Thank you for trying Sticky AMP!!

পথ চলার ২০ বছর

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার ২০ বছর পূর্তিতে আমার অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কথাটি উচ্চারিত হলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি সংগঠনের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদকে রুখে দাঁড়ানোর সংগ্রামে সাহসে বলীয়ান সেই সংগঠনটির কথা। “ছিন্ন ভিন্ন কর নিশ্চিহ্ন ঘাতকের ছাউনি” স্লোগান ধারণ করে অবিরাম সংগ্রাম করা একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের কথা। সেই কবে থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টিতে নিরন্তর সংগ্রাম করে যাচ্ছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। শুধু তাই নয় সব অশুভ শক্তি, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত সংগ্রামের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি সংকটে, জাতীয় দুর্যোগে মানুষের পাশে থেকেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। সব সময় থেকেছে প্রতিবাদের কাতারে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উদ্বেলিত মিছিলে। আর প্রবাসে বিশেষ করে নিউইয়র্কে এমনি একটি সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে সাংস্কৃতিক যোদ্ধা মিথুন আহমেদ ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকা। প্রবাসে পাড়ি দিয়ে এক সময়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সংগ্রামী সাথি নিষ্ক্রিয় না থেকে, কেবল নিজের ভাগ্য পরিবর্তনে নিবেদিত না থেকে নিউইয়র্কের বাংলাদেশি প্রবাসীদের সঙ্গে স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধসহ নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি, বাংলাদেশের গণ মানুষের শিল্প সংস্কৃতি, সাহিত্য সংগীত-চিত্রকলা, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং আন্দোলন সংগ্রামে বাংলাদেশের মূল ধারার সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থেকেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকা। বাংলাদেশের মূলধারার সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয় সম্পৃক্ততার প্রয়োজন ছিল অনেক আগেই। কারণ নিউইয়র্কে কমিউনিটির মধ্যে আঞ্চলিকতা, সংকীর্ণতা, দলাদলি, হানাহানি ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, অপসংস্কৃতির চর্চা ছিল। সেখানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকায় একটি সুস্থ নান্দনিক এবং রুচিশীল প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে সেখানে একটি সাংস্কৃতিক সুবাতাস বইয়ে দেয়।
সংস্কৃতি কোনো কুয়ার জল নয়। সংস্কৃতি একটি বহতা নদী, সংস্কৃতির সৌন্দর্য, চর্চায় আরও বহু গুণ বেড়ে যায়। প্রবাসে সংস্কৃতির বাণিজ্যিকীকরণের বিপরীতে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকা কাব্য চর্চা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চা, নৃত্য সংগীত, আবৃত্তিসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপ্তির মাধ্যমে একটি ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল উপহার দেয়। তাঁদের মানসম্মত অনুষ্ঠান, বিভিন্ন পরিকল্পনা, নান্দনিক সাজসজ্জা, রুচিশীল অনুষ্ঠান দর্শকদের আকৃষ্ট করে। বিশেষ করে প্রবাসের অন্যতম প্রধান কবি শহিদ কাদরী, আবৃত্তি শিল্পী কাজী আরিফসহ অনেক গুণী ও খ্যাতিমান বাঙালিদের নিয়ে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান প্রশংসিত হয়। এই সংগঠন সব সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিকদের সম্মান জানিয়েছে। প্রবাসে অবস্থানরত শব্দ সৈনিক রথীন্দ্রনাথ রায়, শহিদ হাসান, কাদেরী কিবরিয়াকে সব সময় সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত রেখে প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মশাল জ্বালিয়ে রেখে নিউইয়র্কে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে, যার ফলে প্রবাসে বাঙালি কমিউনিটির ভেতরে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে।
