Thank you for trying Sticky AMP!!

মুক্ত ফোরামের ব্যতিক্রমী আয়োজনে...

আলোচনা সভায় বক্তারা

বহুজাতিক অধিবাসীর মহানগরীতে বসবাসকারী বিশেষ জনসমাজের জীবনযাত্রা বুঝতে হলে তার বিচিত্র সাংস্কৃতিক সম্মিলনীগুলোতে হাজির থাকা দরকার। সেই ভাবনা থেকেই নিউইয়র্কে বাংলাদেশি জনসমাজের সংস্কৃতির হালচাল অনুভবের চেষ্টা করি। চেষ্টা করি কোনো অনুষ্ঠানের খবর পেলে সেখানে উপস্থিত হতে। যেসব অনুষ্ঠান সাধারণের জন্য উন্মুক্ত সেগুলোর ব্যাপারেই আগ্রহটা বেশি। চেষ্টা করি অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে হাজির হয়ে পুরো সময়টা সেখানে থাকতে।
নিউইয়র্কের অনুষ্ঠানগুলোতে সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া লক্ষ্য করেছি, অনুষ্ঠানে যাঁরা অংশ নিতে আসেন তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আয়োজকদের সঙ্গে দেখা করেন, কিছু সময় অনুষ্ঠানস্থলে থাকেন, গল্পগুজব করেন; কে কী বলল তা মনোযোগ দিয়ে শোনার অবকাশ সব সময় তাঁদের হয় না। কেউ কেউ দু-একজনের বক্তব্য হয়তো একটু শুনে রাখেন। যেন বক্তব্য শোনাটা মূল উদ্দেশ্য নয়, উপস্থিত হয়ে একাত্মতা জানান দেওয়াটাই মুখ্য!
অধিকাংশ অনুষ্ঠানে বক্তার সংখ্যা সীমা নেই। কারণ যাঁরা উপস্থিত তাঁদের কোনো না কোনো সময় বক্তব্য রাখতে আহ্বান জানানো হয়। যিনি বক্তব্য রাখেন তিনিও জানেন তাঁর কথা শোনা মুখ্য ব্যাপার নয়, বলাটাই মুখ্য। কারণ অন্যের কথা নিজেও তিনি মনোযোগ দিয়ে শোনার দরকার মনে করেন না। সংগত কারণেই অন্যের ক্ষেত্রে একই ব্যাপার কাজ করে। কারা বক্তব্য রেখেছেন তাঁদের নাম এই ক্ষুদ্র জনসমাজের পত্রিকাগুলোতে থাকলেই হলো। মঞ্চে অনুষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের যাঁরা দায়িত্বে থাকেন তাঁরা এই সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। কী কী পরিচয়ে ওই ব্যক্তিরা পরিচিত হলে খুশি হবেন সে সম্পর্কেও তাঁরা ভালোভাবে অবগত। উদ্যোক্তারা এমন ব্যক্তির হাতেই অনুষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণভার তুলে দিয়ে স্বস্তি পান।
এ রকম পরিস্থিতির মধ্যেও হঠাৎ কোনো অনুষ্ঠান ব্যতিক্রম হয়ে দেখা দেয়। বোঝা যায় সামর্থ্যের ঘাটতি থাকলেও অনুষ্ঠানের আয়োজনের অভিপ্রায় আন্তরিক। উপস্থিত শ্রোতার সংখ্যা হয়তো তাতে বেশি থাকে না। এমনই এক আয়োজন ছিল মুক্ত ফোরামের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘কেন শুদ্ধতম’। এই নামে ওমর শামসের একটি বই বেরিয়েছে, যার প্রকাশক বটেশ্বর বর্ণন। ইত্যাদি অনলাইনে পাওয়া যায়। খবর পেয়েছিলাম মূল বক্তা ওমর শামসের কাছ থেকে যে এ বিষয়ে তিনি কথা বলবেন। আমি উপস্থিত হতে পারলে তাঁর ভালো লাগবে।
ওমর শামস বাংলাভাষার একজন কবি। চল্লিশ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। নিউজার্সিতে থাকেন। সম্প্রতি জীবনানন্দ দাশের আধুনিকতা ও নিজস্বতা নিয়ে একটি বই লিখেছেন সে খবর জানা ছিল। সেই বইয়ে প্রবন্ধের বিষয়বস্তু নিয়ে সামান্য কথাও হয়েছে দুই একবার। এ কারণে যাওয়ার আগ্রহ অনেক ছিল। নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টাখানেক পরে অনুষ্ঠান শুরু হলো।
অনুষ্ঠানের আয়োজক ‘ফোরাম’ এটুকু জেনেছিলাম ওমর শামসের কাছ থেকে। কিন্তু মঞ্চে আয়োজক সংগঠনের নাম লেখা ‘মুক্ত ফোরাম ইন্‌ক’। আয়োজকদের পক্ষ থেকে একটি ভাঁজপত্র দেওয়া হলো। সেখানে লেখা দেখলাম আয়োজক সংগঠন ‘মুক্ত ফোরাম’। প্রথম পাতাতেই লেখা ‘বিনয় জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন’। এই দুই লাইনের মাঝে প্রথম বন্ধনীতে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে A Think Tank Organization, Est.1998, New York.। সংগঠনটির ঠিকানা নিউইয়র্কের উডহ্যাভেনে। প্রেসিডেন্ট ড. দলিলুর রহমান, কো-অর্ডিনেটর মাহমুদ রেজা চৌধুরী, সদস্য দেওয়ান শামসুল আরেফিন (প্রতিষ্ঠাতা সদস্য), আনোয়ার খন্দকার, সুমী বেগম, আওলাদ হোসেন। উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সংখ্যাও বেশ বড়। এঁদের মধ্যে আছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আলী রীয়াজ, সলিমুল্লাহ খান, ওমর ফারুক, আশরাফ উদ্দিন আহমেদ, আতাউল করিম, শাহরিয়ার হক (প্রতিষ্ঠাতা সদস্য)।
অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ রেজা চৌধুরীর ঘোষণায় শোনা গেল অনুষ্ঠানের দুটি পর্ব। একটি পর্বে কবি-সমালোচক ওমর শামসের বক্তব্য, দ্বিতীয়টিতে ঢাকা থেকে আসা কবি ও গবেষক মুস্তাফা মজিদের কথাবার্তা। ফাঁকে ফাঁকে থাকবে জীবনানন্দ দাশের কবিতার আবৃত্তি।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করলেন সংগঠনের সভাপতি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. দলিলুর রহমান। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করতে আহ্বান জানানো হলো প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেওয়ান শামসুল আরেফিনকে। তিনি সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই উদ্বোধন ঘোষণা করলেন। এরপর জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা আবৃত্তি করলেন মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেন।
এরপর শুরু হলো ওমর শামসের বক্তব্য। তিনি প্রথমেই নির্দেশ করলেন তাঁর বক্তব্যের ভিত্তিগুলো। পরে ধীরে ধীরে দেখালেন বাংলা ভাষার অন্য কবিদের সঙ্গে জীবনানন্দের পার্থক্যের ধরনকে। কেবল পার্থক্যই নয়, আধুনিকতার বৈশিষ্ট্যে তাঁর স্বাতন্ত্র্য কোথায় তারও পরিচয় তুলে ধরলেন। বিশেষ করে চিত্রকল্পের স্বভাবে ও ধ্বনিরূপের প্রকৃতিতে জীবনানন্দ কীভাবে সম্পূর্ণ নতুন তাৎপর্য সৃষ্টি করেন তার পরিচয় তুলে ধরে আলোচনাকে প্রাণবন্ত করে তুললেন তিনি। কবিত্বের স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করতেই তিনি অন্নদাশঙ্কর রায় উক্ত ‘শুদ্ধতম’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বলেও উল্লেখ করলেন। কবিতা লিখতে হলে অনুপ্রেরণা লাগে, দরকার হয় অন্তর্দৃষ্টি, প্রয়োজন কল্পনা প্রতিভা—ইমাজিনেশনকে কবি কল্পনা প্রতিভা বলেছেন। কবির থাকতে হয় ইতিহাস বোধ এবং ভাষাকে হৃদয়ে ধারণ করার সামর্থ্য। তাঁর কবিতায় বর্তমান যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ইতিহাস। প্রেম, যুদ্ধ, প্রকৃতি, ঔপনিবেশিকতা, অর্থনীতি—এই সব বিচিত্র বিষয় এসেছে তাঁর কবিতায়। এ কারণে তিনি সব সময়ের জন্য আধুনিক।
পরে অনির্ধারিত বক্তা শামস আল মমীন ও মুজিব বিন হক বক্তব্য রাখেন। শামস আল মমীন বলেন, জীবনানন্দ দাশ জীবিতাবস্থায় যথার্থ মূল্যায়ন পাননি। এমনকি রবীন্দ্রনাথের কাছেও তিনি ভালোভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারেননি।
মুজিব বিন হক বলেন, কবি জীবনানন্দ দাশের সৃষ্টি একটি বিষধর সাপের ফণার সামনে একটি শিশু যেমন খেলা করে তেমনি।
অনুষ্ঠানে নিউইয়র্কের সুপরিচিত আবৃত্তিকার মিজানুর রহমান বিপ্লব জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করেন।
দ্বিতীয় পর্বে বক্তব্য রাখেন কবি-গবেষক মুস্তাফা মজিদ। অনুষ্ঠানে তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তিনি কবি, লেখক বা গবেষক হিসেবে পরিচিত হতেই ভালোবাসেন। এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১৬টি। তিনি কয়েকটি স্বরচিত কবিতাও পাঠ করে শোনান।
সভাপতির ভাষণে দলিলুর রহমান মুক্ত ফোরামের সাংগঠনিক ইতিহাস ও কবি ওমর শামসের পরিচয়ও তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানের শেষে শিল্পী শহীদ হাসান তাঁর নিজের লেখা গণসংগীতসহ কয়েকটি গান পরিবেশন করেন।