Thank you for trying Sticky AMP!!

মোবারকের উৎসব-সন্ধ্যা

উৎসবের দিন। মোবারক নিমন্ত্রণ করেছেন আমেরিকান বন্ধু জর্জকে। কথা পাকা, তাঁরা ঝগড়াঝাঁটি করবেন না। মোবারক মুখ বন্ধ রাখবেন। একটা পবিত্র উৎসবের দিন। মোবারক পানাহারে সতর্ক থাকবেন। জর্জকে বলে দেওয়া হয়েছে, তিনি নিজে তাঁর পানীয় নিয়ে আসতে পারেন।

আমেরিকায় লোকজন ব্যাকইয়ার্ড পার্টির আমন্ত্রণ দেয়। বলে দেয়, বসার জন্য চেয়ার নিয়ে আসতে হবে। নিজের পানীয়ও নিয়ে আসতে হবে। ৪০ বছরেও মোবারক ঠিক এমন আমেরিকান হতে পারেননি। মিসর থেকে আসা নিজের সংস্কৃতিতেই আতিথেয়তা দেখিয়ে আমেরিকান বন্ধুকে সম্মান দেখান। বন্ধুর জন্য ব্যয় করেন। ব্যয় করে সুখ পান।

সস্ত্রীক জর্জ এলেন। জর্জ নিজেও বলেন, এমন অভিবাসীরাই আমেরিকার সমাজকে অনেক কিছু দেয়। বিনিময়ে পায় শুধু অপবাদ। জর্জ আসার সময় একটা ভারী প্যাকেট নিয়ে এসেছেন। মোবারকের হাতে উপহার তুলে দিয়ে বললেন, বন্ধু, একদম নিউজার্সির বাগান থেকে ওঠানো আঙুরের নির্যাস। নিউজার্সির মিশ্র আবহাওয়ায় কীভাবে চাষ করে ভালো আঙুরের ফলন পাওয়া যায়, তা নিয়ে কিছুক্ষণ কথা হলো দুই বন্ধুর মধ্যে।

জর্জ সচরাচর রাজনৈতিক কৌতুক এড়িয়ে চলেন। মোবারক বায়না ধরেছেন, উৎসবের সন্ধ্যাটি কাটবে বন্ধুর কৌতুক শুনে। বাইরের কেউ নেই। জর্জ আর মোবারক দুই বন্ধু আর তাঁদের দুজনের স্ত্রী। একদম হোম পার্টি। জর্জ একাই কৌতুক বলবেন। মোবারক বলতে যাবেন না। মোবারকের কৌতুকে আমেরিকানদের ওপর খালি বিদ্রূপ, আক্রমণ থাকে। জর্জ কিছু মনে করেন না। আমেরিকানদের এমন সহনশীলতা দেখে প্রতিবারই আপ্লুত হন। এবারে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জর্জকেই শুনবেন। দুই বন্ধু তর্কে যাবে না। ‘নাথিং ইজ পার্সোনাল’ বলে সন্ধ্যাকালীন ভোজন পর্বটা সাঙ্গ হলো।

এমন কোনো আসরে মোবারকের স্ত্রী উপস্থিত হলেন প্রথমবারের মতো। জর্জের ধারণা, মোবারকের তৃতীয় স্ত্রী তাঁর চেয়ে ৩০ বছরের ছোট। যতটা সম্ভব আগলে রাখেন। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের এক দেশ থেকে মেইল ইন ব্রাইড নামের এক ব্যবস্থা বেশ কিছুদিন থেকে আমেরিকায় জনপ্রিয়তা পেয়েছে। নানা ঘাটে জল পান করে জর্জ এমন একটি বিয়ে করেছেন কয়েক বছর আগে। নাতালিয়ার বয়সের ব্যবধান নিয়ে মোবারকও টিপ্পনী কাটেন।

নিজেদের সঙ্গে স্ত্রীর বয়সের ব্যবধান নিয়ে হাসিঠাট্টা হয়। বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়াও হয়ে গেছে কয়েক দফা। কোনো রাখঢাক ছাড়া কথা বলেন জর্জ। টিপ্পনী কাটেন, এখন দেখেই সুখ!

মোবারকও কম যান না। পাল্টা বলেন, কার বউ দেখে সুখ পাও মিয়া? আমারটা না তোমার নিজেরটা! জর্জ হো হো করে হাসেন। উৎসবের সন্ধ্যায় মিসরীয় বন্ধুর বাসায় উপস্থিত হয়েই বলেছেন, আজ তোমার জন্য নিয়ে এসেছি। মোবারক ভাবলেন, উপহারের প্যাকেটের কথা বলছেন। বিনম্র ভঙ্গিতে বললেন, ধন্যবাদ বন্ধু, আয়েশ করে পান করা যাবে একদিন!

