Thank you for trying Sticky AMP!!

ভালোবাসা ছাড়া আর কী নাম দেবে তুমি...

১.
মানুষ তার নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারে না। অক্ষমতা কখনো কখনো পীড়াদায়ক হয়, হতাশার হয়। মেধা জিনিসটা মানুষের ডিএনএর ভেতরেই প্রোথিত থাকে। ইচ্ছে করলেই মেধাবী হওয়া যায় না। আমি কিছু মেধাবী না, আমি হচ্ছি আবেগী। মানুষ চেষ্টা করে অনেক কিছু অর্জন করতে পারে। অসাধ্য–সাধন করতে পারে। পাহাড় ডিঙাতে পারে, দিতে পারে অকুল সমুদ্রপাড়ি। আমি আমার নিজের ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কিছু করতে পারি না, এমনকি আমার যতটুকু ক্ষমতা আছে সেটুকুরও সদ্ব্যবহার করতে পারিনি। এর কারণ হচ্ছে আমার চেষ্টার ঘাটতি। আমার সবকিছুর মধ্যে আবেগ জড়িত। আমি যখন ভালোবাসি আবেগ দিয়ে বাসি, সম্পর্ক রচনা করি আবেগ দিয়ে। আমি লিখিও আবেগতাড়িত হয়ে। প্রতিটি মানুষের রয়েছে সৃষ্টিশীল ক্ষমতা। কিন্তু প্রতিটি মানুষের আবেগ এক রকম না। দুঃখ কষ্টের অনুভূতিও সমান না। সবাই ভালোবাসার জন্য জীবন দেয় না। হিসেবি ভালোবাসা কিছু দিতে পারে না। আবেগ নিয়ন্ত্রণ যারা করতে পারে, তাদের ভুল কম হয়। আমি ভুল করি কারণ আমার আবেগ বেশি।
ফিরে যাওয়ার আগে আমি একটু আউলা–ঝাউলা সময় কাটাই সব সময়। আমার মধ্যে একটা বিষাদ ভর করে থাকে। গন্তব্যে ফেরার সময় ঘনিয়ে এলেই এমনটা হয় আমার, প্রতিবারই হয়। আমার কাছে সম্পর্কগুলো আলগা না বলে যেকোনো চলে যাওয়া আমার জন্য মৃত্যুর মতো যন্ত্রণাদায়ক। বাস্তবতা আর আবেগ মিলেমিশে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করে। এসবের হয়তো অন্যের কাছে মূল্য নেই। আমি ফিরে যাওয়ার পর আমার জন্যও কারও কারও হৃদয়ে কষ্ট দানা বাঁধবে, কিন্তু আমি সেটা জানব না। বাড়ির বিড়ালটির জন্যও আমার মন কাঁদবে। একটি শিশুর জন্যও আমি কষ্ট পাব, মিস করব সবকিছু। গভীর রাতে ঘুম ভেঙে স্মৃতিগুলো হামলে পড়বে। মা–বাবার কথা মনে পড়বে, ভাইবোনের কথা মনে পড়বে, বন্ধুদের কথা মনে পড়বে। আমার লেখার পাঠক, লেখক ও প্রকাশক বন্ধুদের কথা মনে পড়বে। যখন আমি দেশে আসি তখন মনে পড়ে আমার অর্ক, অরিত্রি বা জেসমিনের কথা। এটাই আবেগ।

