তন্ন বা রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়া। সুতরাং নিজের খাবার নিজে রেঁধে নিজেই খাও। স্ত্রীর রেসিপির ফোল্ডারের ব্যবহার হতে থাকল নিয়মিত। আমার ভান্ডারে তো বেশি কিছু নেই। তাই নজর দিলাম নিউইয়র্ক টাইমস-এর শেষের পাতায়।
করোনার খবর, বড় বড় দেশের গৃহবিবাদ, বিভিন্ন দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব, বিশ্বমন্দা—এসবের পাশাপাশি আমার চোখ চলে যায় রেসিপিতে। পছন্দ হলে সেদিনের পাতা ছিঁড়ে রেখে দিই। ফলে আমার ফোল্ডারও স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠতে লাগল। আমার নজর অল্প উপকরণে, স্বল্প সময়ে, সহজে কী করা যায় তার দিকে। সম্পাদকদেরও যেন লক্ষ্য, কীভাবে স্বল্প আয়োজনে ডিনার তৈরি করা যায়।
একটি আইটেম ছিল শ্রিম্প স্ক্যাম্পি। সরল বাংলায় চিংড়ি মাছের পদ। রান্না করতে চাই রসুন, আদা, লেবুর রস আর হোয়াইট ওয়াইন। হোয়াইট ওয়াইনের বদলে আমি ব্যবহার করলাম ভেজিটেবল স্টক। কেবলই মাছের ঝোলে আর কত দিন আটকে থাকব। তাই গ্রিল্ড ফিশ হলো আমার পরের আইটেম। শিখলাম কীভাবে আদা আর লেবুর রস দিয়ে মাছ ম্যারিনেড করতে হয়, আর কীভাবে বানাতে হয় গ্রিল করা মাছের সঙ্গে দেওয়ার জন্য হোয়াইট সস। জুকিনি, মিষ্টি আলু আর বেগুন ফালি করে স্কিলেটে গ্রিল করে ফেললাম। সঙ্গে ভেজিটেবল স্যুপ। সম্পূর্ণ খাবার তৈরি করার পর তার আনন্দই আলাদা।
যৌথ প্রচেষ্টাতেও আনন্দ প্রচুর। কোনো দিন বৃষ্টি নামলে স্ত্রী বানিয়ে ফেলল খিচুড়ি। তার সঙ্গে আমি করলাম সেদ্ধ ডিম আর আলু দিয়ে ঝোল।
দেখতে দেখতে এসে গেল স্ত্রীর জন্মদিন। একটু সাহসী হয়ে ঠিক করলাম বিরিয়ানি রাঁধব। বানিয়ে ফেললাম চিকেন বিরিয়ানি। সঙ্গে ডিমের দোপেঁয়াজি। আমার স্ত্রীও অবশ্য চোখ রাখছিল। ওকেই তো খেতে হবে। এই বিশেষ দিনে বার্সেলোনা, মারাকেশ বা নিজের শহর জেনেভার কোনো রেস্তোরাঁয় নয়। বাড়িতেই মুখোমুখি বসে খাওয়া।
চলে এল ঈদ। সকালে ঘরেই নামাজ আদায়। এর আগেই আমার স্ত্রী অভ্যাসমতো তৈরি করে ফেলল সেমাই, জর্দা ইত্যাদি। আমি পেলাম পোলাও আর মুরগির দোপেঁয়াজি রান্নার দায়িত্ব। ও করল মাটন রেজালা আর কাবাব।
ঈদের পর প্রায় সবকিছুই খোলার অনুমতি দেওয়া হলো। তবু পুরোনো অভ্যাসে ফিরে যেতে আমাদের দ্বিধা। স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ যেন ফিরে আসছে না। ক্যালেন্ডারের তারিখ বদলাতে বদলাতে এসে গেল আমার জন্মদিন।
স্ত্রীর চেষ্টা ছিল এই অন্য রকম সময়েও জন্মদিনে আমার প্রিয় জিনিসগুলো হাজির করতে। বেকারি থেকে এসেও গেল সেসব। লাঞ্চের জন্য সাজানো হলো চার কোর্সের থাই মেন্যু। তোম ইয়াম কুং আর স্প্রিং রোল থেকে শুরু করে চিকেন গ্রিন কারি আর প্রনের সঙ্গে বিভিন্ন সবজি মিশিয়ে একটি পদ। আবহাওয়া অনুকূল থাকায় আমাদের ছোট্ট ব্যালকনিতে ওর নিজের সাজানো বাগানে বসে সেই খাবারের উপভোগ চলল। আমার প্রিয় স্ট্রবেরি টার্ট এনে তাতে মোমবাতি জ্বালিয়ে জন্মদিনের গান শোনাতেও সে ভুলল না।
করোনা আমাদের অনেক কিছু করতে দিচ্ছে না ঠিকই, কিন্তু তার আক্রমণ থেকে বেঁচে থেকে জীবনকে তো আনন্দময় করে রাখতেই হবে।
রিজওয়ানুল ইসলাম: সাবেক বিশেষ উপদেষ্টা, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, জেনেভা