Thank you for trying Sticky AMP!!

বেকারত্বকে অস্ত্র বানাচ্ছেন ট্রাম্প

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প

পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না এলেও ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন খাতের ব্যবসা–বাণিজ্য চালু করার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে মার্কিন প্রশাসন। অর্থনীতি চালু করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন উঠেপড়ে লেগেছ আগে থেকেই। এ লক্ষ্যে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বিক্ষোভেও উসকানি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা। একই সঙ্গে নিউইয়র্কের মতো যেসব অঙ্গরাজ্য তাঁর এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে, সেসব অঙ্গরাজ্যের ক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য দেওয়া ফেডারেল সরকারের মানবিক সহায়তার বরাদ্দ ছাড় করায় বিলম্ব করা হচ্ছিল। উদ্দেশ্য, মানবিক সহায়তা না পেয়ে ভয়াবহ আর্থিক সংকটে পড়া নাগরিকদের দিক থেকে চাপের মুখে অর্থনীতি চালুর ফেডারেল সিদ্ধান্তের বিষয়ে একমত হবে স্থানীয় প্রশাসন।

সর্বশেষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ বিজ্ঞানীদের নিয়ে গড়া একটি দল অর্থনীতি চালু করলে সম্ভাব্য ক্ষতির একটি হিসাব করেছে। এতে দেখা গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি চালু করে দিলে লাখো মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে। কিন্তু তারপরও ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন অর্থনীতি চালুর সিদ্ধান্তে  অটল। কারণ আর কিছুই নয়; নির্বাচন। বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে খুলে দিতে চায় প্রশাসন।

নিউইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, আগামী ১০ দিনের মধ্যে মোড়কজাত মাংসের কারখানাগুলো খুলে দিতে চায় প্রশাসন। এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী সনি পারডু সম্প্রতি ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হওয়া এক বৈঠকে বলেছেন, ফাস্ট ফুডের ব্র্যান্ডগুলো এবং গ্রোসারিগুলোতে মাংস সরবরাহের সংকট রয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে এই সংকটের নিরসন হতে হবে।

ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইওয়া অঙ্গরাজ্যের রিপাবলিকান গভর্নর কিম রেনল্ডস। বৈঠকে রেনল্ডস বলেন, ‘আমার মনে হয়, আমাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এক সপ্তাহ বা ১০ দিনের মধ্যেই আমাদের এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে হবে।’

প্রক্রিয়াজাত মাংসের কারখানাগুলোয় অনেক কর্মী একসঙ্গে কাজ করে। ফলে এসব কারখানা ভাইরাসের বিস্তারের জন্য মোক্ষম জায়গা। এরই মধ্যে বিভিন্ন মাংস কারখানার বহু কর্মী ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। ফলে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। এতে মাংসের সরবরাহের পাশাপাশি হ্যামবার্গারের মতো বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রীর উৎপাদন ভয়াবহভাবে ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় ট্রাম্প প্রশাসন গেল সপ্তাহে এক নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে মাংস প্রক্রিয়াকরণ ও মোড়কজাত করার কারখানা খোলা রাখার নির্দেশ দেয়। আদেশে এমনকি এও বলা হয় যে, এর জন্য যদি শ্রম আইন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভাঙার প্রয়োজন পড়ে, তবে তাও যেন আদেশ মানা হয়।

অথচ এরই মধ্যে এই খাতটির সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের একটি বড় অংশ করোনায় আক্রান্ত। আইওয়া অঙ্গরাজ্যের টাইসন পর্ক প্রসেসিং ফ্যাসিলিটির কথাই বলা যায়। প্রতিষ্ঠানটির ২ হাজার ৮০০ কর্মীর মধ্যে ৪০০ জন এরই মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছে। আক্রান্তদের মধ্যে অনেকে মারাও গেছেন। বর্তমানে কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। কিন্তু নির্বাহী আদেশের জেরে তা খুলে দিতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অনেক শ্রমিকের জীবন হুমকির মুখে পড়বে।

