Thank you for trying Sticky AMP!!

বার্ধক্য, নিঃসঙ্গতা ও নিরাপত্তাবোধ

বাঙালি মধ্যবিত্তের ছোট ছোট পরিবারগুলোর জীবনে কিন্তু বহুদিন ধরেই সুখের চেয়ে নানা শঙ্কার ছায়া ক্রমশ গাঢ় হয়েছে। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক দোলাচল, শিক্ষায় অব্যবস্থা, সমাজে নৈরাজ্য, কর্মসংস্থানের অভাব ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনা সেই শঙ্কার একটা দিক হতে পারে। গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী, আর এক বা দুই সন্তান-এমন ছোট মধ্যবিত্ত সংসারে এ ধরনের শঙ্কা যে অপেক্ষাকৃত গাঢ় হবে, তাও বলার অপেক্ষা রাখে না।
বেশ কয়েক বছর ধরে একের পর এক বিভীষিকাময় ঘটনায় মধ্যবিত্ত ছোট পরিবারগুলো এক ধরনের শঙ্কার বৃত্তে ঢুকে পড়েছে। জ্ঞাত-অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে নির্মম মৃত্যু চিন্তা যেন পেয়ে বসেছে সামাজিক এই শ্রেণিকে। এ শঙ্কা বেশি করে গ্রাস করছে নগর-মহানগরে বহুতলবন্দী ছোট পরিবারের বয়স্ক মানুষকে। আততায়ীর নিষ্ঠুর হাত এড়িয়ে জীবনের শেষটুকু নির্বিঘ্নে কাটানো যাবে কি না, এই প্রশ্নই এখন নিঃসঙ্গ বার্ধক্যের সামনে সবচেয়ে বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ বেশ কয়েক বছর ধরেই দুর্বৃত্তদের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছেন এই বয়স্ক নিঃসঙ্গ মানুষেরা। ফ্ল্যাটে বা বাড়িতে স্বামী-স্ত্রী মিলে থাকেন, ছেলে-মেয়েরা চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জন্য ভিনদেশে থাকে—এমন পরিবারের দিকেই খুনে বদমাশদের ঝোঁক বেশি। উদ্দেশ্য, কখনো টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি লুট, কখনো সংশ্লিষ্টের জমি-বাড়ি, ফ্ল্যাট দখল। আর যা সবচেয়ে লক্ষণীয় তা হলো এমন সব খুনের ঘটনায় জড়িতরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিহত হতভাগ্যদের বিশেষ পরিচিত বা আত্মীয়স্বজন।
পুলিশ বয়স্ক মানুষকে ঠিকমতো নিরাপত্তা দিতে পারছে না। তাই একের পর এক এমন মর্মান্তিক সব ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ অনেকের। কিন্তু সত্যিই কি এভাবে হাজার হাজার, লাখ লাখ প্রায় নিঃসঙ্গ মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? আমাদের দেশের নিরাপত্তা পরিকাঠামো কি ততটা শক্ত? এই কোটি-কোটি মানুষের দেশে তেমন পুলিশি বন্দোবস্ত কি আদৌ সম্ভব? প্রতিশ্রুতিতে ওস্তাদ স্বেচ্ছাসেবীদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। ওরা নাকি নিজেদের উন্নতি চিন্তায় বয়স্ক বাবা-মায়েদের অবহেলা করছেন; তাই এমন সব নির্মম ঘটনা ঘটছে। এটাও সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। বিদেশে বা দেশে যাঁরা চাকরি বা পড়াশোনার সূত্রে থাকেন, তাঁদের বাধ্যবাধকতাটাও ভাবতে হবে। হুট করে বললেই কি কাজকর্ম ফেলে আসা যায়? কর্মসংস্কৃতিটা সর্বত্র এক রকম ভাবলে তো চলে না।
আসলে যেদিন থেকে একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত সংসারে ভাঙন ধরল বড়-মেজো-ছোটরা আলাদা আলাদা আবাস গড়ল, পরিবারের গুরুজনদের দূরে রেখে নিজের বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে আলাদা সংসারের স্বাধীনতা এবং সামান্য আয়েও এক ধরনের সচ্ছলতার স্বাদ পেতে শুরু করল, বয়োজ্যেষ্ঠদের এ অসহায় নিরাপত্তাহীনতার শুরুও সেদিন থেকে ঘটেছিল। তারপর সময় যত এগিয়েছে পরিবারগুলো তত ছোট হয়েছে। একদিন যাদের অঙ্গুলি হেলনে পরিবার চলত, তাঁরাই ক্রমশ গুরুত্ব হারিয়ে সরে যেতে থাকলেন সংসারের প্রান্তসীমায়।
সব মিলিয়ে বয়স্কদের চারপাশ থেকে একটু একটু করে সরে যেতে লাগল পারিবারিক বাঁধনের সূত্রগুলো। এক একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো ফ্ল্যাটে-বাড়িতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা ভেসে বেড়াতে লাগলেন। আর তাঁদের সম্পত্তি জমি-বাড়ি হয়ে উঠতে লাগল মূর্তিমান বিপদ। সত্যি বলতে কি পরিবার যত ছোট হচ্ছে, নিঃসঙ্গতাও প্রবীণদের তত গ্রাস করছে। আর এই নিঃসঙ্গতার মধ্যেই রয়েছে তাঁদের অনিরাপত্তাবোধের মূল কারণটি। একে বাদ রেখে কোনো নিরাপত্তা পরিকল্পনাই তাই কাজ করবে না।