Thank you for trying Sticky AMP!!

কমিউনিটি সাংবাদিকতার হালচাল

বছর দু-এক আগের কথা। নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে সে সময়ের এডিটর–ইন–চিফ ও বর্তমানে এডিটর–অ্যাট–লার্জ গেরি বেকারের সঙ্গে দেখা। কুশল বিনিময়ের পর যখন জানলেন আমি একটি কমিউনিটি সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত, আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় তাঁর আগ্রহ যেন একটু বেড়ে গেল। পাশে দাঁড়ানো একজনকে বিদায় দিয়ে আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললেন, হ্যাঁ বল তো, তোমাদের কমিউনিটি নিউজ পেপারের ধরনটা কেমন? কী কী বিষয় তোমরা কভার করো...আমি যখন টাইমস অফ লন্ডনে ছিলাম তখন আমার খুব আগ্রহের বিষয় ছিল কমিউনিটি জার্নালিজম। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে আমরা ‘কমিউনিটি নিউজ’ হিসেবে তেমন কিছু কভার করি না, কিন্তু বিজনেস আর ইকোনমিক সাইড থেকে অনেক কমিউনিটির প্রতি নজর রাখি।

আমি গেরি বেকারকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কীভাবে? গেরি একটু অবাকই হলেন আমার প্রশ্ন শুনে। বললেন, আমাদের কিছু ‘ষ্ট্রিঙ্গার’ আছে, সঙ্গে কিছু সোর্স। নিউইয়র্কের বিভিন্ন কমিউনিটি সংবাদপত্র যেগুলো ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়, সেগুলোর স্টোরিও আমরা দৃষ্টিতে রাখি, যদি আমাদের কোনো নিউজ বা ফিচারের সঙ্গে রিলেটেড হয় বা ভবিষ্যতে হতে পারে। তোমাদের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে ক্ষুদ্র ব্যবসার দ্রুত প্রসার হচ্ছে, এমন একটি স্টোরি আমরা প্ল্যানিংয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু প্রয়োজনীয় তথ্য–উপাত্তের অভাবে পরে আর করা হয়নি। ক্রেইন’স বিজনেস পত্রিকায় তোমাদের বাংলাদেশের এক বেকারের (কবির’স বেকারির প্রয়াত হুমায়ুন কবির) স্টোরি পড়েছিলাম।

গেরি আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তোমাদের কমিউনিটিতে কয়টি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ‘ডজন খানিক হয়তো হবে’, আমি বললাম। গেরি একটু অবাক দুষ্টিতে পাল্টা প্রশ্ন তুললেন, হয়তো কেন? সঠিক সংখ্যা তুমি জানোনা? আমি ধাক্কা খেয়ে বললাম, ‘আমাদের কমিউনিটিতে মোটামুটি দুধরনের কাগজ আছে। কিছু সিরিয়াস কমিউনিটি নিউজপোপার, যাদের “অ্যাকটিভ” সম্পাদক আছে। আর কিছু কাগজ শুধু বিজ্ঞাপন ছাপিয়ে ব্যবসার জন্য বের হয়। এসব কাগজের ‘সম্পাদক’ প্রেসে কাগজ ডেলিভারি নিতে গেলে জানতে পারে, তাদের কাগজে কী কী ছাপা হয়েছে! এগুলো আসলে সংবাদপত্র নয়, ইয়েলো পেজ।’ 

গেরি একটু হাসলেন। বললেন, কমিউনিটি সংবাদপত্রের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। টেলিভিশনের চাপে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাবে সিরিয়াস কনটেন্টের ব্যাপারে পাঠকদের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। আমি এবার গেরির কাছে জানতে চাইলাম, কীভাবে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে? একটু মুচকি হেসে আমার কাঁধে এক হাত রেখে বেশ লম্বা–চাওড়া আকৃতির গেরি বলল, কনটেন্টে ভেরিয়েশান আনো, পাঠকদের পরিবর্তনশীল চাহিদা জানার চেষ্টা করো আর মেকআপে নিজের একটা আইডেনটিটি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করো।
গত দুবছর ধরে আমি ‘পরিচয়’-এর জন্য তাই করার চেষ্টা করছি।
নিউইয়র্কের বাংলাদেশি কমিউনিটিতে প্রথম সিরিয়াস সংবাদপত্র বের হয় যত দূর মনে পড়ে ১৯৮৫ সালে সাপ্তাহিক দিগন্ত নামে। কয়েক মাস টিকেছিল, এরপর সাপ্তাহিক ঠিকানা, সাপ্তাহিক বাঙালী, সাপ্তাহিক পরিচয়, সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা প্রায় কুড়ি বছরের বেশি সময় ধরে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। সাপ্তাহিক দিগন্ত–এর পর ও ঠিকানা–এর আগে পাক্ষিক প্রবাসী পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়, যেটি পরবর্তীতে সাপ্তাহিকে রূপান্তরিত হলেও নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
এখন নিয়মিত, অনিয়মিত মিলে দেড় ডজন পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তীব্র সংকটে রয়েছে কমিউনিটির বাংলা গণমাধ্যম শিল্প। দুঃখজনক হলেও সত্য, দীর্ঘ ৩৪ বছরেও নিউইয়র্কের বাংলা গণমাধ্যমে পেশাদার আমেজটি সৃষ্টি হয়নি। ১৮টি পত্রিকা প্রকাশিত হলেও সত্যিকার অর্থে ১৮ জন সাংবাদিক নেই। ১৮ সাপ্তাহিক পত্রিকার বিজ্ঞাপনের জন্য যে বাজার থাকা প্রয়োজন, তা এখনো গড়ে ওঠেনি। ঢাকায় যেমন বেশ কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, যাদের বিজ্ঞাপনের বাজেট কয়েক শ কোটি টাকা, নিউইয়র্কে বাংলাদেশি গণমাধ্যমের জন্য সে ধরনের একজন বিজ্ঞাপন দাতাও নেই।
পত্রিকা প্রকাশে বিজ্ঞাপন অবশ্যই প্রয়োজন, কিন্তু সেই বিজ্ঞাপন যখন বিবেকের পেশা সাংবাদিকতাকে নিয়ন্ত্রণ করে, তখন সাংবাদিকতা আর সমাজের কোনো কাজে আসে না। পাঠকের ভালোবাসা না পেলে সংবাদমাধ্যম সমাজ পরিবর্তনের সহায়ক হতে পারে না। ৭৬ লাখ পাঠকের ভালোবাসায় সিক্ত প্রথম আলো নিউইয়র্কে বিবেকনির্ভর সাংবাদিকতার আলোকবর্তিকা হয়ে উঠবে, সে আশায় থাকলাম।

সম্পাদক, সাপ্তাহিক পরিচয়, নিউইয়র্ক