Thank you for trying Sticky AMP!!

মশার কার্যকর নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন নিবিড় গবেষণা

ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া

বাংলাদেশে মশা দমন নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ভাবনাটা এখনো বিচ্ছিন্ন বলা যায়। মশার উৎপাত বাড়লে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র বিশেষজ্ঞ এনে সভা করে করণীয় ঠিক করা হয়। কিন্তু কার্যকর দমন আর হয়ে ওঠে না। যদিও সম্মিলিতভাবেও কাজ করতে দেখা যায়। যেমন, ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়লে বিভিন্ন চিকিৎসা/গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর, আইসিডিডিআর’বি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইত্যাদি) সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক/গবেষকেরা সম্মিলিতভাবে কাজ করতে এগিয়ে আসেন। যা হোক, দেশে ডেঙ্গুর চিকিৎসা মোটামুটি ভালো চললেও এর প্রতিরোধটা কিন্তু ঠিকমতো করা যাচ্ছে না । বর্তমানে সিটি করপোরেশন মশা দমনের পুরো বিষয়টা যেভাবে দেখছে, তাতে সফলভাবে মশা নিধন আদৌ সম্ভব নয়। সুতরাং মশা নিধনে (প্রিভেনটিভ মেজার) সিটি করপোরেশনকে নতুন করে ভাবতেই হবে। যেহেতু মশা নিধন ছাড়াও সিটি করপোরেশনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, তাই এ খাতকে আলাদা করে দক্ষ লোকবলের সমন্বয়ে যুগোপযোগী ও গবেষণাভিত্তিক ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।
মশা নিধনে সিটি করপোরেশন শুরু থেকেই নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপারেশন টিম বা যারা স্প্রে করছে, তারা কি জানে কোন প্রজাতির মশা কোথায় কী মাত্রায় কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে? তাদের কাছে কি কোনো কীটনাশক প্রতিরোধী পরীক্ষিত ডেটা রয়েছে, যা দেখে তারা নির্দিষ্ট ডোজ প্রয়োগ করতে পারে? নাকি তারা মশা মারার জন্য কীটনাশকের ডোজ নিজেরাই ঠিক করছে বা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিচ্ছে? কিংবা যারা কীটনাশক প্রয়োগ করছে, তারা কি অ্যাপ্রোপ্রিয়েটলি ট্রেইনড? শোনা যাচ্ছে যে, ঢাকার মশা নাকি এখন কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ফলে কীটনাশকে আর মশা মরছে না। যদি কীটনাশকে ভেজাল না থাকে, তবে অল্প ডোজে কাজ হওয়ার কথা। তবে সাধারণত কীটনাশকের ভুল প্রয়োগেই (অতিরিক্ত ডোজ/অদক্ষ স্প্রেয়ারম্যান) মশারা প্রতিরোধী হয় বেশি। কারণ, মাত্রাতিরিক্ত ডোজে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে—এটাই স্বাভাবিক। অতিরিক্ত প্রতিকূল পরিবেশে মশারা বাঁচার জন্য দেহের ফিজিওলজিকাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে পি-৪৫০ জিনকে (কীটনাশক প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে চরম প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কীটনাশক দিয়ে এদের আর ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত/ভুল ডোজ যে কত ভয়ানক হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। তাই, বিভিন্ন টার্গেট এরিয়ায় মশা কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে এবং এই প্রতিরোধের মাত্রা (রেজিসট্যান্স রেশিও) কেমন, তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। কোন কীটনাশক (এডাল্টিসাইড/লার্ভিসাইড) কোন মশা/লার্ভাকে সফলভাবে দমন করতে পারে, তা প্রথমে ল্যাব টেস্ট করে (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) পরে প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত ও রুটিনমাফিক গবেষণা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কোনো দিনই টেকসই হবে না।
সফলভাবে মশা বা মশাবাহিত রোগ দমন করতে আলাদা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সেল গঠন করা যেতে পারে। তবে এটা হতে হবে গবেষণানির্ভর, যার মূল কাজ হবে—ক) মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম (অপারেশন), খ) প্রয়োজনীয় গবেষণা এবং গ) জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এই তিন ধরনের কাজের জন্য আলাদা সাব-সেল থাকবে। এই সাব-সেলগুলো এক-দুজন বিজ্ঞানীর তত্ত্বাবধান ও কিছু দক্ষ টেকনিশিয়ান দ্বারা পরিচালিত হবে।
