Thank you for trying Sticky AMP!!

রুশ-তালেবান বন্ধুত্ব?

তালেবান জঙ্গিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নতুন খেলা খেলবে রাশিয়া? ছবি: রয়টার্স

একটি হলো দেশ, অন্যটি জঙ্গি সংগঠন। একে অন্যের প্রতিপক্ষ। যেন দা-মাছ। একসময় একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এখন তারাই কিনা জোট বেঁধেছে? হাতে হাত মিলিয়েছে? একজন আরেকজনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে? কাকে ঘায়েল করতে এমন মিত্রতা?

আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গি আর রাশিয়ার সম্পর্ক নিয়ে অভিযোগ তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। অভিযোগ গুরুতর। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, তারা এখন বন্ধু। চমকের শুরু এখানেই। উঠেছে অনেক প্রশ্ন।

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মদদে যুদ্ধে নেমেছিল আফগান মুজাহিদরা। তাদের বেশির ভাগই পরে তালেবান জঙ্গি হয়। শুরুতে রাশিয়ার সঙ্গে মুখ দেখাদেখিও ছিল বন্ধ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, তাজিক সীমান্ত দিয়ে তালেবান জঙ্গিদের এখন অস্ত্র সরবরাহ করছে রাশিয়া।

তালেবান জঙ্গিরা রীতিমতো প্রশিক্ষিত। তাদের ছোড়া অস্ত্রের পাল্টা জবাব দিতে অনেক সময় হিমশিম খেতে হয় সামরিক বাহিনীকে। মার্কিন সামরিক বাহিনীকেও ঘায়েল করেছিল তারা। কারা কোথা থেকে রসদ জোগায় তালেবান জঙ্গিদের? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অনেক দিন থেকেই। কখনো বলা হয়েছে পাকিস্তান তাদের মদদ দিচ্ছে। ইরানের নামও এসেছে কয়েকবার। সেই তালিকায় এবার যুক্ত হলো রাশিয়া।

পশ্চিমা বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে তালেবানের বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে ক্ষমতাচ্যুত করার পরই তালেবানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক গড়ার সুযোগ তৈরি হয়। ১০ বছর আগে থেকে মস্কো ও তালেবান জঙ্গিদের মধ্যে যোগাযোগের শুরু। এসব সূত্র আরও বলছে, গত তিন বছরে মস্কোর সঙ্গে তালেবান জঙ্গিদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। বিশেষ করে ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে জঙ্গি দল ‘আইএস খোরাসান’ গড়ে ওঠার পরে সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়।

এসব সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে তালেবানের কয়েকটি সূত্রের বরাত দিয়ে আরও বলা হয়েছে, তালেবান প্রতিনিধিরা রাশিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছেন। রাশিয়া ছাড়া অন্য দেশগুলোতেও তাদের মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। তালেবানরা আশা করছে, রাশিয়ার কাছ থেকে তারা অত্যাধুনিক অস্ত্র পাবে। সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র যেমন অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়েছে, তেমন অস্ত্রই চায় তালেবান জঙ্গিরা। তালেবান ইরান ও চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। রাশিয়াকে পাশে পেলে কূটনৈতিক সম্পর্ক নতুন মাত্রা পাবে।

যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের হামলার পর তালেবানদের সঙ্গে রাশিয়ার নতুন যোগাযোগ হয় বলেও ধারণা প্রচলিত রয়েছে। এই সময়ের পরে মস্কোর নীতিনির্ধারকেরা আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিদের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন। মস্কো এমনও বলেছে, আফগানিস্তানে তালেবানদের ছোট করে দেখার উপায় নেই।

তালেবানদের প্রতি রাশিয়ার ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পায় ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। আফগানিস্তানে নিযুক্ত পুতিনের বিশেষ দূত জামির কাবুলভ এমনও বলেন, আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সেনাদের অপসারণের বিষয়টি খুবই যৌক্তিক। তিনি আফগানিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর উপস্থিতির সমালোচনাও করেন।

পেছনের দিকে তাকালে রাশিয়ার সঙ্গে তালেবানদের সম্পর্ক উন্নয়নের ধারাটি কিছুটা বোঝা যায়। বিবিসির খবরে এমন তিনটি কারণ তুলে ধরা হয়েছে। প্রথমত, আফগানিস্তানে তালেবানরা ২০১৩ ও ২০১৬ সালে রাশিয়ার দুজন নাগরিককে অপহরণ করে। দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার পর দুজন রুশ নাগরিককে মুক্তিও দেয় তালেবানরা।

দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে আইএস জঙ্গিদের উত্থানে মস্কো কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। মস্কোর আশঙ্কা, আইএস জঙ্গিরা এশিয়ার মধ্যাঞ্চলে ও রাশিয়ায় ছড়িয়ে যেতে পারে। এ কারণে রাশিয়া তালেবানদের দিকে ঝুঁকে। এর সুযোগ নিয়েছে তালেবানরাও। আইএস জঙ্গিরা আফগানিস্তানেই থাকবে বলে তারা প্রতিবেশী দেশগুলোকে আশ্বস্ত করেছে।

