Thank you for trying Sticky AMP!!

মোবাইল ফোনেও 'যুদ্ধ' চান মোদি?

ভারতে এখন লোকসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলছে। সে উপলক্ষেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচার চালাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ছবি: রয়টার্স

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত শনিবার কেরালা গিয়েছিলেন। দেশটিতে এখন লোকসভা নির্বাচনের ভোট গ্রহণ চলছে। সেই উপলক্ষেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রচার চালাচ্ছেন মোদি। কেরালার জনসভায় মোদি ও তাঁর দল বিজেপির প্রতি সমর্থন জানাতে উপস্থিত সমর্থকেরা মোবাইল ফোনের আলো জ্বেলেছিলেন। হাজার হাজার মোবাইল ফোনের খণ্ড খণ্ড আলোয় জনসভায় অভাবিত এক দৃশ্য সৃষ্টি হয়েছিল।

চাইলে এই ঘটনাটিকে প্রতীকী হিসেবে ধরা যেতে পারে। কারণ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আক্ষরিক অর্থেই ভোটযুদ্ধকে মানুষের পকেটে পকেটে ছড়িয়ে দিয়েছেন। চলছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রপাগান্ডা ছড়ানোর লড়াই। শুধু ফেসবুক–টুইটার নয়, এখনকার স্মার্টফোনে চলা যোগাযোগের অ্যাপ্লিকেশনগুলোতেও সক্রিয় মোদির বিজেপি। মোবাইল ফোননির্ভর এই প্রপাগান্ডা যুদ্ধে বিজেপির থেকে বেশ পিছিয়ে আছে কংগ্রেস–বামপন্থীসহ অন্য প্রগতিশীল দলগুলো। আর এই ভার্চ্যুয়াল যুদ্ধে জেতার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)।

ভারতের মোট জনসংখ্যা শত কোটির ওপরে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে আছে অসংখ্য স্মার্টফোন। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত লোকসভা নির্বাচনে ভারতের মানুষের হাতে ছিল ১০ কোটির ওপর মোবাইল সেট। স্বাভাবিকভাবেই তখনো ভারতীয় রাজনৈতিক দলগুলো প্রচারের মাধ্যম হিসেবে স্মার্টফোনকে অতটা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। এরপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তৃত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছড়াতে থাকে ইন্টারনেটের প্রভাব। এখন ভারতের জনগণের হাতে মোট ৪০ কোটি মোবাইল সেট আছে। এর অধিকাংশই স্মার্টফোন। কারণ, দেশটিতে স্মার্টফোনের দাম নিম্নবিত্তের নাগালে চলে এসেছে।

এ তো গেলে স্মার্টফোনের হিসাব। ইন্টারনেটের খরচ তো আরও কম। ভারতে এক গিগাবাইট ডেটা কিনতে মাত্র ১৮ রুপি খরচ হয়। অর্থাৎ এই অর্থ খরচ করেই যেকেউ এক জিবি ডেটা কিনে মোবাইল ফোনে ব্যবহার করতে পারেন। ইন্টানেট ও স্মার্টফোন সস্তা হওয়ায় ভারত এখন ফেসবুকের সবচেয়ে বড় বাজারে পরিণত হয়েছে। শুধু ভারতেই ফেসবুকের ৩০ কোটি অ্যাকাউন্ট আছে। স্মার্টফোনভিত্তিক মোবাইল অ্যাপ হোয়াটসঅ্যাপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। চীনা কোম্পানির তৈরি করা অ্যাপ হেলো ও শেয়ারইট ভারতে বেশ আলোড়ন তুলেছে। গত বছর এই দুটি অ্যাপ্লিকেশন ৯৫ কোটিবার ডাউনলোড করা হয়েছে।

ভারতের মোট জনসংখ্যা শত কোটির ওপরে। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে আছে অসংখ্য স্মার্টফোন। এখন প্রচারের অস্ত্র হিসেবেও ব্যবহৃত হচ্ছে মোবাইল ফোন। ছবি: রয়টার্স