১৯৯৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিস্তৃত সময় দরে তাদের পথচলা। বিগত ২০ বছর ধরে তাদের কর্মময় ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে প্রবাসে তাদের সংগ্রামী চেতনার আলেখ্য। বাংলাদেশের মূলধারায় সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেও সংগঠনের আদর্শিক অবস্থানে অবিচল থেকেছে সব সময়।
এবার তারা তাদের সেই গৌরবময় ইতিহাস উদ্‌যাপনের জন্য ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসের জুইস সেন্টারে এক মিলনমেলার আয়োজন করেছে। কাকতালীয়ভাবে এবার আমার উত্তর আমেরিকা সফরের অংশ হিসেবে সেই মিলনমেলায় উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হচ্ছে। এতে আমি আনন্দিত।
এই সংগঠনের কথা লিখতে গিয়ে আমার মনে পড়ল পেছনের কথা। আমি প্রথম বিদেশ সফর করি ১৯৭৭ সালে আফগানিস্তানে। আর উত্তর আমেরিকা সফর করি ১৯৮৯ সালে। এখন নিউইয়র্ক যেন এক মিনি বাংলাদেশ। শ্রী অরবিন্দ ঘোষ তাঁর “নিউইয়র্ক নিউইয়র্ক” বইটিতে উল্লেখ করেছেন, রামনাথ বিশ্বাস যখন বিশ্ব ভ্রমণে বেরিয়ে বাগদাদ শহরে পৌঁছেছিলেন, প্রথম আলাপ হয়েছিল ওখানকার একমাত্র স্থায়ী বাঙালি অধিবাসীর সঙ্গে। তিনি নদী থেকে মাছ ধরে তাঁকে খাইয়েছিলেন, তারপর যখন যুক্তরাষ্ট্রে এলেন তখন হলিউডের এক বাঙালিও তাঁর জন্য রাজকীয় ভোজের আয়োজন করেছিলেন। সেই বিশ্বাস সাহেব আজ যদি নিউইয়র্কে আসতেন তাহলে আর একজন নয়, দেখা পেতেন এক বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে। সত্যি নিউইয়র্ক শহর সেই ১৯৮৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বিগত ৩০ বছরে বাঙালি সংখ্যায় এত বেড়েছে যে ভাবতে অবাক লাগে।
আজ এখানে অগণিত সংখ্যায় দুর্গাপূজা, সরস্বতী পূজা হয়। প্রতিটি বরোতেই রয়েছে মসজিদ। জুমার নামাজে ভিড় হয়। ঈদের জামাত হয় প্রতিটি মসজিদে। মুসল্লি বাড়ায় সম্প্রতি উন্মুক্ত মাঠেও ঈদের নামাজ হয়। টেগর সোসাইটি, কালচারাল অব নিউইয়র্ক, বাংলাদেশ সেন্টারসহ বিভিন্ন সংগঠনের অনুষ্ঠান লেগেই আছে। এখানকার বাঙালি গ্রোসারিতে লাউ, কুমড়ো, ঝিঙে, উচ্ছে, তাজা মাছ, জিরে, হলুদ, ধনে, লঙ্কা, ফল, শুঁটকি সবই পাওয়া যাচ্ছে।
১৯৯১-৯২ সালে নিজের দেখা নিউইয়র্কের চেহারা ভিন্নতর। ১৯৮৯তে প্রথম আমেরিকা সফরকালে নিউইয়র্কে যেমন দেখেছি, এবার আরও বেশি জমজমাট বিভিন্ন দিক থেকে। যেমন, তখন কেবল একটি অর্ধ মাসিক বাংলা পত্রিকা ছিল ‘প্রবাসী’ নামে। তারপরে তিনটা বাংলা সাপ্তাহিক যথাক্রমে ঠিকানা, বাঙালি, প্রথম আলো উত্তর আমেরিকাসহ এখন আরও বেশি পত্রিকা নিউইয়র্ক থেকে বের হয়। তখন একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক ও পরিচয় নামে একটি মাসিক বাংলা ম্যাগাজিন এবং বেতার জগৎ ও পদ্মার ঢেউ নামে দুটি রেডিও ছিল। রূপসী বাংলা নামে ছিল একটি টেলিভিশন। পাড়ায় পাড়ায় গ্রোসারি, হালাল মাংস আর ভিডিও ক্লাব। ছিল মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার মতো অগণিত ট্রাভেল এজেন্সি, অসংখ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, জেলা-উপজেলা নামে অনেক সমিতি। এই সব সমিতির নির্বাচন নিয়ে কত-না হইচই, প্রচার ও বিজ্ঞাপনের