Thank you for trying Sticky AMP!!

খাসোগির অন্তর্ধান-রহস্য, সৌদির ওপর চাপ বাড়ছে

তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ২ অক্টোবর প্রবেশের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন সৌদির সাংবাদিক জামাল খাসোগি। ছবি: এএফপি

সৌদির সাংবাদিক জামাল খাসোগির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে দেশটির ওপর পশ্চিমা বিশ্বের চাপ বাড়ছে। ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেট ভবনে ব্যক্তিগত কাগজপত্র আনতে গিয়ে নিখোঁজ হন সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের কড়া সমালোচক খাসোগি। মনে করা হচ্ছে, তাঁকে কনস্যুলেট ভবনের ভেতরে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

এ ঘটনায় মার্কিন সিনেটররা মাগনিতস্কি আইন প্রয়োগের মাধ্যমে মার্কিন তদন্ত চেয়ে সরকারের ওপর চাপ দিচ্ছেন।

আল–জাজিরা ও দ্য গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, খাসোগি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় সৌদি আরবের ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছেন পশ্চিমা নেতারা। সিনেটের পররাষ্ট্র সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সভাপতি রিপাবলিকান সিনেটর বব কোর্কার বলেন, তিনি মনে করেন খাসোগিকে হত্যা করা হয়েছে। আরেক সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহামের মতে, এই ঘটনা ঘটে থাকলে সর্বোচ্চ মূল্য চুকাতে হবে। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন, এই ঘটনা ঘটতে দেওয়া যায় না। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্ট সৌদি আরবকে সতর্ক করেছেন এই বলে যে, মূল্যবোধ ভাগাভাগির ওপর বন্ধুত্ব নির্ভর করে।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এ ঘটনায় তুরস্ক সরকারের সঙ্গে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কংগ্রেসের ক্রমাগত চাপের মুখে সরকার আরও বেশি কিছু করতে অগ্রসর হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, মাগনিতস্কি অ্যাক্ট কী, যার প্রয়োগ চাইছেন সিনেটররা?
রুশ আইনজীবী ও হিসাব পরীক্ষক (অডিটর) সের্গেই মাগনিতস্কির বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মাগনিতস্কি দায়বদ্ধতা আইনটিতে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা স্বাক্ষর করেন। আইনটির পুরো নাম ‘রাশিয়া অ্যান্ড মলদোভা জ্যাকসন-ভ্যানিক রিপিল অ্যান্ড সের্গেই মাগনিতস্কি রুল অব ল অ্যাকাউন্টিবিলিটি অ্যাক্ট অব ২০১২’। বিলটি কংগ্রেসে পাস হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ওবামা তাতে স্বাক্ষর করেন।

রাশিয়া কর্তৃপক্ষ ২০০৮ সালে মাগনিতস্কিকে গ্রেপ্তার করে। ক্রেমলিনের (রাশিয়ার রাষ্ট৶পতির দাপ্তরিক বাসভবন) সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষের বড় অঙ্কের প্রায় ২৩০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (১ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকার বেশি) কর প্রতারণার ঘটনাটি তদন্তে মার্কিন বিনিয়োগকারী উইলিয়াম ব্রোডার দায়িত্ব দিয়েছিলেন মাগনিতস্কিকে। মাগনিতস্কিকে পুলিশি হেফাজতে থাকা অবস্থায় প্রচণ্ড মারধর করা হয়। মুক্তি দেওয়ার কয়েক দিন আগে ২০০৯ সালে কারাগারে তাঁর মৃত্যু হয়। মাগনিতস্কি আইনের মাধ্যমে ১৮ জন রুশ কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে আইনটিতে সরকারকে বিশ্বের যেকোনো স্থানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির সম্পদ বাজেয়াপ্ত, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা মার্কিন ভিসা নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়।