জর্জ ফিসফিস করে বললেন, নাতালিয়াকে নিয়ে এসেছি। তুমি তো ওর দিকে খালি আড়চোখে তাকাও। সাদা চামড়া দেখলে হুঁশ থাকে না তোমার। আজ প্রাণভরে দেখে নাও। মোবারক ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তুমিও কম যাও না মিয়া! ফাতিমার দিকে চেয়ে থাকো, আমি কি খেয়াল করি না মনে করেছ? এর মধ্যেই নাতালিয়া আর ফাতিমা বেশ দূরে নিজেদের মধ্যে শুভেচ্ছা বিনিময় করছেন। জর্জ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলেন একবার। জানো বন্ধু, বাদামি চামড়ার মেয়েদের দেখলেই আমার বুকটা হু হু করে ওঠে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে গিয়ে প্রেমে পড়েছিলেন জর্জ। সামরিক জীবনে তাঁর এ প্রেমের কাহিনি বহুবার শুনিয়েছেন জর্জ। প্রতিবার বলার সময় চোখে ভালোবাসার ঝিলিক থাকে। মোবারক আজও বন্ধুর চোখে একই ঝিলিক দেখেন! বলেন, বন্ধু, এই করোনা–ফরোনা গেলে আমরা ভিয়েতনামে যাব একসঙ্গে। হয়তো খুঁজে পাব তোমার যৌবনকে নাড়া দেওয়া কোনো নারীকে।

দুই বন্ধু বেশ কিছুক্ষণ নীরব হয়ে পড়লেন।

মোবারক, তুমিও কি যৌবনে ফিরে গেলে? মনে পড়ছে কারও কথা, যাকে পাওনি নিজের জীবনে?

মোবারক নীরব থাকেন। শূন্যে তাকিয়ে থাকেন।

‘আমাদের আর তোমাদের জীবনের মধ্যে ফারাকটা বড়। লড়াই করতে করতেই সময় চলে গেছে।’

বেশ বিরতি দিয়েই মোবারক বলেন, জীবনটা একদম পানসে হয়ে গেছে, উত্তেজনাহীন হয়ে গেছে জর্জ!

শোনো বন্ধু, সারা পৃথিবীই এখন উত্তেজনাহীন। বিমর্ষ। আমাদের মহান দেশ আমেরিকায়ও এখন উত্তেজনা নেই। আছে শুধু দুঃসংবাদ। এমন চলতে পারে না। কোথাও কোনো উত্তেজনা নেই। যুদ্ধ নেই!

তো কী করতে হবে এখন?

আমাদের যুদ্ধে যেতে হবে। কেউ কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে বা ষড়যন্ত্র করছে, এমন কথা বলে হামলা চালাতে হবে। যুদ্ধ করলেই আমেরিকা ভালো করে। যুদ্ধে আমেরিকার মানুষ ত্যাগ করেছে বারবার। আরও ত্যাগ করার প্রস্তুতি নিতে হবে। তাহলেই আমাদের মধ্যে উত্তেজনা ফিরে আসবে। উত্তেজনা ছাড়া আমেরিকার জীবন পানসে!

ভুয়া কারণে তোমরা আর কত লোক মারবে?

জর্জ? মানুষ মারার জন্য আর কত ত্যাগ করবে আমেরিকার লোকজন। পুঁজিবাদকে তোমরা একদম দস্যুবাদ বানিয়ে দিয়েছ বন্ধু!

ইতিমধ্যে ফাতিমা আর নাতালিয়াও আপেল জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে বসে গেছেন স্বামীদের পাশে। নাতালিয়া এবারে উচ্চকণ্ঠেই বলতে শুরু করলেন, আমেরিকার এখনই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া দরকার। এ যুদ্ধে ত্যাগ করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।

যুদ্ধের পক্ষে স্বামীর আহ্বানকে সমর্থন করার জন্য জর্জ আপ্লুত হলেন। সাবেক সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে নাতালিয়াকে বিয়ে করে ভুল করেননি, এমন ভাব করলেন। ভাবলেন, পাল্টে ফেলতে পেরেছেন নিজের মতো করে। জর্জ হাত উঁচু করলেন সবাইকে থামানোর ভঙ্গিমায়। উঠে দাঁড়ালেন। নাতালিয়ার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুম্বন দিলেন। ভালোবাসার চুম্বন। নাতালিয়া চুম্বনটা গ্রহণ করেন। উৎসবের সন্ধ্যায় এমন একটা রোমান্টিক দৃশ্য দেখে মোবারক দম্পতি নিজেরাও রোমান্টিক হয়ে উঠলেন।

মোবারক এগিয়ে যাচ্ছেন ফাতিমার দিকে। নাতালিয়া বেশ জোরেই বলে ওঠেন, থামুন! ভালোবাসা পরে হবে। এবারে যুদ্ধের ডাক আসুক। এ যুদ্ধ হোক দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, সমাজের অসাম্যের বিরুদ্ধে। আমরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছি। কেবল দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হলেই আমরা নিজেকে এখন উৎসর্গ করব।