আশা করি, ভারতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও ভার্চ্যুয়াল যোগাযোগের মোবাইল অ্যাপ্লিকেশগুলোর জনপ্রিয়তা ও ব্যবহারের মাত্রা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া গেছে। সমস্যা হচ্ছে, হোয়াটসঅ্যাপের মতো মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনগুলো এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন ব্যবহার করে থাকে। ফলে ব্যবহারকারীদের বার্তা ও শেয়ার করা বিভিন্ন কনটেন্ট অত্যন্ত সুরক্ষিত থাকে। হোয়াটসঅ্যাপে কয়েকজন মিলে ‘গ্রুপ’ তৈরি করে যোগাযোগ চালানো যায়, যেকোনো কনটেন্ট শেয়ারও করা যায়। কোনো সংস্থার পক্ষে এই বিষয়টি তদারক করা সম্ভব নয়। ফেসবুক বা টুইটারের কাছে ব্যবহারকারীর তথ্য চাওয়া যায় বা আপত্তিকর কনটেন্ট সরিয়ে ফেলার অনুরোধ করা যায়। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে এটি সম্ভব নয়। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলো নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে যেকোনো কনটেন্ট পাঠাতে পারে। কিন্তু ওই গ্রুপ বা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বাদে কারও পক্ষে ওই কনটেন্ট সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। ফলে কোনো গ্রুপ যদি আপত্তিকর পোস্ট তৈরি এবং শেয়ার করে থাকে, তবে কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে তা চিহ্নিত করা সম্ভব হবে না।

এই সুযোগ নিয়েই ভারতের রাজনৈতিক দলগুলো প্রপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন উপলক্ষে ছড়ানো হচ্ছে ভুল তথ্য ও গুজব। বিজেপি হোয়াটসঅ্যাপে তৈরি করেছে ‘ট্রল আর্মি’। এতে দলটির স্বেচ্ছাসেবকেরা নির্বাচন ঘিরে ভার্চ্যুয়াল যুদ্ধে নেমে পড়েছে। মাঠে আছে কংগ্রেসও। কিন্তু বিজেপির আধিপত্য তুলনামূলক বেশি। শুধু উত্তর প্রদেশেই দেড় লাখ সাইবারযোদ্ধাকে মাঠে নামিয়েছে গেরুয়া বাহিনী। হিন্দুস্তান টাইমসের খবরে প্রকাশ, হোয়াটসঅ্যাপে প্রচার চালাতেই প্রায় নয় লাখ কর্মীকে নিয়োগ করেছে বিজেপি। আবার শুধু রক্ত-মাংসের মানুষ দিয়েও এখন চলছে না বিজেপির। ব্যবহার করা হচ্ছে রোবটের মতো স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাও। এর ফলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি বার্তা চলে যাচ্ছে লাখ লাখ মানুষের স্মার্টফোনে। অন্যদিকে, কংগ্রেস মূলত ফেসবুকনির্ভর প্রচারণাতে মনোযোগ দিয়েছে। ফেসবুকে তৈরি কনটেন্টগুলোই শেয়ার হচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে।

দ্য আটলান্টিক কাউন্সিল নামে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থা বলছে, ভারতে নির্বাচন উপলক্ষে বিশেষ বিশেষ দিনগুলোতে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অপ্রত্যাশিত ট্রাফিক লক্ষ করা যাচ্ছে। যেমন: ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন তামিলনাড়ু সফরে গিয়েছিলেন, তখন মোদির সমর্থনে ও তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়া হ্যাশট্যাগে টুইটার সয়লাব হয়ে গিয়েছিল। পরে দেখা গেছে, এসব পোস্ট তৈরিতে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। অর্থাৎ সব পোস্ট মানুষের হাতে তৈরি হয়নি। এ ক্ষেত্রে মোদির সমর্থনে তৈরি পোস্টগুলোর পরিমাণ ছিল প্রায় তিন গুণ বেশি।

