Thank you for trying Sticky AMP!!

সবার ওপরে পুতিন সত্য!

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

অবশেষে তিনি যা চেয়েছিলেন, তা–ই হলো। সংবিধান বদলে গেল। প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় থাকার সময়সীমাসংক্রান্ত বিধিনিষেধ উঠে গেল। এখন আর বছরের পর বছর ধরে সিংহাসনে বসে থাকায় কোনো বাধা রইল না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, রুশ দেশে লেনিন-স্তালিনকে ছাড়িয়ে সবার ওপরে ওঠার মইয়ে দিব্যি চড়ে বসেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন!

সংবিধান বদলের পুরো বিলটি আগেই রাশিয়ার সংসদে পাস হয়ে গিয়েছিল। হয়েছিল প্রেসিডেন্টের অনুমোদনও। বাকি ছিল নিয়মরক্ষার গণভোট। সেটিও হয়ে গেল সম্প্রতি। তাতে প্রায় ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছে পুতিনের সমর্থনে। এতেই সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর রাশিয়ায় প্রণয়ন করা ১৯৯৩ সালের সংবিধান বদলে গেছে। বলা হচ্ছে, অন্তত আগামী ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা পুতিনের জন্য নিশ্চিত। সেই সময়সীমা আমৃত্যুও হতে পারে।

ক্ষমতা বৈধ করতে এই গণভোট অনুষ্ঠান আয়োজনে রীতিমতো মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন পুতিন। বর্তমানে নতুন করোনাভাইরাস মহামারিতে পুরো পৃথিবী ভুগছে। সংক্রমণের সংখ্যার দিক থেকে আক্রান্ত দেশগুলোর মধ্যে চতুর্থ অবস্থানে আছে রাশিয়া। এরই মধ্যে দেশটিতে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা সাড়ে ছয় লাখ ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু কোনো কিছুকেই পাত্তা দেননি পুতিন। গণভোট আয়োজনের জন্য হুট করেই দেশব্যাপী লকডাউন তুলে দেন পুতিন। এরপর গত ২৪ জুন থেকে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী গণভোটের আয়োজন। তবে তাতে ফলাফল কী হবে, সেই উত্তেজনা সংগত কারণেই ছিল না।

কেন ছিল না, তাও বলছি। সপ্তাহব্যাপী গণভোটের অংশ হিসেবে পুরো রাশিয়ায় ছিল প্যারেড ও পুরস্কারের ছড়াছড়ি। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, গণভোট উপলক্ষে মস্কোর অধিবাসীরা নানা পুরস্কারের এসএমএস পেয়েছেন ফোনে। এর মধ্যে ছিল নগদ পুরস্কার। প্রায় ২০ লাখ ভাউচার জেতার সুযোগ ছিল, যার মোট অর্থমূল্য ছিল ১০ বিলিয়ন রুবল বা ১৪০ মিলিয়ন ডলার। সাইবেরিয়াতে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের সামনে রাখা হয়েছিল স্মার্টফোন থেকে শুরু করে একটি অ্যাপার্টমেন্ট জেতার সুযোগ। সেখানকার স্থানীয় পোলিং স্টেশনের একজন প্রধান কর্মকর্তা এরই মধ্যে একটি ফ্ল্যাট জিতেছেন বলেও জানা গেছে।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

টাইম ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণভোট অনুষ্ঠানের সপ্তাহকাল আগে থেকেই মস্কোর বইয়ের দোকানগুলোয় বিক্রি শুরু হয়ে গিয়েছিল নতুন সংবিধান। এমনকি গত মে মাস থেকে বিভিন্ন আইনের খসড়া বিলের ক্ষেত্রে ক্রেমলিন নতুন সংবিধানকে আইনি ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করা শুরু করে দিয়েছিল।

অবশ্য তারপরও গণভোট উপলক্ষে দেশজুড়ে ছিল ভোট দেওয়ার জন্য ভ্রাম্যমাণ পোলিং স্টেশন, সেখানে ছিল কার্ডবোর্ডের তৈরি ব্যালট বাক্স, যা কিনা সহজেই খোলা যায়। কোথাও ব্যালট পেপারে ভোট হয়েছে, কোথাও হয়েছে ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে, ছিল না কোনো একক নিয়ম। আরও আছে। গণভোটে একেবারে সংবিধানের ২০৬টি পরিবর্তনের বিষয়ে একটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে রুশদের রায় দিতে বলা হয়। অর্থাৎ, ‘হ্যাঁ’ রায় দিতে হলে ২০৬টি পরিবর্তনের ক্ষেত্রেই ইতিবাচক হতে হবে। বাছবিচারের কোনো সুযোগ সেখানে ছিল না। ধরুন, পেনশন চালু করার বিষয়ে একজন রুশ নাগরিক যদি ইতিবাচক থাকেন, তবে ওই ভোটারকে একই সঙ্গে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতায় থাকার সময়সীমার বৃদ্ধি নিয়েও একমত হতে হবে। এবার বলুন তো, এমন গণভোটে আর যা-ই হোক, সপক্ষে ফল পাওয়া নিয়ে কি কোনো সংশয় থাকে?

