Thank you for trying Sticky AMP!!

একজন রাজন, ইসরায়েলের চোরাগোপ্তা গুলি

রাজন আল-নাজ্জার। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া


৩০ মার্চ থেকে বিক্ষোভ করে আসছে গাজাবাসী। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় ফিলিস্তিনিরা যে ভূখণ্ড হারিয়েছে, তা ফিরে পাওয়ার দাবিতে চলছে বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভের লাশের মিছিলে যুক্ত হলেন এক নারী স্বাস্থ্যকর্মী। তাঁর নাম রাজন আল-নাজ্জার। তিনি ছিলেন আরবের ঊষর মরুপ্রান্তরে পীড়িত মানুষের জন্য একজন নাইটিঙ্গেল।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকর্মী রাজন আল-নাজ্জার (২১) গত শুক্রবার খান ইউনিসে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আহত বিক্ষোভকারীদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন নাজ্জার। এই তরুণীর সঙ্গে আরও তিনজন গুলিবিদ্ধ হন। জেনেভা সনদ অনুযায়ী, স্বাস্থ্যকর্মীদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া যুদ্ধাপরাধ। এমন যুদ্ধাপরাধ ইসরায়েল হরহামেশাই করে যাচ্ছে, যা বিশ্ব মানবতার কাছে বরাবরই উপেক্ষিত।
গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত স্বাস্থ্যকর্মী রাজন আল-নাজ্জারের জানাজায় শনিবার হাজারো মানুষের ঢল নামে।

নাজ্জার নিহত হওয়ার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের দূত নিকোলা ম্লাদেনভ শনিবার এক টুইটে লেখেন, স্বাস্থ্যকর্মীরা লক্ষ্যবস্তু হতে পারেন না। বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের মানদণ্ড অনুসরণ করা উচিত। আর হামাসেরও উচিত, সীমান্ত বেড়ায় চলমান ঘটনাগুলো প্রতিরোধ করা।

রাজন আল-নাজ্জারের সেই জ্যাকেট। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বসতবাড়িতে ফেরার বিক্ষোভে তাঁর সক্রিয় উপস্থিতি ছিল। সবাই দেখছে, ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে আহত ব্যক্তিদের সেবা দিতে সাদা পোশাক পরা এক নারী স্বাস্থ্যকর্মী সদা তৎপর। এতটুকু বিশ্রাম নেওয়ারও যেন জো নেই তাঁর। ২১ বছর বয়সী রাজন আল-নাজ্জার দিনে ১৩ ঘণ্টা করে আহত ব্যক্তিদের সেবা করেছেন। কেউ আহত হলেই তিনি ছুটে যেতেন তাঁর কাছে। শুশ্রূষা দিয়ে তাঁকে সুস্থ করে তোলার প্রাণান্ত চেষ্টা করতেন। জখম গুরুতর হলে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতেন। জরুরি চিকিৎসাসেবার স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে দেখিয়েছেন, নারী হলেও সেবার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে অনেক কিছু করার আছে তাঁর। তা প্রমাণও করেছেন তিনি।

খান ইউনিসের প্রতিবাদ শিবিরে রাজনই ছিলেন প্রথম নারী চিকিৎসাকর্মী। একজন নারী কী কী করতে পারেন, তা তিনি বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন।

একজন চিকিৎসাকর্মী হিসেবে রাজন কেবল চাকরি করবেন, তা হতে পারে না। নারী হিসেবে নিজের কাজটাও করতে চান। গত মাসে নিউইয়র্ক টাইমসকে রাজন আল-নাজ্জার বলেছেন, ‘স্বাস্থ্যকর্মীর সেবার কাজটি শুধু পুরুষের জন্য নয়, এটা নারীরও।’

আল জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, গত শুক্রবার মাগরিবের আজান দিতে ঘণ্টাখানেক সময় বাকি। রাজন বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু তিনি দেখলেন এক বিক্ষোভকারী আহত হয়ে পড়ে আছেন। দ্রুত তাঁর কাছে ছুটে গেলেন। চিকিৎসা দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দেন। ইসরায়েলি সেনারা তখন তাকে লক্ষ্য করে দুটি কিংবা তিনটি গুলি ছোড়েন। বুকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এই সময়ের মরুর নাইটিঙ্গেল।

রাজন আল-নাজ্জারের দাফনে হাজারো মানুষ অংশ নেন। ছবি: আল জাজিরা

বার্তা সংস্থা এএফপি জানিয়েছে, মাস দুয়েক ধরে ফিলিস্তিনিদের বিক্ষোভে ইসরায়েলি গুলিতে রজনকে নিয়ে ১২৩ জন নিহত হয়েছেন। গত শুক্রবার অনেকেই আহত হলেও নিহত হন রাজনই।

একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে রাজনকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা গেলেও ইসরায়েলি সেনাসদস্যরা তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জেনেভা কনভেনশন অনুসারে যেটি সুস্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ।

বরাবরের মতোই শনিবার জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থা ক্ষোভ প্রকাশ করে বিবৃতিতে জানিয়েছে, এটি ভয়ংকর নিন্দনীয় অপরাধ। হত্যাকাণ্ড নিয়ে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী তদন্ত শুরুর কথা জানিয়েছে।

১৯৪৮ সালে ইহুদি সশস্ত্র গোষ্ঠীর হামলায় প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি নিজেদের বসতবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়। নিজেদের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকারের দাবিতে গত ৩০ মার্চ থেকে গ্রেট মার্চ ফর রিটার্ন নামে আন্দোলন শুরু হয়েছে। এলাকাটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কারাগার বলা যেতে পারে।

গত ১৪ মে তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের প্রতিবাদে ফিলিস্তিনিরা বিক্ষোভ শুরু করেন। ইসরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে ৬২ জন নিহত হন। এমন পরিস্থিতির মধ্যে একজন নারী হিসেবে নাজ্জারও ঘরে বসে থাকতে পারেননি। ইব্রাহিম আল নাজ্জার নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, এক বৃদ্ধ লোকের মাথায় ইসরায়েলের টিয়ারগ্যাসের আঘাত লাগলে রাজন আল-নাজ্জার তাঁর সাহায্যে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তখনই তাঁকে গুলি করা হয়।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, রাজন আল-নাজ্জার নিজের হাত উঁচিয়ে আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। তিনি যে একজন চিকিৎসাকর্মী, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল।

গর্বিত বাবাও গোলায় হারান শেষ সম্বল
ইসরায়েল সীমান্তে কৃষিনির্ভর গ্রাম খোঁজায় বাড়ি রাজনদের। বাবা আশরাফ আল নাজ্জারের মোটরসাইকেলের যন্ত্রপাতি বিক্রির একটি দোকান ছিল। ২০১৪ সালে ইসরায়েলি গোলায় সেটিও ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর থেকে পুরোপুরি বেকার জীবন কাটছে তাঁর।

রাজন আল-নাজ্জারের সহকর্মীরা। ছবি: আল জাজিরা

আশরাফের ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হয়ে দুই বছরের প্যারামেডিক প্রশিক্ষণ নেন। এরপরই তিনি বেসরকারি সংস্থা প্যালেস্টাইন মেডিকেল রিলিফ সোসাইটির একজন স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ শুরু করেন।

৪৪ বছর বয়সী আশরাফ আল নাজ্জার বলেন, রাজন সেদিন রাতে সাহ্‌রি খাওয়ার পর নামাজ পড়েন। এটিই ছিল মেয়েকে তাঁর শেষ দেখা।

অস্ত্র ছাড়াই সবকিছু করতে পারি
নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক ইয়াদ আবু হায়াইলা ও ইসাবোল কেশনার বলেন, গত মাসে খান ইউনিসে যখন তাঁর সঙ্গে আমাদের কথা হয়, তখন রাজন বলেছেন, তিনি যা করছেন, তাতে তাঁর বাবা গর্বিত। তাঁকে নিয়ে তাঁর বাবা গর্ববোধ করেন। ওই সময় রাজন নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছিলেন, ‘আমাদের একটিই লক্ষ্য। মানুষের জীবন বাঁচানো ও আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করা। বিশ্বকে বার্তা দিতে চাই যে, অস্ত্র ছাড়াই আমরা সবকিছু করতে পারি।’

শুক্রবার ইসরায়েলি সীমান্তবেষ্টনী থেকে ৩০০ ফুট দূরে ছিলেন রাজন। ইব্রাহিম আল-নাজ্জার বলেন, রাজন কাউকে গুলি করেননি। তিনি মানুষের প্রাণ রক্ষায় এগিয়ে গিয়েছিলেন। আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা দিচ্ছিলেন।

চিকিৎসক সালাহ রানটিসি বলেন, গুরুতর আহত অবস্থায় খান ইউনিসের ইউরোপিয়ান হাসপাতালে রাজনকে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে অস্ত্রোপচার কক্ষে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

রাজন আল-নাজ্জারের মা (ডান দিক থেকে দ্বিতীয়) সাবরিন আল-নাজ্জার কাঁদছেন। ছবি: আল জাজিরা

এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে রাজনের রক্তমাখা পোশাক হাতে তাঁর মা বলেন, ‘এটি আমার মেয়ের অস্ত্র, যা দিয়ে সে ইহুদিবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করত।’ আর তাঁর গায়ে মেডিকেল জ্যাকেটের ভেতরে পাওয়া দুটি ব্যান্ডেজ দেখিয়ে মা বলেন, ‘এগুলো ছিল তার গোলাবারুদ।’

খান ইউনিসের প্রতিবাদ শিবিরে রাজনই ছিলেন প্রথম নারী চিকিৎসাকর্মী। একজন নারী কী করতে পারেন, তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।

রাজনের মা বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীদের প্রায়ই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু সমাজ আমাদের গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তারা যদি পছন্দমতো আমাদের গ্রহণ না করে, পরে জোর করে গ্রহণ করাতে বাধ্য করা হয়। কারণ যেকোনো পুরুষের চেয়ে আমাদের শক্তি কোথাও কম না।’

কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে যাওয়া রাজনের মা সাবরিন আল-নাজ্জার তাঁর মেয়েকে সর্বশেষ দেখার কথা স্মরণ করে বলেন, ‘সে আমার সামনে এসে হাসি দিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাকে বলল, “আমি যাচ্ছি।” চোখের পলকেই সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আমিও তাকে দেখতে বারান্দায় চলে যাই। কিন্তু এতক্ষণে সে রাস্তার শেষ মাথায় চলে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘সে যেন পাখির মতো আমার কাছ থেকে উড়ে চলে গেছে। প্রতিদিন অ্যাপ্রোনে রক্তের দাগ নিয়ে সে বাসায় ফিরত, আর কোনো দিন সে আমার বুকে আসবে না।’

রাজনের সহকর্মী লামিয়া বলেন, আমরা আহত ব্যক্তিদের উদ্ধারের চেষ্টা করছিলাম। তখন ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে। আমাদের শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। এ সময় তারা আমাদের লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়ে। তিনি বলেন, আমাদের সবার দিকে তাদের বন্দুক তাক করা। বেসামরিক লোকজনই নয়, আমাদের চিকিৎসাকর্মীরাও তাদের লক্ষ্য ছিলাম।

আহত একজনের সেবায় রাজন আল-নাজ্জার। ছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

লামিয়া বলছেন, আমরা সন্ত্রাসী না। আমরা মানবিক কাজ করি। আহত ব্যক্তিদের উদ্ধার করে চিকিৎসা দিই ও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। আমরা মেডিকেল পোশাক পরে থাকি। আমাদের কোনো অস্ত্র নেই। এরপরও আমাদের হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে।
রাজনের চাচাতো ভাই বলেন, সে ছিল দেবদূত। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের ওষুধ কেনার সামর্থ্য ছিল না, সে তাদের ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিত।

বারবার একই কথা ইসরায়েলের
শুক্রবার গাজায় বিক্ষোভে আহত ফিলিস্তিনির সাহায্যে এগিয়ে যাওয়া রাজনকে গুলি করে হত্যার পরই বক্তব্য দিয়েছেন সেনারা। অন্য ঘটনার মতো এবারও বিবৃতিতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা এ নিহতের ঘটনায় তদন্ত করে দেখবে। কিন্তু হামাস বলছে, এ ঘটনার পরই মানুষের জন্য হাসপাতালও বিপজ্জনক জায়গা হয়ে গেল।

ইসরায়েল এত দিন দাবি করে আসছিল যে বিক্ষোভকারীরা গাজা সীমান্তবেষ্টনী ভেঙে ইসরায়েলে প্রবেশ করতে চায়, তাদের কেবল গুলি করেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু রাজন বেষ্টনী অতিক্রম না করেও স্নাইপারের গুলিতে প্রাণ হারালেন।

জানাজায় মানুষের ঢল
গত শনিবার রাজনের জানাজা ও দাফনে হাজারো মানুষের ঢল নামে। ফিলিস্তিনি পতাকায় মোড়ানো রাজন আল-নাজ্জারের মরদেহ রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় অনেকেই যোগ দেন। যাঁরা বিভিন্ন সময় আহত হয়ে রাজনের সেবায় সুস্থ হয়েছিলেন ছিলেন, তাঁরাও। দাফনের আগে শেষ বিদায়ের জন্য রাজন নাজ্জারের মরদেহ বাড়িতে নেওয়া হয়। বিক্ষোভের অঞ্চলগুলোতে রাজন ছিলেন পরিচিত এক মুখ। ফিলিস্তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেবদূত হিসেবে আঁকা তাঁর ছবি ছড়িয়ে পড়েছে।