২.
আমার স্মৃতিশক্তি তেমন প্রখর না হলেও আমার অনেক পুরোনো দিনের কথা মনে থাকে, তেমন গুরুত্বপূর্ণ না তাও মনে থাকে, যা অন্যেরা ভুলে যায় তাও মনে থাকে। কিন্তু নিকট অতীতের অনেক কিছু মনে থাকে না। আমি মানুষের চেহারা সহজে ভুলি না, আগে কোথাও দেখেছি, কথা হয়েছে, এক সঙ্গে ওঠাবসা করেছি ঠিকই, কিন্তু প্রায়শই তার নাম মনে থাকে না। খুব কাছের মানুষের নামও হঠাৎ হঠাৎ ভুলে যাই। এটা খুবই বিব্রত করে আমাকে। চেনা মানুষের সঙ্গে অকস্মাৎ দেখা হলে, তার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকি। মানুষটি বুঝতে পারেন যে, কিছু একটা গড়বড় আছে।
কি চিনতে পারছেন না তো!
আমি অতিশয় লজ্জিত হয়ে বলি, না না চিনেছি। কেমন আছেন!
মনের গভীরে হাতড়ে বেড়াই কোথায় দেখেছি তাকে! চেনা লাগছে খুব, কিন্তু মনে করতে পারছি না কেন! কী স্টুপিড আমি। কিছুই মনে থাকে না!
ফেসবুক বন্ধুদের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও প্রকট। এই তো সেদিন এক অনুষ্ঠানে গেছি, একজন স্যুটেড–ব্যুটেড দারুণ সুদর্শন ভদ্রলোক আমাকে দেখেই বললেন, জসিম ভাই কেমন আছেন!
আমিও মানুষটিকে চিনেছি, নামও জানা। অথচ মনে করতে পারছি না। কী যেন নাম! কী যেন..। একদম জিবের ডগায় নামটা এসে থমকে আছে। এমন সুন্দর মানুষ অথচ দরকারের সময় নামটা মনে পরছে না! এর চেয়ে লজ্জার কী আছে!
মনে হয় চিনতে পারেননি! সমস্যা নাই।
আমি আমতা-আমতা করে বলি চিনিছি তো!
নাম বলেন। আপনাকে বলতে হবে।
মনে মনে বলি, আল্লাহ তুমি আমাকে মানুষটার নাম মনে করিয়ে দাও। কিন্তু আল্লাহ আমার কথা শোনে না।
নামটাই শুধু মনে নাই..।
তখন তিনি নাম বলেন।
ওহ গড! এই নাম আমি ভুলে গেলাম কীভাবে! এত চেনা মানুষ, কতবার ইনবক্সে কথা হয়েছে। আমার লেখায় সব সময় লাইক দেন।

৩.
তিনি স্ত্রীকে রেখে আমার পাশে এসে বসলেন। গল্প জুড়ে দিলাম আমরা। আমি যেমন স্বচ্ছন্দে লিখতে পারি, মুখোমুখি গল্পে তা পারি না। আমার কথার মজুত অনেক কম। তাও প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য এলেবেলে কথা চালিয়ে যাই।
তিনি বললেন, আমি আপনার স্ত্রী, ছেলেমেয়ে সবার নাম জানি। ওদের অনেক চেনা মনে হয়। আপনি ওদের কথা এতবার লিখেছেন, মনে হয় ওদের চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। জেসমিন, অর্ক, অরিত্রি যেন এক একটা চেনা চরিত্র।
আমি তখন একটা গল্প শোনালাম তাকে। গত বছর জেসমিন টরন্টো থেকে ঢাকা আসছে। আবুধাবি থেকে ঢাকার ফ্লাইটে উঠবে। হাতে দুটো ব্যাগ। একজন নারী যাত্রী তিনিও ঢাকা যাচ্ছেন, ছুটে এসে জেসমিনের ব্যাগটা নিয়ে বললেন, আপনি জেসমিন ভাবি না, দেন আমি ব্যাগটা নিচ্ছি।
জেসমিন লজ্জিত হয়ে বলল, না না ঠিক আছে আমি পারব।
তিনি বললেন, আপনাকে দেখেই চিনেছি। জসিম ভাইয়ের লেখায় এত থাকে আপনার কথা আর ছবি, মনে গেঁথে আছে।
আর একবার অরিত্রি বাসে ফিরছে বাসায়। একজন মহিলা বললেন, তুমি অরিত্রি না!
অরিত্রি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল, হ্যাঁ।
তোমাকে চিনি। তোমার বাবার লেখায় তোমার কথা থাকে।
অরিত্রি হেসে বলল, হ্যাঁ বাবা আমাকে নিয়ে লেখে।
ভদ্রলোক আমাকে বললেন, আপনার লেখায় অনেক আবেগ থাকে জসিম ভাই।
হ্যাঁ আমি অনেক আবেগী।
জসিম ভাই, একটা কথা বলব কিছু মনে করবেন নাতো!
না না মনে করার কী আছে, বলুন না!
আসলে সবাই তো সমালোচনা পছন্দ করে না!
না বলুন আপনি, কিছু মনে করব না।
আপনার লেখা খুব সহজ–সরল। অকপট। কোনো ভণিতা নাই। ভালো লাগে। মনের গভীরে চলে যান আপনি। কিন্তু আপনার লেখায় একঘেয়েমি আছে। আপনাকে লেখায় আরও বৈচিত্র্য আনতে হবে জসিম ভাই।

