Thank you for trying Sticky AMP!!

মে দিবসে অক্টোবর বিপ্লবের শিক্ষা

মহামতি লেনিনের ১৫০তম জন্মবার্ষিকীতে এবারের মে দিবস পালিত হল। ২০১৭ সালে কার্ল মার্ক্সের দাস ক্যাপিটাল বইটি প্রকাশিত হওয়ার দেড় শ বছর পালিত হয়েছে। যে দাস ক্যাপিটাল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রূপ সুবিন্যস্তভাবে ধরে ও শোষণমূলক ব্যবস্থা থেকে শোষণমুক্ত ব্যবস্থায় পৌঁছানোর দিশা দেখায়। ওই বছরই বিশ্বের এ যাবৎ সর্বশ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের জন্ম দ্বিশত বর্ষে পদার্পণের বছর পালিত হয়েছে।
সামাজিক মানুষ হিসেবে চাহিদা ও মর্যাদার লক্ষ্যে আবিশ্ব মেহনতি মানুষের ক্রমবর্ধমান সংগ্রামে ১৮৮৬ সালের মে দিবসের ঘটনাবহুল পর্ব এক মাইলফলক। যে পর্ব পরিণতি লাভ করে ১৯১৭ সালের মহান অক্টোবর বিপ্লবে। এই অক্টোবর বিপ্লব পুঁজিবাদী ব্যবস্থার জোয়াল ভেঙে প্রতিষ্ঠা করে প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এই যাত্রাপথ একদিকে সংকটে দীর্ণ ধনবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ঘনীভূত শ্রেণিসংগ্রামের জীবন্ত ধারাভাষ্য এবং অন্যদিকে মেহনতি মানুষের মধ্যে শ্রেণি সচেতন অংশের যারা ধনবাদী ব্যবস্থাকে অতিক্রম করে সুদৃঢ় সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৈপ্লবিক প্রয়াস গঠন করেছে। এই পুরো যাত্রা পুঁজিবাদী শোষণের ঘূর্ণাবর্তে শ্রমজীবী শ্রেণির মতাদর্শের গতিশীল ও ফলিত প্রয়োগের লক্ষ্যে। এই প্রক্রিয়ার মধ্যেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার চূড়ান্ত পাশবিক রূপ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার চেষ্টা চালায়।
শ্রমিকশ্রেণির এই দীর্ঘ যাত্রাপথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও গুটিয়ে যেতে বাধ্য হয় এবং তাদের উপনিবেশবাদী অবস্থান ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। গতিশীলতার এই একই প্রক্রিয়ায় পুঁজিবাদী লোভ ও ঔদ্ধত্যের সর্বাধিক বর্বর ও নারকীয় প্রকাশ ঘটে। যে ফ্যাসিবাদের মধ্যে সেই ফ্যাসিবাদকেও পর্যুদস্ত করে। মে দিবস থেকে অক্টোবর বিপ্লব—এই দীর্ঘপথে শ্রমিকশ্রেণি সাম্রাজ্যবাদকে পিছু হটতে বাধ্য করেছে এবং পরবর্তী ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করেছে।
এই ঘটনাবহুল যাত্রা তার গতিশীল প্রক্রিয়ার মধ্যে মানবজাতি তথা মানব সভ্যতাকে উপহার দিয়েছে সর্বাধিক শক্তিশালী হাতিয়ার, যা শ্রমিকশ্রেণির মতাদর্শের ফলিত প্রয়োগ, যা একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার দিশা দেখায়। যে হাতিয়ার মানুষের মতো করে বাঁচার অন্তরায় মৌল সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে শুধু পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও অমানবিকতাকে মেলে ধরে না, তার সঙ্গেই তার চূড়ান্ত পরাজয়কে নিশ্চিত করে। এই হাতিয়ার হলো শ্রমজীবী শ্রেণির মতাদর্শ। যে মতাদর্শ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অমানবিক শোষণের দেউলিয়া চেহারা তুলে ধরে এবং একই সঙ্গে সংগঠনের স্থাপত্য ও নীতিসমূহের ভিত্তি হিসেবে উদ্ধৃত হয়, যাতে করে শ্রমজীবী জনতা তার যাত্রাপথে পুরো ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনে সক্ষম হয়।
