Thank you for trying Sticky AMP!!

কেরালায় কেন এই বিপর্যয়?

ভারতের কেরালায় বন্যার বর্তমান পরিস্থিতি। গতকাল কোচিতে। ছবি: এএফপি
>
  • কেরালায় স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা-বিপর্যয়ে গতকাল পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৭।
  • অবিরাম বৃষ্টিই এর একমাত্র কারণ নয়
  • বিপর্যয়ের পেছনে পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার পাদদেশে নির্বিচার নগরায়ণ, বাঁধ ব্যবস্থাপনায় অবহেলাসহ নানা কারণ আছে

লোক হাসিয়েছেন ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের সদ্য নিযুক্ত ডিরেক্টর স্বামীনাথন গুরুমূর্তি। মনে যে সংশয় খোঁচা মারছে, তা তিনি প্রকাশ করে দিয়েছেন। বলেছেন, শবরীমালা মন্দিরে নারী প্রবেশের অনুমতি দেওয়া নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ভাবনাচিন্তায় দেবতা রুষ্ট হয়েছেন কি না, তা ভেবে দেখা দরকার!

গুরুমূর্তির মনে এমন ধরনের আজগুবি ভাবনার উদয়ের কারণ এটাই যে কেরালায় এমন বন্যা-বিপর্যয় স্মরণাতীতকালে দেখা যায়নি। গতকাল রোববার পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৭। ভারতে বর্ষা প্রথমেই আছড়ে পড়ে কেরালায়। তারপর ধীরে ধীরে ছেয়ে যায় গোটা দেশে। কেরালায় ফি বর্ষায় ভারী থেকে প্রবল, এমনকি লাগাতার ঝমঝমে বৃষ্টি হয়। কখনো কখনো জনজীবনও স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এবারের মতো বন্যা, এত প্রাণ ও সম্পত্তিহানি, এমন হাহাকার কখনো হয়নি। আগস্ট মাসে মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে অবিরাম বৃষ্টিই এর একমাত্র কারণ নয়। এ বিপর্যয়ের পেছনে রয়েছে পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার পাদদেশে নির্বিচার নগরায়ণ, বাঁধ ব্যবস্থাপনায় অবহেলা, রাজ্যের নদীগুলোর দুই ধার বেদখল হয়ে যাওয়া এবং পূর্বাভাস জানানোর অক্ষমতা।

সাড়ে তিন শতাধিক প্রাণহানি এবং লক্ষাধিক মানুষের ভিটেমাটি হারানোর পেছনের প্রধান কারণ অবশ্যই অবিরাম বৃষ্টি। গোটা রাজ্যে এ বছর স্বাভাবিকের তুলনায় ১৬৪ মিলিমিটার (৪২ শতাংশ) বেশি বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু ৯ থেকে ১৬ আগস্ট—শুধু এই ৮ দিনে কোল্লাম জেলায় বৃষ্টি হয়েছে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫২৭ মিলিমিটার বেশি; ইডুক্কি জেলায় ৪৩৮ মিলিমিটার ও মালাপ্পুরমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে ৩৯৯ মিলিমিটার।

বৃষ্টির এই বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়ায় রাজ্যের জলাধারগুলো। কেরালায় বড় বাঁধ মোট ছয়টি। এগুলোর মধ্যে ইদামালায়ার ও ইডুক্কি জলাধারের ধারণক্ষমতা এক বিলিয়ন কিউবিক মিটারের বেশি। এগুলো ছাড়া রাজ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট জলাধার। প্রতিবছর বর্ষায় এই জলাধারগুলো ভরা থাকে ধারণক্ষমতার প্রায় অর্ধেক। এ বছর জুলাই মাসের শেষে বড়-ছোট সব জলাধারই টইটম্বুর হয়ে যায়। আগস্ট মাসের যে সপ্তাহে রেকর্ড বৃষ্টি হলো, সে সময় সব জলাধারই প্রায় এক শ শতাংশ বোঝাই। বাঁধ বাঁচাতে তাই বাধ্য হয়ে বাড়তি জল ছাড়া হয়। রাজ্য সরকারের স্বীকারোক্তি, ৯ থেকে ১৬ আগস্ট হঠাৎই যে আকাশভাঙা বর্ষণ হবে, আগাম সেই হদিস সরকারের কাছে ছিল না। ছিল না বলে বাঁধ তদারকির দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরাও বাঁধ থেকে নিয়মিত জল ছাড়ার কথা ভাবেননি। সম্ভবত তাঁরা ভেবেছিলেন, বর্ষার পরও জলাধারগুলো টলটলে রাখলে রাজ্যেরই লাভ।

জলাধারগুলো থেকে জল ছেড়ে বাঁধ বাঁচানো সম্ভব হলো ঠিকই, কিন্তু তাতে প্লাবনের মাত্রা যায় বেড়ে। কোচি বিমানবন্দর যে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়েছে, তার কারণও এ-ই। রাজ্যের নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতাও প্রাকৃতিক নিয়মে কমে গেছে।  তৃতীয় কারণ, পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার পাদদেশে নিয়ম ভেঙে দেদার বসতি গড়ে তোলা হয়েছে।

বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত কেন্দ্রীয় সরকার ২০১০ সালে বিশিষ্ট পরিবেশবিদ মাধব ধনঞ্জয় গ্যাডগিলের নেতৃত্বে এক কমিটি গঠন করে। পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার পরিবেশ ভারসাম্য কীভাবে রক্ষা করা যায়, সেটাই ছিল কমিটির প্রধান দেখার বিষয়। এক বছর পর কমিটি রিপোর্ট পেশ করে। তাতে বলা হয়, পশ্চিম ঘাট পর্বতগাত্রে যেভাবে বসতি গড়া হচ্ছে, তা পুরোপুরি বন্ধই শুধু করতে হবে না, যেসব বসতি গড়া হয়েছে, সেগুলো থেকেও মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে দিতে হবে। নয়তো ভবিষ্যতে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করেনি। পশ্চিম ঘাট পর্বতমালার পাদদেশের ছয় রাজ্য—কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, গোয়া, মহারাষ্ট্র ও গুজরাট, প্রায় সবার কাছ থেকেই বাধা আসে। প্রতিরোধের দরুন গ্যাডগিল কমিটির সুপারিশ গ্রহণ না করে কেন্দ্রীয় সরকার ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন বা ‘ইসরো’র ডিরেক্টর কৃষ্ণস্বামী কস্তরীরঙ্গনের নেতৃত্বে অন্য একটি কমিটি গঠন করে। গ্যাডগিল কমিটি ৬৪ শতাংশ এলাকাকে পরিবেশের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছিল, কস্তুরীরঙ্গন কমিটি তা ৩৭ শতাংশে নামিয়ে আনে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজ্যগুলো বিরোধিতা কমায়নি। পশ্চিম ঘাটের ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল বসতিমুক্ত করতে রাজ্যগুলোর অনীহা এখনো প্রবল।

কেরালায় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, তাদের অধিকাংশ ঘটেছে পাহাড়ের ভূমিধসে।