শুধু এ খাত কেন, ট্রাম্প প্রশাসনের তোড়জোড়ের কারণে এরই মধ্যে বেশ কিছু খাত কার্যক্রম চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে।  এর মধ্যে রয়েছে গ্যাপ, ওল্ড নেভি, বানানা রিপাবলিক, অ্যাথলেটার মতো ব্র্যান্ড। গ্যাপ ৬ মে জানিয়েছে, তারা উত্তর আমেরিকায় নিজেদের ৮০০টি বিক্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। গ্যাপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা  (সিইও) সোনিয়া সিনগাল নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেরই নিজেদের মতো করে নিজেদের ব্যবসা পুনরায় চালুর বিষয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। গ্যাপ সে পরিকল্পনাটি সম্পন্ন করেছে। এখন যেসব জায়গায় সুযোগ থাকবে, সেখানেই বিক্রয়কেন্দ্র চালু করা হবে। চলতি সপ্তাহেই টেক্সাসে হয়তো প্রথম বিক্রয়কেন্দ্র চালু করা হবে।

শুধু গ্যাপ কেন, গত সপ্তাহে একই ধরনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে মেসি’স, ব্লুমিংডেলস, ব্লুমারকারির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় মল অপারেটর প্রতিষ্ঠান মেসি’স গত ৩০ এপ্রিল জানিয়েছে, তারা আগামী ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে নিজেদের ৭৭৫টি বিক্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে।

এভাবে বিভিন্ন খাত চালু হওয়াটা একই সঙ্গে শঙ্কার ও আশার। কারণ, এই চালু হওয়াটা যেমন প্রচুর মানুষকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে ফেলবে, তেমনি এর মাধ্যমে অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা ব্যক্তিরা কিছুটা হলেও সুরক্ষা পাবে। কারণ, সরকারি যে সহায়তার কথা বলা হয়েছে, বা যে বেকারভাতার কথা বলা হয়েছে, তা কেবল আনুষ্ঠানিক খাতে কাজ করা ব্যক্তিরাই পাবে বা পাচ্ছে। ফলে একটি বিরাট অংশ বাদ পড়ে যাচ্ছে, যারা নানা আইন-কানুনের জেরে কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতাতেই পড়ে না। এই লোকগুলোর জীবনধারণের কষ্টটা কমে আসবে নিঃসন্দেহে।

করোনাভাইরাসের কারণে এরই মধ্যে বিভিন্ন খাত ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, আমেরিকা ১৯৩০-এর মহামন্দার মতো এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে এরই মধ্যে পড়ে গেছে। সম্প্রতি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ করা আর্থিক হিসাব এই কথাটিকেই সমর্থন করছে।

৬ মে অ্যাপভিত্তিক রাইড-শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম লিফট জানায়, গত প্রান্তিকের চেয়ে এই প্রান্তিকে আয় ৬ শতাংশ কমে গেছে। গত মাসে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান হয়েছে ৩৯৮ মিলিয়ন ডলার। একই ধরনের আরেক প্রতিষ্ঠান উবার জানিয়েছে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় তারা নিজেদের কর্মীবহর ২০ শতাংশ ছেঁটে ফেলবে। নিউইয়র্ক টাইমসের অবস্থা অবশ্য কিছুটা ভিন্ন। তারা জানিয়েছে, তাদের পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে। ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। তবে পাল্লা দিয়ে কমছে বিজ্ঞাপন। দ্বিতীয় প্রান্তিকে আগের প্রান্তিকের চেয়ে ৫৫ শতাংশ বিজ্ঞাপন কমে যেতে পারে বলে সতর্ক করেছেন প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী মার্ক থম্পসন। বিক্রি কমে গেছে বিএমডব্লিউসহ বড় বড় কোম্পানিগুলোর। সবচেয়ে বাজে দশা রেস্তোরাঁ ও হোটেল খাতের। এই পরিস্থিতিতে অর্থনীতি একটু একটু করে চালু করাটা অনেকের বেঁচে থাকার রসদ জোগাতে পারে। কিন্তু এমন পদক্ষেপের জন্য চাই যথাযথ প্রস্তুতি।