প্রথিতযশা সাংবাদিক জামাল খাসোগির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে মার্কিন সিনেটররা গ্লোবাল মাগনিতস্কি অ্যাক্ট প্রয়োগের দাবি করেছেন। এর মাধ্যমে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন বা অন্য কোনো বড় ধরনের অপরাধের জন্য কোনো বিদেশি দায়ী হলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তদন্ত করার অনুমতি দেবেন। বুধবার বব কোর্কারের নেতৃত্বে মার্কিন সিনেটে দ্বিদলীয় ২২ জন সিনেটর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ চেয়ে একটি চিঠি স্বাক্ষর করেছেন। খাসোগির বিরুদ্ধে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তাঁর তদন্ত চেয়েছেন তাঁরা।

সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: এএফপি

কমিটির সভাপতির কাছ থেকে চিঠি পাওয়ার পর প্রেসিডেন্টকে ১২০ দিনের মধ্যে নির্ধারণ করতে হবে বিদেশি ব্যক্তি কোনো অপরাধ করেছেন কি না। এ ব্যাপারে কমিটির কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে হবে। কমিটিকে জানাতে হবে কেন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে না, যদি আরোপ করা হয় তবে কী কী নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে।

চিঠিতে প্রেসিডেন্টের প্রতি মাগনিতস্কি অ্যাক্ট প্রয়োগের অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘খাসোগি ইস্যুতে কোনো বিদেশি ব্যক্তি অপরাধ করে থাকলে এই আইনের আওতায় নিষেধজ্ঞা আরোপের বিষয়টি আপনি (প্রেসিডেন্ট) নিরূপণ করবেন। আমাদের প্রত্যাশা, আপনি যা নিরূপণ করবেন, এতে সৌদি আরবের শীর্ষ ব্যক্তিসহ এ–সম্পর্কিত যেকোনো তথ্য বিবেচনা করবেন।’

অনেকের মতে, মাগনিতস্কি আইন কার্যকরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্কে বড় ধরনের হুঁশিয়ারি বার্তা দেওয়া হবে। সৌদি আরবের সঙ্গে এখন ট্রাম্পের সুসম্পর্ক রয়েছে। সৌদি আরব হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র বিক্রির বড় বাজার। গতকাল বৃহস্পতিবার যদিও ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে সৌদি বিনিয়োগ বন্ধের কোনো কারণ তিনি দেখছেন না। তবে বিশ্লেষক অনেকের মতে, খাসোগির অন্তর্ধান তেলসমৃদ্ধ আরব দেশটির ওপর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের দিকে ঠেলে নিতে পারে।

ওয়াশিংটন ডিসিতে আরব আমেরিকান ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট জেমস জোগবি আল–জাজিরাকে বলেছেন, খাসোগির ঘটনা সৌদি আরবের ব্যাপারে ‘বড় ধরনের জনমতের দিকে ঠেলে নিতে পারে’। শুধু সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে নয়, সিনেটেও এমন কোনো মত আসতে পারে। সিনেটে, কংগ্রেস প্রেসিডেন্টকে ছাড়াই কাজ চালাতে পারে। তাই এর প্রতিফলন থাকবে সিনেটে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেই যে সিনেটে পার পাওয়া যাবে না, সেটা খুব ভালো করেই জানে সৌদি আরব।

যুবরাজ মোহাম্মদ ক্রাউন প্রিন্স হওয়ার পর একের পর এক বিরুদ্ধ মত প্রকাশকারী, বুদ্ধিজীবী ও ইসলামি ধর্মপ্রচারকেরা গ্রেপ্তার হতে থাকেন। এই পরিস্থিতিতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরব ছেড়ে পালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান জামাল খাসোগি। তিনি ওয়াশিংটন পোস্টে লিখতেন। তিনি বলেছিলেন, জঙ্গি সংগঠন দাবি করে সৌদি আরব মুসলিম ব্রাদারহুডকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। সেই সংগঠনের পক্ষে মত প্রকাশ করায় পান–আরব (যারা আরব জনগণ ও দেশগুলোর জন্য একই রাজনৈতিক মতাদর্শের একক রাষ্ট্র চায়) মতাদর্শের দৈনিক পত্রিকা আল-হায়াতে তাঁর লেখা নিষিদ্ধ করা হয়। ওই পত্রিকা সৌদি যুবরাজ খালেদ বিন সুলতান আল-সৌদের মালিকানাধীন।