তাই গণভোটে ভ্লাদিমির পুতিনের বিরাট ব্যবধানে জয়লাভ করা নিয়েও কোনো সংশয় ছিল না। শাসনকালের সময়সীমার দিক থেকে সোভিয়েত আমলের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রনায়ক জোসেফ স্তালিনের সঙ্গে সঙ্গে রাশিয়ার অনেক জারকেও পেছনে ফেলার সুযোগ পেয়ে গেছেন পুতিন। এবার সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পালা। আর তার জন্য ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে হবে তাঁকে, বেঁচে থাকলে যখন তাঁর বয়স হবে ৮৩ বছর।

গণভোটের ফলাফল দেখলে মানতেই হবে যে রাশিয়ায় পুতিনের জনপ্রিয়তা ব্যাপক। তবে নিরপেক্ষ জরিপ সে কথা বলছে না। রাশিয়ার একমাত্র স্বাধীন জরিপকারী প্রতিষ্ঠান লেভাদা সেন্টার বলছে, পুতিনের প্রতি রুশ জনগণের আস্থা ২৫ শতাংশে নেমে গেছে। তাদের মতে, গত ২০ বছরের মধ্যে এটাই সর্বনিম্ন। আবার লেভাদার জরিপে দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ রুশ মনে করেন, প্রেসিডেন্টের বয়স ৭০ বছরের বেশি হওয়া উচিত নয়। উল্লেখ্য, পুতিনের বয়স চলতি বছর ৬৮ হচ্ছে। অর্থাৎ এক ব্যক্তিকে দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার সুযোগ করে দিতে আগ্রহী নন অনেক রুশ নাগরিকই। কিন্তু একনায়কের বিরুদ্ধে মুখ ফুটে আওয়াজ তোলাও তো কঠিন। এর ওপর যদি ভিন্ন ও বিরোধী মত দমনের টাটকা স্মৃতি মনে থাকে, তবে তো কথাই নেই।

ভ্লাদিমির পুতিন অবশ্য ‘উন্নয়ন’ শব্দটি দিয়েই সব অনিয়ম জায়েজ করে দিচ্ছেন। তিনি বলছেন, দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে এবং তা ধরে রাখতেই ১৯৯৩ সালের সংবিধান সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। সেই সঙ্গে সঙ্গে পূর্বসূরিদেরও খারিজ করে দিচ্ছেন পুতিন। রুশ সংবাদমাধ্যম তাসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে সম্প্রতি পুতিন বলেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলের ভুলগুলো শোধরানোর জন্যই এই সাংবিধানিক সংস্কার প্রয়োজন ছিল। পুতিনের মতে, সোভিয়েত সংবিধানে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের যে থিসিস অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটি ছিল একটি ‘টাইমবোমা’। ওই থিসিসে উল্লেখ করা হয়েছিল যে সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত কোনো এলাকার বের হয়ে যাওয়ার অধিকার থাকবে। পুতিন মনে করেন, এটিই ছিল সবচেয়ে বড় ভুল। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমাদের এসব ভুল এড়ানো উচিত ছিল।’ উল্লেখ্য, নতুন সংবিধানে কোনো রুশ অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো অঞ্চল স্বাধীনতাকামী হতে পারবে না।

রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ছবি: রয়টার্স

শুধু লেনিনের ভুল ধরেই ক্ষান্ত হননি ভ্লাদিমির পুতিন; তিনি জোসেফ স্তালিনের সমালোচনাও করেছেন কড়াভাবে। স্তালিনের শাসনামল নিয়ে নিন্দুকেরা বলে থাকেন, ওই সময় বিরোধী মত দমন ও বিরোধীদের অত্যাচার করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করেছিলেন তিনি। সম্প্রতি রুশ সংবাদমাধ্যম আরটিতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ বিষয়ে পুতিনের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে। পুতিন বলেছেন, স্তালিনের শাসনামলে রুশ জনগণের ওপর অগণিত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। মানুষের ওপর দমন-নিপীড়ন চালানো হয়েছিল পাইকারি হারে। এসব ঘটনা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না কখনোই।

পুতিনের এই বক্তব্য কিছুটা চমক–জাগানিয়া। কারণ, এত দিন বিশ্লেষকেরা মনে করতেন, ‘নতুন স্তালিন’ হতে চান পুতিন। সাবেক এই কেজিবি কর্মকর্তার ক্রমে একনায়কতন্ত্রের দিকে যাত্রার কারণে এই ভাবনা খুব একটা অমূলকও ছিল না। কিন্তু ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় স্থায়ী হওয়ার পর থেকে এখন সুর পাল্টানো শুরু করেছেন পুতিন। কোনো কোনো বিশ্লেষক বলছেন, পুতিন আসলে সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে চান। এবার সেই উদ্দেশ্য নিয়েই এগোচ্ছেন তিনি। লেনিন বা স্তালিন নয়, তিনি চান পুরো রাশিয়ায় যেন শুধু ‘পুতিন’ নামটাই টিকে থাকে। এর জন্যই নিখাদ জাতীয়তাবাদের চর্চাতেই মনোযোগ দিচ্ছেন তিনি। আর নাকচ করতে শুরু করেছেন রুশ হিরোদের।

তবে এই একাধিপত্য পুরোপুরি কায়েম করতে শঙ্কা আছে অবশ্য। সের্গেই বেলানোভস্কি একটি ফোকাস গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। এই ফোকাস গ্রুপটিই রাশিয়ার ২০১১-১২ সালের জনবিক্ষোভের বিষয়ে সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল। এরা এখন বলছে, পুতিনের বিরুদ্ধে রাশিয়ায় জনরোষ বারুদের আকার নিয়েছে। যেকোনো সময় এর বিস্ফোরণ হতে পারে। এই বিস্ফোরণ কোনো নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের নিয়ম মেনে হবে না। বরং হুট করেই মস্কোর রাস্তায় রাস্তায় জ্বলে উঠতে পারে বিক্ষোভের আগুন। কারণ, করোনা পরিস্থিতি রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।

অদূর ভবিষ্যতে রাশিয়ায় পুতিনের নামই টিকে থাকবে কি না, সেটিই এখন দেখার।