Thank you for trying Sticky AMP!!

‘বাংলা ভাষা বাঁচাতে পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল’

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে ভাষাশহীদদের স্মরণে কলকাতার রাজপথে আলপনা আঁকছেন শিক্ষার্থীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি, কলকাতা

পশ্চিমবঙ্গে দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতি মেলানোর চেষ্টায় সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েছে বাংলা ভাষা। কলকাতার একটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথাই ধরা যাক। ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের শহীদদের স্মরণে জাতীয় গ্রন্থাগারে কেন্দ্রীয় সরকারি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে ‘আনসাং হিরোস অফ বেঙ্গল’ শব্দবন্ধের অনুবাদ করা হয়েছে ‘বাংলার অসন্তুষ্ট নায়ক’। বিজেপির যেকোনো বিজ্ঞাপনে এ ধরনের বাংলা প্রায়ই চোখে পড়ছে।
এ প্রসঙ্গে বিজেপির সাংসদ স্বপন দাশগুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, দল এসব বিষয়ে জানে না। কেন্দ্রীয় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অনুষ্ঠান; গুগলের সাহায্যে অনুবাদ করতে গিয়েই কাণ্ডটি ঘটেছে। বিজেপির বিজ্ঞাপনে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দি শব্দ; যেমন, প্রধানমন্ত্রী কিষান যোজনা অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর কৃষকদের জন্য প্রকল্প। এই নিয়ে লেখালেখিও শুরু হয়েছে পত্রপত্রিকায়।

অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেসের বিজ্ঞাপনে ভাষার বিকৃতি না ঘটানো হলেও তাদের নেতা-নেত্রীরা যে ভাষায় কথা বলছেন, তা সৌজন্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। তাদের নেতা মদন মিত্র খোলাখুলিভাবে বিজেপির এক নেতাকে হুমকি দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম উল্লেখ না করে বলেছেন, তাঁর ফোলা ফোলা চেহারা, বেশ নাদুস-নুদুস, ফাটুশ-ফুটুশ। বিজেপি নেতারাও সমানতালে কদর্য ভাষা ব্যবহার করে আক্রমণ করছেন তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা–নেত্রীদের।

ভাষার বিকৃতি ও অপব্যবহারকে একটা ভয়ংকর বিপদ বলে বর্ণনা করলেও এর ফলে রাতারাতি বাংলা ভাষা পাল্টে যাবে বলে মনে করেন না শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, কিছু অশিক্ষিত লোক থাকবেন, তাঁরা বাংলা লিখবেন। সেটা অন্যায় কিছু নয়। তাঁদের উদ্দেশ্য নির্বাচনে জিততে বাঙালিকে একটু প্রভাবিত করা। এ জন্যই তাঁরা তাড়াহুড়া করে, প্রস্তুতি না নিয়ে বাংলা লিখছেন বা অনুবাদ করছেন। এটা অশিক্ষিতের লেখা, এটার পুনরাবৃত্তি হবে না। মানুষ প্রতিবাদ করবেন, এটা পাল্টাবে। তবে গুগলের যে অনুবাদ, তা অতি ভয়ংকর। গুগল অযোগ্যদের দায়িত্ব দিচ্ছে, তাঁরা অনুবাদটা করতে পারেন না। কারণ, তাঁরা বাংলা বা ইংরেজি কোনোটাই জানেন না। পবিত্র সরকারের মতে, বড় আতঙ্কের বিষয় হলো, অকারণে বাংলা ভাষায় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে কলকাতার রাজপথে প্রভাতফেরি। ২১ ফেব্রুয়ারি, কলকাতা

পবিত্র সরকার বলেন, ‘বাংলা ভাষায় অনেক ইংরেজি শব্দ আছে; চেয়ার, টেবিল, লাইট, হারমোনিয়াম, পিয়ানো ইত্যাদি। কিন্তু অকারণে ‘বাট’, ‘ওকে’, ‘গুডবাই’—এসব কথা গুঁজে ভাষাটাকে একটা খিচুড়ি ভাষার দিকে নিয়ে গেলে এবং ছেলেমেয়েদের ইংরেজি স্কুলে পড়ার কারণে বাংলা ভাষা সম্পর্কে একটা অবজ্ঞা তৈরি হলে তা আরও বড় চিন্তার কারণ হবে। ইংরেজিকে একটা সাফল্যের ভাষা হিসেবে মনে করা হয় এবং এর পাশাপাশি বাংলাকে যদি ব্যর্থতার ভাষা বলে চিহ্নিত করা হয়, সেই মনোভাব আগামী দিনে আরও বড় বিপদ ডেকে আনবে। অন্যান্য ভারতীয় ভাষা যেমন হিন্দি, তামিল, পাঞ্জাবিতেও এই সমস্যা রয়েছে।’

রাজনৈতিক নেতাদের মুখের ভাষাকে ‘সামাজিক সৌজন্যের অভাব ও সমস্যা’ হিসেবে ব্যাখ্যা করে পবিত্র সরকার বলেন, এটা ছেলেমেয়েদের কাছে খুব খারাপ একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসছে।

ইংরেজির পাশাপাশি হিন্দি শব্দকেও এখন বাংলায় গুঁজে দেওয়া হচ্ছে। প্রাবন্ধিক সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার এই বিপদ নিয়ে সম্প্রতি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলি রাজনৈতিক ভাষ্য থেকে ভাষার বিষয়টা ক্রমেই বাদ দিয়ে দিয়েছে।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘ভারতীয় হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় মাথাভারী কেন্দ্রীয় কাঠামোকেই একরকম চূড়ান্ত ধরে নেওয়া হয়েছে। আর ওই ছিদ্র দিয়েই ক্রমে ঢুকে পড়েছে এককেন্দ্রিক হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের জিকির, যা এখন দৈত্যরূপে গোটা বাংলাকেই গিলে খেতে চায়।

কলকাতার প্রকাশক ও ভাষা নিয়ে কাজকর্ম করে, এমন সংগঠন ‘নবজাগরণ’–এর কর্মী সুনন্দন রায়চৌধুরী ঢাকার লেখকদের লেখাপত্র নিয়মিত কলকাতায় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলা ভাষা বাঁচাতে পশ্চিমবঙ্গ এখন বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীল। ভাষাকে চলমান রাখতে যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখানে হয়, বাংলাদেশে হয় তার কয়েক গুণ বেশি।

সুনন্দন রায়চৌধুরী বলেন, একটা ভাষা বাঁচাতে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বার্থে অর্থের প্রয়োজন রয়েছে। ভাষাকে মানুষের সময় দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, বাংলা ভাষা শিখে লোকে চাকরি পাবে, এই গ্যারান্টি দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এটা কিছুটা তামিলনাড়ুতে থাকলেও এখানে নেই। ফলে বাংলা ভাষার আজ ভরসা বাংলাদেশ।
এই অবস্থায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিয়মিত বাংলায় কথা বলছেন। ধারাবাহিকভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতাও আবৃত্তি করছেন, অনেক সময়ই যার অনেক উচ্চারণ বোঝা যাচ্ছে না। একুশে ফেব্রুয়ারির পরের দিন সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনী প্রচারে আবার বাংলায় আসছেন। রাজ্য অপেক্ষায় রয়েছে তাঁর কবিতা শোনার জন্য।