নাতালিয়ার কথা শুনে নীরবতা নেমে আসে। নীরবতার একটা ঐক্য আছে।

স্ত্রীকে আবার জড়িয়ে ধরলেন জর্জ। স্লোগান দেওয়ার ভঙ্গিতে হাত ওঠালেন। বললেন, চলুন, বন্ধুরা আমরা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিই। যুদ্ধ করেছি ভিয়েতনামে, যুদ্ধ করেছি ইরাকে, আফগানিস্তানে-দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, অসাম্যের পাহাড়ের বিরুদ্ধে কখনো যুদ্ধ করিনি। এবারের যুদ্ধ তা–ই হোক। আমরা ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

জর্জ বেশ আনন্দের সঙ্গে জানালেন, নাতালিয়াকে বিয়ে করে তিনি খুবই গর্বিত।

ফাতিমা মোবারককে ফিসফিস করে বললেন, দেখো, আমেরিকার লোকজন কেমন প্রকাশ্যে ভালোবাসা দেখাতে পারে। ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারে। ঝগড়া আমরা প্রকাশ্যে করি। ভালোবাসা করতে চাই আড়ালে–আবডালে!

নিজের স্ত্রীর কথা শুনে মুগ্ধ মোবারক! ইতিউতি করতে থাকলেন। এর মধ্যে জর্জ তাঁর পরের কৌতুক শুরু করে দিয়েছেন।

চারদিকে আসা ট্রাফিক ইন্টারসেকশনে একসঙ্গে পৌঁছেছেন চারজন। আমেরিকান, রাশান, চায়নিজ আর মিসরীয়। আমেরিকান লোকটি কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই ডান দিকে গাড়ির সিগনাল দেয়। ভাবখানা এমন, তার তো ডানেই যাওয়ার কথা। রাশিয়ার লোকটিও কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই সিগনাল দেয় বাঁ দিকে।

চায়নার লোকটি সিগনাল দেয় বাঁয়ে, গাড়ি টার্ন করে ডান দিকে।

জর্জ কৌতুকটি আর শেষ করতে পারলেন না। মোবারক বললেন, মিসরের লোকটা কোনো সিগনালই দেবে না। জানা নেই, কোন দিকে যাবে। নিজের কোনো ত্রুটি না থাকলেও দুর্ঘটনায় নির্ঘাত মারা যাবে এখন।

তিনজন শ্রোতার কেউ আর হাসছেন না। জর্জ তত্ত্বকথায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করলেন। বললেন, সারা বিশ্ব এখন এমন একটা বিভ্রান্তির ইন্টারসেকশনে দাঁড়িয়ে আছে। নিরপরাধ লোকজনই মারা যাচ্ছে। কেন মারা যাচ্ছে, জানার আগেই মারা পড়ছে। লক্ষ্যহীন লোকজনই মারা যাচ্ছে বেশি।

জর্জ বলে চলছেন, আমেরিকার নির্বাচন আসছে। আমরা আমেরিকার লোকজন মহাসাগর পাড়ি দিয়ে যুদ্ধে ঠিকই যাই, তবে সড়কটা পাড়ি দিয়ে ভোট দিতে চাই না। জর্জ জানালেন, আজ আর কৌতুকের আসর চালিয়ে যেতে তাঁর মন চইছে না। তবে শেষ করার আগে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে নিয়ে কৌতুকটি বলে ফেলতে চান।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর বাল্যকালের এক ধর্মগুরুকে নিয়ে নির্বাচনী প্রচারে গেছেন। দিনকাল ভালো যাচ্ছে না ট্রাম্পের। ক্রিমিনাল ইমিগ্রেন্ট, চায়না ভাইরাস, ডা. ফাউসি, ফেক মিডিয়া, স্লিপি বাইডেন—কিছু বলেই লোকজনকে আর ঠিক উৎফুল্ল করা যাচ্ছে না। লোকজনকে কী করে নিজের পক্ষে আনা যায়, তা নিয়ে ভাবছেন। ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলেন ধর্মগুরুকে, এমন অবস্থায় লোকজনের ব্যাপক সমর্থন পেতে হলে আজ আপনি কী করতেন?

ধর্মগুরু কোনো চিন্তা না করেই বললেন, আজকের লোকজনের সমর্থন পাওয়ার জন্য আমার তেমন কিছুই করতে হবে না। শুধু একটা হাত নাড়াচাড়া করলেই লোকজন উৎফুল্ল হয়ে উঠত। সারা জীবনের মতো এসব লোক আমার অনুগত থাকবে।

ট্রাম্প ধর্মগুরুকে বললেন, নির্ভয়ে কাজটি করে দেখান। একহাত নয়, প্রয়োজনে দুই হাত ব্যবহার করুন।

ধর্মগুরু দুই হাত দিয়ে কষে চড় লাগালেন ট্রাম্পের দুই গালে!

জনতা উৎফুল্ল!

জর্জের কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হো হো করে হেসে উঠলেন মোবারক, ফাতিমা ও নাতালিয়া।

মোবারক জড়িয়ে ধরেন ফাতিমাকে। জর্জ নাতালিয়াকে। দুই বন্ধু স্ত্রীদের উষ্ণ চুম্বনে ঝাঁপ দিলেন।

ibrahim.chowdhury@prothomalo.com