ক) মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (অপারেশন) জন্য একদল দক্ষ টেকনিশিয়ান (যাদের মশা সম্পর্কে জীববৈজ্ঞানিক ন্যূনতম জ্ঞান থাকবে) লাগবে, যারা নিয়মিত কীটনাশক স্প্রে করবে। এই দলের নির্দিষ্ট কীটনাশক কোথায় কোন মাত্রায় লাগবে, থারমাল ফগার, ইউএলভি স্প্রেয়ার ইত্যাদিসহ নতুন নতুন সরঞ্জাম ঠিকমতো ব্যবহারের দক্ষতা থাকতে হবে। এদের অবশ্যই এডিস, কিউলেক্স, এনোফিলিসসহ বিভিন্ন প্রজাতির মশা পৃথকভাবে শনাক্তের দক্ষতা থাকতে হবে। ইত্যাদি) শনাক্ত করতে পারবে।
খ) মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (অপারেশন) পাশাপাশি মশা নিয়ে গবেষণা একটা অতি জরুরি বিষয়। মূলত এর ওপর ভিত্তি করেই মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণার বিষয় হচ্ছে মশার ওপর নজরদারি (বিজ্ঞানী ও দক্ষ টেকনিশিয়ান দ্বারা পরিচালিত হবে)। এডিসসহ অন্য মশার (অ্যাডাল্ট ও লার্ভা) সারভিলেন্স কার্যক্রম নিয়মিত (সারা বছর) পরিচালনা করতে হবে এবং তা মনিটর করতে হবে। হোস্ট-সিকিং মশা (মানুষ বা প্রাণীদের কামড়ায়) ও ডিম পাড়া মশা ধরার জন্য বিভিন্ন ফাঁদ (লাইট ট্র্যাপ, বিজি ট্র্যাপ, গ্রাভিড ট্র্যাপ, অভি ট্র্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। তা ছাড়া বিভিন্ন অঞ্চলে জমানো পানিতে লার্ভার উপস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এতে করে কোন অঞ্চলে কী কী প্রজাতির মশা রয়েছে, আধিক্য কেমন, এমনকি কোথাও জীবাণুবাহী মশা আছে কিনা (ভাইরাস সারভিলেন্স) তাও জানা যাবে। জীবাণুবাহী মশা শনাক্তে আরবোভাইরাল টেস্ট করতে হবে। নিয়মিত সারভিলেন্স করে কোথায় কোন প্রজাতির মশা আছে, তা জেনে নির্দিষ্ট কীটনাশক (ডোজসহ) প্রয়োগের সুপারিশ করতে হবে। কীটনাশক নির্বাচন করার আগে তা প্রথমে পরীক্ষা করতে হবে। এসব গবেষণার জন্য লাগবে ইনসেকটারি (মশা পালন), ল্যাবরেটরি ইত্যাদি। এই দলে থাকবেন দক্ষ জীববিজ্ঞানী, পতঙ্গবিদ ও অণুজীব বিজ্ঞানীরা।
গ) জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সারা দেশে সচেতনতা সপ্তাহ কিংবা ওপেন ডে পালন করা যেতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মসজিদসহ) পরিদর্শন করে মশার প্রজাতি, মশার আক্রমণ, জীবন-চক্র, মশাবাহিত রোগ-জীবাণু, রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে আগাম অবহিত করা যেতে পারে। মশার বংশবিস্তার রোধ করতে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
মশা নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে কীটনাশকের পাশাপাশি বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলও কার্যকরী হয়ে উঠেছে। এ জন্য বর্তমানে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উৎপাদন ব্যাহত করে), মেল স্টেরাইল টেকনিক (মশাদের মেটিং হবে কিন্তু ডিম উৎপাদন হবে না), বিভিন্ন মশাখেকো প্রাণী (গাপ্পি, গ্যামবুসিয়াসহ অন্যান্য), ওয়াটার বাগ, বিটল ইত্যাদির ব্যবহার অনেক দেশে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশেও এদের ব্যবহার পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা যেতে পারে। মশা এখন শুধু বিরক্তিকর নয়, আতঙ্কেরও বিষয়। তাই, ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্ট (আইএমএম) অনুসরণ করে আমাদের দেশে আলাদা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সেল প্রতিষ্ঠার নতুন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেখানে অপারেশন ও গবেষণা দুটোই চলবে এবং প্রয়োজনে অন্যান্য আরবো-ভাইরাল ডিজিজ ভেক্টর নিয়েও কাজ করা যাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি, ইউএসডিএসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান মশা নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতা (টেকনিক্যাল ও আর্থিক) করে আসছে। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা করে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে প্রথমে কিছুটা সময় লাগলেও পরে খুব সফলভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সফলভাবে মশা ও মশাবাহিত রোগ দমন করতে আধুনিক ভাবনা এখন সময়ের দাবি। কারণ, দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; নাগরিক সুবিধা কেন পিছিয়ে থাকবে?

লেখক: বিজ্ঞানী, এনাসটাসিয়া মসকিউটো কন্ট্রোল, সেন্ট অগাস্টিন, ফ্লোরিডা, আমেরিকা