প্রথম বাংলাদেশি সিনেটর
আমেরিকার মধ্যবর্তী নির্বাচনে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ডিস্ট্রিক্ট-৫ থেকে ডেমোক্রেটিক দলের মনোনয়নে স্টেট সিনেটর নির্বাচিত হলেন বাংলাদেশি-আমেরিকান শেখ মোজাহিদুর রহমান। আমেরিকার যেকোনো পর্যায়ের আইনসভার সদস্য হওয়া প্রথম বাংলাদেশি বলা যায় তাঁকেই। এ ক্ষেত্রে ২০১০ সালে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য নির্বাচিত হওয়া হ্যানসেন ক্লার্কের কথা উঠতেই পারে। কিন্তু ক্লাক৴ থেকে রহমান অনেকটাই এগিয়ে, নিজের শৈশব বাংলাদেশে কাটানোর কারণে। বিপরীতে ক্লার্ক বাংলাদেশি বাবার সন্তান, যিনি কখনো বাংলাদেশকে নিজ চোখে দেখেনইনি।
শেখ রহমানের স্টেট সিনেটর নির্বাচিত হওয়াটা একরকম নিশ্চিতই ছিল। গত ২২ মে তিনি ডেমোক্রেটিক দলের বাছাই পর্বে ৪ হাজার ২ ভোট পেয়ে বিজয়ী হওয়ার পরই বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। কারণ ডেমোক্র্যাট আধিপত্যের ওই অঞ্চল থেকে রিপাবলিকান দল সাধারণত কোনো প্রার্থী দেয় না। এবারও তার ব্যত্যয় হয়নি। ফলে ডেমোক্রেটিক দলের প্রাথমিক বাছাইয়েই মূল নির্বাচনের আবহ বিরাজ করে। আর এই নির্বাচনে শেখ রহমান বিপল ব্যবধানে পরাজিত করেন দীর্ঘদিন ধরে আসনটি থেকে ডেমোক্র্যাটদের প্রতিনিধিত্ব করা কার্ট থমসনকে। ২২ মে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক বাছাইয়ে কার্ট থমসন পেয়েছিলেন ১ হাজার ৮৮৫ ভোট।
পুরো আমেরিকার বিচারে বাংলাদেশি বা বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিচারে শেখ রহমানকে যদি দ্বিতীয় অবস্থানে ঠেলে দেওয়া হয়ও, তারপরও একটি জায়গায় তিনি ঠিকই অনন্য। কারণ জর্জিয়ার ইতিহাসে তিনিই প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে অঙ্গরাজ্যটির স্টেট সিনেটে যাওয়ার গৌরব অর্জন করলেন। এখানে ক্লার্কের কথা একটু বলতে হয়। ক্লার্কের জন্ম হয়েছিল মিশিগানের ডেট্রয়েটে। বাবা ছিলেন বাংলাদেশি, যিনি ক্লার্কের মাত্র আট বছর বয়সে মারা যান। তিনি বেড়ে ওঠেন আফ্রিকান মায়ের সান্নিধ্যে। বাংলাদেশি বাবার পরিচয়টিকে তিনি গর্বভরে তুলে ধরলেও, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর সংযোগটি কম। তুলনায় শেখ রহমান পুরোদস্তুর বাংলাদেশি, যিনি চার বছর আগে স্টেট সিনেটর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অল্প ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন। তা না হলে চার বছর আগেই উদ্যাপনের এই মুহূর্ত পেত বাংলাদেশিরা।
এবারের বাছাইপর্বে বিজয়ী হওয়ার পর শেখ রহমানের এই বিজয়কে মার্কিন রাজনীতির জন্যই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছিলেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের এই অভিবাসনবিরোধী বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে শেখ রহমানের জয় একটি বড় জবাব। নির্বাচনী প্রচারের সময়ও শেখ রহমান তাঁর অভিবাসী পরিচয়টি ভুলে যাননি। তিনি নির্ভয়ে ও সোচ্চারে নিজের অভিবাসী পরিচয়টি সবার সামনে তুলে ধরেছেন। গভর্নর নির্বাচনে রিপাবলিকান দলের প্রার্থী যখন অভিবাসন প্রশ্নে মেরুকরণ করছিল, তখন তিনি অভিবাসনের পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রচার চালান। বর্তমান প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বেছে নেন, ‘এবার আমাদের পালা’ স্লোগানকে।