তৃতীয়ত, আইএস ঠেকাতে তালেবান জঙ্গিদের একধরনের ঢাল হিসেবেও ব্যবহার করতে চেয়েছে রাশিয়া। ২০১৫ সালে আফগানিস্তানে নিযুক্ত রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জামির কাবুলভ ঘোষণা দেন, ‘তালেবান জঙ্গিদের উদ্দেশ্য আর আমাদের উদ্দেশ্য একই। আমরা আইএস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই।’

তালেবান জঙ্গি। ছবি: রয়টার্স

এত কিছুর পরও এটা জোর দিয়ে বলার উপায় নেই যে রাশিয়া আর তালেবান জঙ্গিদের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন রয়েছে রাশিয়া বা তালেবান জঙ্গিদের স্বার্থসিদ্ধির বিষয় নিয়েও।

গত মার্চ মাসে একটি সাক্ষাৎকারে আফগানিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন কমান্ডার জেনারেল জন নিকোলসন অভিযোগ করেন, তাজিকিস্তানের সীমান্ত এলাকা দিয়ে চোরাচালানের মাধ্যমে রাশিয়া তালেবানদের অস্ত্র দিচ্ছে। মার্কিন কর্মকর্তারা এসব অস্ত্র পেন্টাগনেও এনেছেন। নিকোলসনের দাবি, রাশিয়ার কাছ থেকে তালেবানরা এসব অস্ত্র পেয়েছে বলে তাঁদের জানিয়েছেন আফগান নেতারা।

নিকোলসনের এই বক্তব্য একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কারণ, তিনি তাঁর পেশাগত জীবনের বেশির ভাগ সময়জুড়ে আফগানিস্তান যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় দায়িত্ব পালন করেছেন।

তবে রাশিয়া ঠিক কী পরিমাণ অস্ত্র তালেবান জঙ্গিদের দিচ্ছে, তার কোনো হিসাব দিতে পারেননি নিকোলসন। আফগানিস্তানের জ্যেষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তারা বলছেন, রাশিয়া মাঝারি ও ভারী বন্দুক, ছোট ছোট অস্ত্র তালেবানদের দিচ্ছে।

নিকোলসনের এই অভিযোগ নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে। প্রথম খটকা হলো, তালেবানদের সাহায্য করার পেছনে রাশিয়ার স্বার্থসিদ্ধির বিষয়টি স্পষ্ট নয়।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তালেবানদের অস্ত্র দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে রাশিয়া। যুক্তি দিয়ে রাশিয়া বলেছে, তালেবান জঙ্গিদের সমর্থন করলে তাদের কোনো রাজনৈতিক লাভের সুযোগ নেই। রাশিয়া বরং পাল্টা অভিযোগ ছুড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। বলছে, তালেবানদের দমনে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই ন্যাটো আর যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার দিকে অভিযোগের তির ছুড়েছে।

রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করা নিয়ে মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যেও দ্বিমত রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস ম্যাটিস গত বছরের অক্টোবর মাসে হাউস আর্মড সার্ভিসেস কমিটিকে বলেন, তালেবান জঙ্গিদের রাশিয়ার সহায়তা করা নিয়ে তিনি আরও প্রমাণ চান। এ পর্যন্ত এই ব্যাপারে তাঁকে যা দেখানো হয়েছে, তা যথেষ্ট নয়।

তালেবানদের রাশিয়ার অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে আফগানিস্তানের কর্মকর্তাদের মধ্যেও। গত বছর আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট আশরাফ ঘানি বলেন, তালেবান জঙ্গিদের অস্ত্রের রসদ জোগাচ্ছে রাশিয়া। তবে একই সময়ে আফগান প্রতিরক্ষামন্ত্রী এই অভিযোগকে গুজব বলে উড়িয়ে দিয়েছে।

ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টোলেনবার্গ গত বছরের জুলাই মাসে বলেন, রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করছে—এ রকম কোনো তথ্যপ্রমাণ তাঁরা পাননি। তাজিকিস্তানও রাশিয়ার অস্ত্র তালেবানদের কাছে পৌঁছানোর কথা অস্বীকার করেছে। জেনারেল নিকোলসনের অভিযোগকে তাঁরা বলেছে ভিত্তিহীন।

আপাতদৃষ্টিতে এটুকু বলা যেতে পারে, একসময়ের শত্রু তালেবান জঙ্গিদের প্রতি রাশিয়া এখন নমনীয়। এমন হতে পারে, আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপ করে মস্কো আসলে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বকে উত্ত্যক্ত করতে চায়। তালেবানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন খেলা খেলতে চায়।