আড়ম্বর ও জৌলুশ যেন আমাদের দেশের নির্বাচনের যে কোনো ডামাডোলকে হার মানায়। পত্রিকার পাতায় প্রার্থীদের ছবি-সংবলিত জীবন বৃত্তান্ত দেখে সারা নিউইয়র্কবাসী হয়রান হয়ে যেত। এখনো এই অবস্থার কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন জেলা-উপজেলা সমিতি, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন এখনো পত্রিকার পাতা জুড়ে প্রচার ও বিজ্ঞাপনে তেমনই সোচ্চার। তার পাশাপাশি রয়েছে জালালাবাদ সমিতি, যারা সম্প্রতি বিশ্ব সিলেট সম্মেলন করেছে। অত্যন্ত ব্যয় বহুল এই আয়োজন কমিউনিটিকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
এ ছাড়া আমরা সবাই জানি ফোবানার কথা। তিন দশেকেরও অধিক কাল ধরে এই সংগঠন বিভিন্ন স্টেটে কখনো ঐক্যবদ্ধভাবে আবার কখনো দ্বিধাবিভক্ত ভাবে অবিরাম সম্মেলন করে যাচ্ছে। যেখানে দেশের ও প্রবাসের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অংশগ্রহণে উত্তর আমেরিকার বাঙালির সর্ববৃহৎ মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। আমার সৌভাগ্য হয়েছে ১৯৯২ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত অনেকগুলো ফোবানা সম্মেলনে সংগীত পরিবেশনার। সেই সুবাদে আমি উত্তর আমেরিকার কমিউনিটির অনেক ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, পেশাদার, অনেক সংগঠন ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের অনেক কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছে। এখানকার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছি। বিশেষ করে ২০১৪, ২০১৭ সালে নিউইয়র্কে বাংলাদেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সন্মানে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশনার পাশাপাশি জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের সুযোগ ঘটে। আমার মনে হয় নিউইয়র্কে আমার ৩০ বছরের পথ পরিক্রমার ইতিহাস এখানে তুলে ধরলে নিবন্ধ কেবলই দীর্ঘ হবে।
আমি কেন্দ্রীয় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের একজন সহসভাপতি, বাংলাদেশ গণ-সংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ও ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবে তাদের ২০ বছর পূর্তিতে অভিনন্দন জানাই। এই সংগঠনের আহ্বায়ক মিথুন আহমেদ, অন্যান্য কর্মকর্তা ও সশ্লিষ্ট শিল্পী কলা-কুশলীদের ধন্যবাদ জানাই। একুশে ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তাদের কাছে প্রবাসীদের মতো আমিও কৃতজ্ঞ। বিভিন্ন জাতীয় দুর্যোগে, বিভিন্ন সংকটে এই সংগঠন প্রবাসীদের মধ্যে যে চেতনার আলো জ্বালিয়ে রেখেছে তা আগামী প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। উত্তর আমেরিকায় তাদের পদচারণা, বিভিন্ন কর্মকাণ্ড কমিউনিটির মধ্যে এক সাংস্কৃতিক ঐক্যের সৃষ্টি করেছে। সে ঐক্য সাম্যের, সম্প্রীতির ও বাঙালির চেতনার। এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে উত্তর আমেরিকা সফরের সময়ে আমি সাংগঠনিকভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। বিশেষ করে ২০১৭ সালে নিউইয়র্কের জুইস সেন্টারে প্রয়াত কবি শহিদ কাদরীর স্মরণ সভায় সংগীত পরিবেশন করেছিলাম। আমার সঙ্গে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্য দুই সতীর্থ শিল্পী রথীন্দ্রনাথ রায় ও শহিদ হাসান। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার কাছে আমার প্রত্যাশা তারা যেন প্রগতির পক্ষে মুক্তির লক্ষ্যে অবিরাম এগিয়ে যায়। সেই অভিযাত্রায় আমি থাকব তাদের সহযাত্রী হয়ে।

লেখক: সভাপতি, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