৪.
কথা সত্য। আমি নিজেও সেটা বুঝি। কিন্তু আবেগ এমন একটা জিনিস যে, তাতে বৈচিত্র্য খোঁজার কোনো সুযোগ নাই। আমি আমার লেখায় নিজের কথা বলি। নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা। মানুষের সঙ্গে আমি তেমন পেরে উঠি না। প্রকৃত আমাকে কেউ কোনো দিন বুঝে উঠতে পারে না। বাইরের আমি আর প্রকৃত আমি এক না। আলাদা। একটু কিম্ভূত। তাই পুনরাবৃত্তি ঘটে যায়। অনেকেই আমার কাছ থেকে পারফেকশন আশা করে। আমি পারফেক্ট মানুষ না। চেষ্টা করি অন্যকে খুশি করে চলতে। কাজটা কঠিন, তাও করি। আমি কারও কাছে খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করি না। প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির ব্যবধানটা অনেক বড় মনে হয়।
কেউ কেউ আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। সেটা আমি বুঝি। আমার সামান্য দুর্বলতা পেলে সেটা দিয়ে আমাকে ব্যবহার করতে চায়। তাই আমি বিভ্রান্ত হই। নিজেকে সঠিকভাবে চেনা হয়ে ওঠে না আমার। যাদের জন্য আমি করেছি, তারাও আমাকে ইগনোর করে। কারণ এখন আর আমাকে তাদের প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমি কখনো তাদের কাছে কিছু জানতে চাই না বা অভিযোগ করি না। এমনটাই হবে আমি ধরে নিই। আমি কখনো কারও দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিই না। আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করি কারও জন্য কিছু করার। আবার যাদের উপকার করেছি, অনেক সময় তারাই ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাতেও আমি কিছু মনে করি না।
এখন চলে যাওয়ার সময় হয়েছে। তাই কোনো অভিযোগ রেখে যাচ্ছি না। আনন্দ নিয়ে যাচ্ছি। এই দেশ, এই মাটি, এই বাতাস, প্রতিটা মানুষ, প্রতিটি ধূলিকণা, কীটপতঙ্গ আমার প্রিয়। প্রয়োজনের তাগিদে, সন্তানের মায়ায় আবার ফিরে যেতে হয়। ফিরে যাওয়া মানেই আবার আসার আশা। জীবন অনেক অনিশ্চিত। আমরা কেউ জানি না, কখন কী ঘটবে। শুধু স্মৃতিগুলো থাকবে। থাকবে সুন্দর কথা, থাকবে ভালোবাসা। প্রতিটা পদক্ষেপ অনুরণন তুলবে হৃদয়ের গভীরে। হয়তো গভীর রাতে ঘুম ভেঙে দুচোখ জলে ভরে উঠবে।
মারুফুল ইসলামের কবিতার লাইন দিয়ে শেষ করছি,
গভীর প্রহরান্তে ভুবন ভ্রমিয়া শেষে
তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ
ভালোবাসা ছাড়া এর আর কী নাম দেবে তুমি, বলো...