Thank you for trying Sticky AMP!!

বিদেশের মাটিতে স্বদেশ অন্বেষণ

বাংলাদেশের বাইরে বিশ্বের প্রায় সকল দেশে ছোট্ট এক বাংলাদেশ ক্রমশ গড়ে উঠছে। সে বাংলাদেশ সংস্কৃতির বাংলাদেশ। পৃথিবীব্যাপী গড়ে ওঠা ছোট্ট বাংলাদেশের মধ্যে নিউ ইয়র্ক-লন্ডনে সবচেয়ে বেশি জীবনের স্পন্দন দেখি। মুষ্টিমেয় ক’জন ছাড়া প্রায় সব প্রবাসী বাঙালি ইতিহাস-ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আশ্রিত সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক বা সৃজনকারী।
দলীয় রাজনীতি মাঝেমধ্যে ছন্দপতন ঘটায় বৈকি! কিন্তু উৎসব উদ্‌যাপনের তোড়ে ভেসে যায় সে সংশয়।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বা সমমনা সংগঠনগুলো বিদেশে আমাদের সংস্কৃতির মূল পৃষ্ঠপোষক-সৃজনকারী। তাদের নিরন্তর চর্চা ও কর্মমুখরতায় প্রবাসীদের সৃষ্টিশীল সাংস্কৃতিক শিল্পকর্ম আজ বিদেশের মাটিতে স্বদেশ অন্বেষণ। উত্তর আমেরিকা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট সাহস, সফলতা ও সৃষ্টিশীলতার ২০ বছর উদ্‌যাপন করছে। এ উদ্‌যাপনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রবাসী সংস্কৃতিকর্মীদের শ্রম মেধা ও নিদ্রাহীন দিবস-রাত্রির নোনা স্বাদ।
উত্তর আমেরিকা সাংস্কৃতিক জোট গঠনের অব্যবহিত কাল, ২০০১-এ এক দুঃসময়ের মুখোমুখি বাংলাদেশ। ‘নির্বাচন ২০০১’ উত্তীর্ণ দাঙ্গা পরিস্থিতিতে বিপন্ন বাংলাদেশ। সংখ্যালঘুদের হত্যা, তাদের গৃহ-সম্পত্তিতে অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণের মতো ঘটনায় বিপর্যস্ত। নির্বাচনে পরাজিত দলের কর্মী-সমর্থকদের ওপর নজিরবিহীন নির্যাতনে পুরো বাংলাদেশ হতবিহ্বল! সেই প্রতিকূল সময়ে ঢাকাসহ সারা দেশের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতৃত্বে সংস্কৃতি কর্মীরা এই অপশক্তিকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মানব বন্ধন, সমাবেশ, পদযাত্রার মধ্য দিয়ে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখন নিউইয়র্ক সাংস্কৃতিক জোট এবং লন্ডনের সংস্কৃতি কর্মীরা যুগপৎ কর্মসূচি দিয়ে বিশ্ব জনমতকে নির্যাতন হত্যার বিরুদ্ধে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিল। পরে ধারাবাহিক ভাবে নিউইয়র্ক জোট মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে লাগাতার কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সৃজন ও প্রতিবাদের যুগলবন্দী তৈরিতে সক্ষম হয়। সৃষ্টিশীল এ ধারায় নিউইয়র্ক তথা পুরো উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন শহর নেচে ওঠে।
নাটক, সংগীত, আবৃত্তি, নৃত্য, সাহিত্যসভার নিয়মিত চর্চায় উত্তর আমেরিকাসহ ইউরোপ অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহর যেন হয়ে ওঠে খুদে বাংলাদেশ। সে বাংলাদেশে দলীয় রাজনীতি নয়, বাংলার চিরায়ত সুর, ছন্দ, গদ্য ও কবিতার স্বপ্ন জাগানিয়া সংস্কৃতির বাংলাদেশ। সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা কোটি বাঙালি তাদের পেশা বা রুটিরজির গোলক ধাঁধায় আবদ্ধ থাকল না। বাঙালি সংস্কৃতির প্রেম, সহমর্মিতা ও প্রত্যাখ্যানের শক্তির ওপর ভর করে যন্ত্রসভ্যতার নগ্ন চাপ ও পেশার সীমাহীন বিধিনিষেধ, বিরূপ প্রাকৃতিক আবহাওয়া উপেক্ষা করে সংস্কৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে আমাদেরই প্রবাসী স্বজন–বন্ধুরা। নিজ বাসভূম থেকে যোজন যোজন মাইল দূরে বাংলার কাদা জলের স্পর্শ তো মেলে না কিন্তু সংস্কৃতির বুকের ভেতর যে জলকাদার ঘন অবস্থান তা তো বাংলার সত্যিকার জলকাদার স্পর্শ দিয়ে যায় বিদেশ বিভুঁইয়ে তৃষিত মনকে। সেই মানুষের মন প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির হিসেব করে না। শুধু একবুক ভালোবাসা বিলিয়ে দেয় দেশ ও মানুষের প্রতি।
এই সহস্রাব্দের প্রথম অর্ধযুগ ধর্মান্ধ রাজনীতির উলম্ফনকালে সব অমানবিক ঘৃণিত কাজের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অবস্থানকারী সংস্কৃতি কর্মীদের পাশাপাশি নিউইয়র্কে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকা নিরবচ্ছিন্ন রাজাকার আলবদর ও ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে সাহসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত করে। নিউইয়র্কসহ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গড়ে ওঠা সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহ এই প্রতিবাদী চরিত্র এখনো বহাল রেখেছে। তবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতে হবে।
২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলনে নিউইয়র্ক, লন্ডনসহ বাঙালি অধ্যুষিত পৃথিবীর সব শহরের মানুষ এক বীরোচিত ভূমিকা পালন করে। জাতিসংঘের সদর দপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত হওয়ার কারণে নিউইয়র্কে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট উত্তর আমেরিকার ভূমিকা বিশ্ব জনমত গঠনে অনিবার্য ছিল, যা পালনে নিউইয়র্ক সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট শতভাগ সফল হয়েছিল।
আন্দোলনমুখী কর্মসূচি ছাড়াও শিল্প–সংক্রান্ত সেমিনার, নিয়মিত প্রকাশনা, জাতীয় দিবস, বিশেষ করে নববর্ষ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসে সমসাময়িক রুচির সঙ্গে সংগতি রেখে অনুষ্ঠান নির্মাণে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহ্বায়ক মিথুন আহমেদ ও তাঁর সহকর্মীদের পারঙ্গমতায় আমি মুগ্ধ হয়েছি।
সময়োপযোগী অনুষ্ঠান পরিকল্পনা ও পরিবেশনা, এবং নূতন প্রজন্মের আগ্রহ তৈরি করে তাঁদের সম্পৃক্ত করার মধ্য দিয়ে আমাদের বাঙালির বিশ্ব মানব হওয়ার যে সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় আমরা সমবেত, তা অভীষ্ট লক্ষ্যে নিশ্চিত পৌঁছে যাবে।
উত্তর আমেরিকা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের দু’দশকের পথচলার বিরল সাফল্য ও আগামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রত্যয়ের মধ্যই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সম্ভাবনার নূতন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
জয় বাংলা ও বাঙালির। জয় হোক বিশ্ব মানবের।

লেখক: নাট্যজন, সভাপতি, গ্রাম থিয়েটার