খাসোগি ইয়েমেনে ইরান-সমর্থিত বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে দেশটির সরকারের সঙ্গে সৌদি নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের যুদ্ধ করা নিয়েও সমালোচনা করেছিলেন।

২০১৭ সালের ১৪ মার্চ ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করেন সৌদির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। ছবি: রয়টার্স

৩৩ বছর বয়সী মোহাম্মদ বিন সালমানকে এখন বলা হচ্ছে—সৌদি আরবের কার্যত মূল নেতা। তাঁর সিদ্ধান্তই সেখানে সব বলে বিবেচিত হয়। নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতিসহ ক্রাউন প্রিন্সের সামাজিক কিছু সংস্কারমূলক কাজ প্রশংসা কুড়ালেও বিরুদ্ধ মত প্রকাশকারীদের কঠোরভাবে দমনের দুর্নাম রয়েছে তাঁর। সৌদি ক্ষমতা এখন আরও কেন্দ্রীভূত, আরও নৃশংস, আরও অধৈর্য, আরও হঠকারী। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর জামাতা জারেদ কুশনারের সঙ্গে সুসম্পর্ক দেশটির মধ্যে আরও আস্থা এনে দিয়েছে যে, তারা যা খুশি তা–ই করতে পারবে।

ক্রাউন প্রিন্স প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বেও রয়েছেন। এ সময় ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের দমনে ইয়েমেন সরকারের পক্ষে যুদ্ধে সৌদি জোট নেতৃত্ব দেওয়ার পর পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। কাতারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেও দেশটিকে নতজানু করতে ব্যর্থ হয়েছেন যুবরাজ মোহাম্মদ। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের নামে সৌদি আরবের প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও রাজপরিবারের সদস্যদের আটক করেছেন। লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে পদত্যাগে বাধ্য করেছিলেন, পরে তা প্রত্যাহার করা হয়। নারী অধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার করেন এবং এ ঘটনায় কানাডা সমালোচনা করলে অতিমাত্রায় প্রতিক্রিয়া দেখান। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়গুলো এসব ঘটনায় নীরব থাকায় দিনে দিনে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন ক্রাউন প্রিন্স।

খাসোগি নিখোঁজের পর শুরু থেকেই তুরস্ক এ ঘটনায় সৌদি আরবকে দায়ী করেছে। তুরস্কের মতে, কনস্যুলেট ভবনের ভেতরেই খাসোগিকে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে সৌদি থেকে আসা ১৫ জন অংশ নেয়। তুরস্কের ‘ডেইলি সাবাহ’ খাসোগির ‘হত্যাকাণ্ডে’ জড়িত সন্দেহে আততায়ী দলের ১৫ জনের নাম ও ছবি প্রকাশ করেছে। দৈনিকটি বলছে, ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনস্যুলেটে প্রবেশের পর খাসোগিকে হত্যা করে ওই ব্যক্তিরা তুরস্ক ছেড়ে চলে যায়। ওই ব্যক্তিরা দুটি ব্যক্তিগত বিমানে করে রিয়াদ থেকে ইস্তাম্বুলে আসে।

২ অক্টোবর ইস্তাম্বুলে সৌদির কনস্যুলেটে প্রবেশের পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন খাসোগি। এই দিন ১৫ সৌদি নাগরিকও সেখানে প্রবেশ করে। তারা কনস্যুলেটে যাওয়ার আগে এর পাশের দুটি আন্তর্জাতিক হোটেলে ওঠে। কনস্যুলেটের অপারেশন শেষ করে ওই দিনই তারা তুরস্ক ত্যাগ করে। তাদের বহনকারী ব্যক্তিগত দুটি বিমান কায়রো ও দুবাই হয়ে রিয়াদের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।