শ্রমজীবী জনতার হাতে এই মতাদর্শ ও এই হাতিয়ার এতটাই সুবিন্যস্ত ও শক্তিশালী যে সমাজ জীবনের প্রতিটি পরিস্থিতির পেছনের কারণগুলোকে ব্যাখ্যা করতে ও একই সঙ্গে নিপীড়িত সমাজের সামনে প্রতিরোধ ও প্রগতির পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম। শ্রমজীবীর শ্রেণি সংগ্রামে শ্রেণি সচেতন অংশকে অবশ্যই শিখে নিতে হবে, বর্তমান চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করার লক্ষ্যে বৈজ্ঞানিক মতাদর্শ প্রয়োগের কৌশল। মহতী লেনিনের ১৫০তম বর্ষে মে দিবসের এটিই আহ্বান।
বর্তমান উদারবাদী সরকারের আমলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সেবায় মানুষের অধিকারের ওপর নেমে আসা চূড়ান্ত আগ্রাসী আক্রমণ এবং জাতীয় সম্পদসমূহ লুট ও মানুষকে সর্বস্বান্ত করার মরিয়া অপচেষ্টা প্রতিরোধ করা অন্যতম চ্যালেঞ্জ। অবশ্যই বর্তমান সরকার আগের প্রতিক্রিয়াশীল সরকার থেকেই নয়া-উদারনীতি পথের উত্তরাধিকার লাভ করেছে। শ্রেণি ও জনগণের ঐক্যকে রক্ষা করা এবং তাদের প্রকৃত শত্রুকে চিহ্নিত করাও চ্যালেঞ্জ। কেবল এই প্রক্রিয়াই নয়া উদারবাদী ষড়যন্ত্র ও লুটকে প্রতিরোধ করবে। প্রকৃত শত্রুকে চিহ্নিত করার ক্ষমতা এবং জনগণের ঐক্য আজ ভয়ানক আক্রমণর মুখোমুখি। ধর্ম, জাত, বর্ণ, সম্প্রদায়ের দাঁড়িপাল্লা মানুষকে ভাগাভাগি করার সুচতুর ষড়যন্ত্রের নকশা তৈরি হয়েছে, যা দেশের ও জাতির সম্প্রীতির পক্ষে বিপজ্জনক।
একদিকে মানুষের জীবন, তাদের রুটিরুজির ওপর আক্রমণ চলছে অন্যদিকে তাদের ঐক্যে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চলছে। উদারনীতির এই পর্বেই পুঁজিবাদ তার শাসন টিকিয়ে রাখতে নানা কৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। এরই একটি কৌশল হলো উগ্র দক্ষিণপন্থী মতাদর্শে প্রভাবিত করে মানুষকে বিভাজিত করা। কার্যত শ্রমিকশ্রেণির ওপর লুটের রাজত্ব কায়েম করতেই ধর্মের ভিত্তিতে, জাতের ভিত্তিতে এমনকি পাড়ার ভিত্তিতে বহু মেরুকরণ ঘটিয়ে দেওয়া। লক্ষ্য একটাই আক্রান্ত মানুষের ঐক্যে ভাঙন ধরানো। ধর্ম, জাত, বর্ণ, সম্প্রদায় পরিচিতির বিভিন্নতা দিয়ে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা। সংকটগ্রস্ত পুঁজিবাদকে টিকিয়ে রাখার জন্য শাসকদের এটাই আজ রণনীতি।
পুঁজিবাদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলা শ্রমিকশ্রেণির মতাদর্শের ভিত্তিতে চাই আরেক মেরুকরণ যা আক্রান্ত মানুষকে ভাঙার নয়, শোষিত মানুষকে এক জোট করবে। সব অংশের শোষিত অত্যাচারিত বৈষম্যের শিকার মানুষকে এক মঞ্চে শামিল করাই শ্রমিকশ্রেণির লক্ষ্য। শোষক ও শোষিতের মেরুকরণ আর এটাই সমাজ পরিবর্তনের শেষ কথা। তার মধ্য দিয়েই শত্রু চিহ্নিত হবে। সচেতন শ্রমিকশ্রেণিই এই বহু মেরুকরণের ষড়যন্ত্রকে ভাঙতে পারে।
শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন সংগ্রাম নিশ্চিতভাবেই পরাস্ত করতে পারে আক্রান্ত মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার এই পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। তার সঙ্গেই শ্রেণির ভিত্তিতে প্রকৃত শ্রমিক ঐক্য গড়ে তুলতে পারে আদর্শ ও সাংগঠনিক মৌলনীতির ভিত্তিতে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে মহান অক্টোবর বিপ্লবের শিক্ষা। এই অক্টোবর বিপ্লবই শিখিয়েছে সব শোষণের বিরুদ্ধে একটি মাত্র মঞ্চ গড়ে লড়াইয়ের দিশা দেখাতে। এই লক্ষ্যে শ্রেণির আদর্শকে আত্মস্থ করে সাংগঠনিক সব ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ ঘটানোই শ্রমিকশ্রেণির সামনে এখন অন্যতম কাজ।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে জনজীবনের ওপর নেমে আসা সংকটের প্রতিটা পর্বের মধ্যে শাসকের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রকে বিশ্লেষণ করাও এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই শাসক চায়, তার এই শোষণ ব্যবস্থা কায়েম রাখার লক্ষ্যে কতটা কম বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এই মুহূর্তে শাসকের তরফে আরও বিনিয়োগ এবং আরও কর্মসংস্থানের মোড়কে নানা কৌশল অবলম্বন। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় এবং আমাদের দেশেও পুঁজিবাদী সংকট এমন পরিস্থিতিতে পৌঁছেছে, যেখানে গত বছরগুলোতে এই ব্যবস্থার মধ্যে নতুন কোনো উৎপাদন ক্ষেত্র গজিয়ে ওঠেনি।
একইভাবে সামাজিক নিপীড়নের প্রশ্নও শাসকশ্রেণি নতুন কৌশলে মানুষের রুটিরুজির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা সমস্যাগুলো ও তার প্রকৃত কারণকে আড়াল করছে এবং আক্রান্ত মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করছে। সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইটাও তাই শ্রেণির মঞ্চ থেকেই করতে হবে। এটাই মে দিবসের আহ্বান।
শ্রেণি উপলব্ধির এই ঘাটতির কারণেই শাসকশ্রেণি জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করতে বাড়তি সুবিধা পেয়ে যায় এবং কোথাও কোথাও শাসকের তরফে আরোপ করা জনবিরোধী নীতির সমর্থনও আদায় করে নেয় জনমানস থেকেই। এমন অস্থির সময়েই খোদ শাসকদলের তরফে তাদের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলো রূপায়ণ করে নেয় যার পরিণতিতে মানুষের মৌলিক অধিকার এমনকি ব্যক্তি স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়।
বর্তমান সরকার ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী কায়দায় সাধারণ মানুষের জীবন ও রুটিরুজির ওপর আক্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে চলেছে। এই এক নায়ক শাসনের পরিণতিতে সংসদীয় গণতন্ত্র ও মানুষের সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ ঘটছে, রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে টিকে থাকা গণতান্ত্রিক কাঠামোগুলো আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। এভাবে মৌলবাদী প্রচার সমাজের মধ্যে বিচ্ছিন্নতার বিষ ঢেলে দিচ্ছে। এই জাতীয়তাবিরোধী, জনবিরোধী শক্তির মোকাবিলা করতে মহামতি লেনিনের মহান অক্টোবর বিপ্লবের আদর্শকে হাতিয়ার করে শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলন তীব্র করতে হবে। মহামতি লেনিনের ১৫০তম বর্ষে মে দিবস দীর্ঘজীবী হোক।