শেখ রহমানের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায়। তিনি আমেরিকায় আসেন ১৯৮১ সালের ৭ জানুয়ারি। সরকারি কর্মকর্তার সন্তান শেখ রহমান বাংলাদেশে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্নের পর আমেরিকায় এসে ভর্তি হন সেন্ট্রাল পিডমন্ট কমিউনিটি কলেজে। সে সময় তিনি নর্থ ক্যারোলাইনা রেস্টুরেন্টে ডিশওয়াশারের কাজ করতেন। ঘণ্টায় আয় হতো ৩ ডলার ৩৫ সেন্ট করে। এই কাজ তাঁকে একই সঙ্গে কলেজের পড়াশোনা অব্যাহত রাখা ও ইংরেজিতে দখল আনতে সাহায্য করে। আমেরিকায় আসার ১৪ বছর পর ১৯৯৫ সালে শেখ রহমান আমেরিকার নাগরিকত্ব পান। এই সময়র মধ্যে জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিকস অ্যান্ড গ্লোবাল স্টাডিজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। এই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার সময়ে তিনি স্টুডেন্ট সিনেটর নির্বাচিত হন। একই সময়ে গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, যা তাঁর নেতৃত্বগুণের স্মারক বহন করে।
সিবিএস৪৬-এ দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ রহমান জানান, আমেরিকায় আসার পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় সংগঠন ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তিনি। শার্লোৎসের মেয়র এডি নক্সের হয়ে নির্বাচনী প্রচারও করেছেন। এভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রার্থীর হয়ে প্রচারকাজে অংশ নিলেও নিজে কখনো প্রার্থী হওয়ার কথা ভাবেননি। এই ভাবনা তার মাথায় প্রথম আসে বারাক ওবামার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে।
একজন অভিবাসী হিসেবে মূলধারার নির্বাচনে আসাটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন শেখ রহমান। তাঁর মতে, ‘একজন অভিবাসী হিসেবে আমাদের নিজস্ব কণ্ঠ থাকা উচিত। বাইরে থেকে আমরা কিছু করতে পারব না। আমাদের ক্ষমতা কাছে যাওয়া প্রয়োজন। আলোচনার টেবিলে আমাদের আসন দখল করতে হবে। আমি শুধু ওই টেবিলের একটি আসন নিজের করে নিয়েছি।’
এই সাফল্যের কারণ হিসেবে তিনি ভোটারদের ঠিকঠাকভাবে উদ্দীপ্ত করার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘ভোটাররা আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল। তারা মনে করত, তাদের ভোটে কিছু হবে না। আমার কাজ ছিল তাদের এটা বোঝানো যে, তাদের ভোট কতটা জরুরি। তাদের ভোটেই সব নির্ধারণ হবে, এই আস্থাটা ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। ফলে তারা কেন্দ্রে এসেছে।’
রহমান জানেন, তাঁর জন্য অনেক বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করে আছে। কিন্তু তিনি প্রস্তুত। ড্রিমার খ্যাত তরুণ অনিবন্ধিত অভিবাসী, অবৈধ অভিবাসী থেকে শুরু করে আমেরিকা থেকে বহিষ্কারের শঙ্কায় থাকা মানুষদের অধিকার রক্ষায় তিনি কাজ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। শেখ রহমান এই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় সফল হবেন বলেই প্রত্যাশা সব বাংলাদেশির।