এই প্রস্তুতির কথাই বিশেষজ্ঞরা বারবার করে বলছেন। এখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানেন যে, প্রস্তুতি ছাড়া অর্থনীতি চালু করাটা কতটা জনঘাতি হতে পারে। এমনকি এমন একটি সিদ্ধান্তের কারণে লাখো মানুষ মারা পড়তে পারে। কিন্তু তারপরও তিনি কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে যেনতেনভাবে হলেও সব চালু করতে চান। তাঁর মনোভঙ্গিটি মাংস প্রক্রিয়াকরণ কারখানা চালুর জন্য যে আদেশটি দেওয়া হয়েছে সেখানেই পরিষ্কার।

ডোনাল্ড ট্রাম্প এই মুহূর্তে শুধু নিজের পুনর্নির্বাচন নিয়েই ভাবছেন। না হলে তিনি দেখতেন যে, এভাবে অর্থনীতি চালু করলে শুধু নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়াতেই দিনে ৩০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। দেখছেন না বলেই তাঁর প্রশাসনের দুই শীর্ষ কর্মকর্তা সিএনএনকে জানান যে, এসব পূর্বাভাসে হোয়াইট হাউসের মতের বদল হবে না।

এত এত সতর্কতার পরও ৫ মে নিউইয়র্ক পোস্টে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, ‘আমার মনে হয়, তারা (মার্কিন নাগরিকেরা) ভালো বোধ করতে শুরু করেছে। সবকিছু আবার খুলে দেওয়া হচ্ছে। মনে হয়, আমরা কোটি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছি। তোমাকে সাবধান হতে হবে, এবং তোমাকে কাজেও ফিরতে হবে। মানুষ চায় সবকিছু চালু হোক। এখন পর্যন্ত ৩৮টি অঙ্গরাজ্য অর্থনীতি চালুর জন্য প্রস্তুত বা তার কাছাকাছি রয়েছে।’

ডোনাল্ড ট্রাম্প যে সাবধানতার কথা বললেন বা কাজে ফেরার প্রয়োজনীয়তার কথা বললেন, তা খুবই সত্য। কিন্তু এটি তখনই যৌক্তিক হবে, যখন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রশাসন সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে। সাধারণ মানুষ অন্তত প্রশাসনের ওপর এই আস্থাটা পাচ্ছে না বলতে হবে। ৫ মে প্রকাশিত ওয়াশিংটন পোস্ট ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক জরিপের ফলে দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী সাধারণ আমেরিকানদের মধ্যে ৫৬ শতাংশ গ্রোসারির জন্য বাইরে যেতে রাজি রয়েছে। তবে ৬৭ শতাংশ খুচরা দোকানে যেতে অস্বস্তি বোধ করছেন। আর ৭৮ শতাংশ বলছেন, তাঁরা কোনো রেস্তোরাঁয় বসে খেতে প্রস্তুত নন।

এই জরিপের ফল কিন্তু প্রেসিডেন্টের ভাষ্যকে খারিজ করে দেয়। এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়েও নিজের সিদ্ধান্ত আরোপের চেষ্টা এবং অর্থনীতি ফের চালুর মতো জরুরি পদক্ষেপের সময় সাধারণ মানুষকে নিয়ে করা মিথ্যাচার ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। প্রশাসনের এ ক্ষেত্রে অর্থনীতি চালু করতে হলে, কেন করা প্রয়োজন এবং তা কীভাবে চালু করা হবে, সে বিষয়ে সমন্বিতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। একই সঙ্গে এসব সিদ্ধান্ত জনপরিসরে জানিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। মানুষ চাইছে বলে নিজের সিদ্ধান্ত আরোপের ফল ভালো হয় না কখনোই।