বিবিসির নিজস্ব গবেষণায় দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে ভারতের ভার্চ্যুয়াল জগতে ডানপন্থী জাতীয়তাবাদী পোস্ট তৈরি ও সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার হার বেড়ে গেছে। বেড়েছে ফেক নিউজ বা ভুয়া খবর ছড়ানোর হার। আর নির্বাচন উপলক্ষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব ভুয়া খবর তৈরির হিড়িক আরও বাড়ছে। বিশেষ করে হোয়াটসঅ্যাপে এই প্রবণতা বেশি। কারণ, সেখানে কোনো পোস্টে দেওয়া তথ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় পড়ে না। অথচ হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে অনেক মানুষের কাছে পৌঁছানো সহজ। এই অ্যাপে ইচ্ছে করলে একটি গ্রুপেই যোগ দিতে পারে ২৫৬ জন ব্যবহারকারী।

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। নির্বাচন উপলক্ষে ভার্চ্যুয়াল যুদ্ধে নেমেছে তাঁর দলও। ছবি: রয়টার্স

দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ভারতের অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর কাছে সংবাদ পৌঁছায় এই হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে। রয়টার্স ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, ইংরেজিভাষী ভারতীয় নেটিজেনদের ৫২ শতাংশই হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার খবর পেয়ে থাকেন। একইভাবে হোয়াটসঅ্যাপ ও ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেক নিউজ ছড়ানোর উর্বর ক্ষেত্র হয়েও দাঁড়িয়েছে। সত্য ও মিথ্যার এই জগাখিচুড়ি থেকে সত্য খবরটি চিনে নেওয়া খুবই দুরূহ। এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জ্ঞান অনেক ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরই থাকে না। আর এই সুযোগেই ছড়াচ্ছে গুজব। ২০১৭-১৮ সালে হোয়াটসঅ্যাপে ছড়ানো গুজবের কারণে ভারতে কমপক্ষে ৩১ জনের প্রাণ গিয়েছে। গুজবে বশীভূত হয়ে চালানো হামলাতেই এসব মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

হাফিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, পুলওয়ামায় ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর সদস্যদের ওপর হামলা বা বালাকোটে ভারতীয় বিমানবাহিনীর হামলার পর ফেক নিউজ ছড়ানোর গতি আরও বাড়ছে। এখন ভারতের সব রাজনৈতিক দলই ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মে প্রচারের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে বিজেপিকে ছুঁতে পারছে না কেউ। দলটি নরেন্দ্র মোদির নামের আদ্যক্ষর ব্যবহার করে নতুন অ্যাপ লঞ্চ করেছে। এই অ্যাপটির নাম ‘নমো’। কিছু ক্ষেত্রে নতুন মোবাইল হ্যান্ডসেটে প্রিলোডেড অ্যাপ হিসেবে যুক্ত করা হচ্ছে এটি। নিন্দুকেরা বলছেন, সরকারি প্রভাবেই এই কাজ করা হচ্ছে।

ভারতের এই পরিস্থিতি ফেসবুক–টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য অ্যাসিড টেস্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে। আদতেই এসব প্রতিষ্ঠান ফেক নিউজ ও ঘৃণা ছড়ানো ঠেকানোর কাজটি বড় পরিসরে করতে পারে কি না, সেটি ভারতের নির্বাচন উপলক্ষে পরীক্ষা করা হয়ে যাবে। এরই মধ্যে সন্দেহজনক শত শত পেজ বন্ধ করে দেওয়া শুরু করে দিয়েছে ফেসবুক। এই বন্ধ হওয়া পেজের তালিকায় বিজেপি–কংগ্রেস দুই–ই আছে।

তবে ভার্চ্যুয়াল জগতের প্রপাগান্ডার এই ‘যুদ্ধ’ থামানোর জন্য উপযুক্ত আইন ভারতে নেই। দেশটির নির্বাচন কমিশন অবশ্য ভোট উপলক্ষে এসব ভুল তথ্যের প্রচার বন্ধের জন্য বারবার নির্দেশনা দিচ্ছে। কিন্তু শুকনো কথায় চিড়ে ভিজছে না। রেফারির অনুপস্থিতিতে মাঠে ইচ্ছেমতো খেলার এই সুযোগ ছাড়তেও চাইছে না মোদির বিজেপি। ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ার তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষকে দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়াই এখন তাদের লক্ষ্য।