Thank you for trying Sticky AMP!!

সূর্যের আলো যখন আমাদের প্রধান আশ্রয়

আমরা সূর্যের দিকে তাকাই। আলো চাই। আশ্রয় চাই। মেঘ দেখলেই ভাবি কবে রোদ উঠবে। ভাবি, আরও কিছু কাজ বাকি। আরও আলোকিত সময় দরকার। এই যে আশা তা মানুষকে সম্মোহিত করে রাখে। রাখে জীবনের জন্য। ভালোবাসার জন্য। মিলনের জন্য। বিরহের জন্য। হ্যাঁ, বিরহও তো কবিতার একটি পাঠপর্ব। কবি মোখলেসুর রহমান সেই পাঠের ধ্যান নিয়েই লেখেন। তিনি ভেসে বেড়ান সূর্যে, চন্দ্রে অথবা কবিতায়। তিনি পরম শান্তির জন্য পথ হাঁটেন। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর পাঠককেও।
এই কবি লিখছেন দীর্ঘদিন থেকে। তিনি লেখেন কম। কিন্তু যখন লেখেন তখন তা হয়ে ওঠে আমাদের সবার প্রেম অথবা প্রার্থনার ভাবগল্প। কবি মোখলেসুর রহমানের কাব্যগ্রন্থ ‘সূর্যস্নানে আশাদের বাড়ি’ বেরিয়েছে ২০১৭ সালের মার্চে। তাঁর কবিতার আত্মকথন,আমাকে ভাবিয়েছে। আর এই যে নিমগ্নতা সেটাই কবিতার সূতিকাগার। কবি লিখছেন,
অজানা পথই আমাদের চিরসাথি
নিরন্তর চলছি, কখনো সমান্তরাল
কখনো পথের টানে কোনো এক অচেনা আকাশে
অফুরন্ত সবুজের মাঝে ভিড় করে পাতাহীন অবয়ব।
[ অমরের পাললিপি ]

মোখলেসুর রহমান তাঁর কবিতায় জীবন বন্দনায় ব্যাপৃত করেছেন নিজেকে বিভিন্ন আঙ্গিকে। তাঁর কবিতা সেই দৃঢ়তার প্রমাণ দিয়ে যায়।
১.
জীবন রহস্যের কী অপার খেলা
বোধি আছে গভীর বোধির বিন্যাসে
প্রেমিক রোমাঞ্চ নিয়ে আমি দেখি বোধিকে
বোধির ক্রমকাল চঞ্চল খেলায় প্রকৃতি জুড়ে
এই আছি,এই নেই আমি
[ আমার অস্তিত্বে আমি ]

২.
কখনও সময়ের কাছে বসে থাকি তন্ময় হয়ে
পরখ করি ধ্যানের মগ্নতা। আকাশের
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মন। এবং ধ্যানের মগ্নতা
ভাঙে কোনও এক সমভেদী আলোর নিশানা।
[ ধ্যানের যৌবন]

৩.
আমার বড়ো ইচ্ছে করে
দাঁড়িয়ে দেখি গাছ ও মানুষ
মনের ভেতর মানুষ আর গাছ
দীর্ঘকাল ধরে বাস করে আসছে
যেমন পানির মাঝে বাস করে মাছ।
[ গাছ ও মানুষ ]
এভাবে তিনি চিত্রায়ন করেছেন প্রাণের রূপকল্প। এভাবেই তিনি পৌঁছেছেন পাঠকের মননে।

দুই
মোখলেসুর রহমানের কবিতা পড়ে আমার যে বিষয়টি বার বার মনে পড়েছে, তা হচ্ছে তিনি খুব পরিকল্পিতভাবে সহজ শব্দ ব্যবহার করেছেন তাঁর কবিতায়। কবিতা কতটা মসৃণ হলে পঠনপ্রিয় হয়ে ওঠে? এমন একটা ধারণা আমরা পাই একজন মার্কিন কবি ই ই কুমিংসের একটি নিবন্ধ থেকে। কুমিংস বলেন, ‘কবিতা আমার বিমূর্ত আরাধনা। আমি সেই প্রার্থনায় আমার প্রকৃতিকে খুঁজি। হ্যাঁ, কবি সেই প্রকৃতির বরপুত্র। পাঠককেও দেখিয়ে যান স্বপ্নের ঢেউ আর আলোর বিস্তার।’
মোখলেসুর রহমান তাঁর এই কাব্যগ্রন্থে কিছু কবিতাকে টেনে দীর্ঘ করেছেন; যা তিনি আরও অল্প কথায় বলতে পারতেন। ‘ভোগের খাই খাই কলা’- তেমনি একটি কবিতা। আমাদের চারপাশে এখন ভোগবাদী সময়। তা নতুন করে বলার কিছু তখনই হয়, যখন একজন কবি নতুন ব্যঞ্জনায় তা ব্যক্ত করতে পারেন। এবং এই কবিতায়ই তিনি শেষ পঙ্‌ক্তিতে বলেছেন, ‘আশায় বাঁধে ঘর। সূর্যস্নানে যেতে আশাদের বাড়ি কতদূর।’
কালের গতি সব সময়ই অনুভবের। কালমগ্ন চেতনা ধারণ করে শুদ্ধাচারী কবিই পারেন পৌঁছে যেতে যাপিত প্রেমের গহিনে। তিনি তা পেরেছেন তা বলা যায় সানন্দে। আমি কবিতা বিচারে বসলেই দুটি নদী আমাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একটি ‘ভবনদী’ আর অন্যটি ‘ভাবের নদী’। এই কবির কবিতায় ভাববাদ আমাদের হৃদয়ে নতুন দ্যোতনা ছড়ায়। যখন তিনি লেখেন,
‘ভালোবাসায় দেখা পাওয়া সবুজ গম্বুজ, উঁচু উঁচু মিনার
সুউঁচুমান সুলিলত আহ্বানের সুর। আকাশ-মাটি-জল
সঙ্গে মানুষের চোখ ও মুখের ধ্বনি। আমার আমিতে
আমার ভেতর শব্দ ভাঙে, শব্দ গড়ে, নাচে ভেতরে
বাস করা জানা জানা ভাষার অক্ষর সকল।’
[ একা হলে আমি একা নই ]
বিশ্বসাহিত্যের সংবিধান বলে, কবিতা হচ্ছে সাহিত্যের সবচেয়ে শিল্পিত ও শক্তিশালী মাধ্যম। একটি কবিতার কয়েক পঙ্‌ক্তি নিয়ে লেখা যেতে পারে একটি বড় উপন্যাস। কবিতার মধ্যে নান্দনিকতা থাকে। থাকতে হয় তেমনি প্রতিবাদী চেতনার স্ফুরণও। গতানুগতিক বিষয় ও বক্তব্য কবিতাকে অসার ও অপ্রয়োজনীয় করে তোলে মাঝে মাঝেই। প্রকৃত কবির কাজ হলো, ধ্যান, অনুশীলন ও সাধনার মাধ্যমে নিজেকে পরিশীলিত ও পরিপক্ব করে তোলা। মোখলেসুর রহমানকে ভবিষ্যতে সেদিকে মনযোগ দিয়েই এগোতে হবে। কবির কবিতায় না পাওয়ার বেদনা আছে। আছে আমাদের মহান বিজয় অর্থবহ না হওয়ার আক্ষেপও।
এই সব যুদ্ধমত্তা আর ভাল্লাগে না।
সহিষ্ণুতা-সমঝোতা চলে গেল গঠীর সমুদ্রের জলে
ওখানে প্রাণীরা কি প্রাণ খুলে হাসে
এইখানে পথেঘাটে প্রান্তরে, মাংসাশী সম্পর্ক
উড়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে আকাশে সুখের পালক
স্বাস্থ্যবতী হাস্যোজ্জ্বল পৃথিবী চলে যাবে মঙ্গল গ্রহে।
[বিজয়ের বারান্দায় চতুর শিয়াল]
আরও অনেক কিছুই হতে পারত এই দেশে, এই গণমানুষের। কবির আক্ষেপ মূলত আপামর মানুষেরই সমস্বর যেন।

তিন
একটি পরিণত কবিতার আবেদন, শৈলী, রূপ, ভূমিকা সব সময়ই অফুরন্ত ও অনির্বাণ। বিভিন্ন পাঠক বিভিন্ন আঙ্গিকে তা বিচার–বিশ্লেষণ করবেন। গ্রহণ করবেন, বর্জন করবেন, আলোচনা করবেন। একটি কবিতা সেভাবেই সার্থক হয়ে ওঠে। সার্থক হয়ে ওঠে কবির প্রচেষ্টা। ক্রমশ কবিতার নির্মাতাও হয়ে ওঠেন সার্থক প্রদর্শক। আমরা জানি, কবিতা ও কাব্য আলোচনা তখনই পূর্ণাঙ্গ হয়ে ওঠে যখন একজন কবিকে জানা হয়।
একই সঙ্গে জেনে নিতে হয় কবিতার সময়কে, বাস্তবতাকে, কবিতা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটকে। এবং তুলনামূলক সমকালীন বিশ্ব প্রেক্ষাপট ও মানবিক দিকগুলোকে। সবগুলো দিকের সম্মিলনী ঘটিয়েই এগোয় কবিতা। মোখলেসুর রহমান কবিতায় তাঁর বিশ্বপরিধি আরও বাড়াতে পারতেন। তিনি কবিতায় দর্শন, মানবিকতা, দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, প্রেম ও কৃষ্টি-ঐতিহ্যকে ধারণ করেছেন। এটা ‌তার সজীব সফলতা।
তুষের আগুন থেকে যেন
কাঠ-কয়লার আগুন জ্বলছে
জ্বলছে চারিদিকে মানুষের মনের আগুন
কী জ্বালা হৃদয় তো দগ্ধই হয়ে গেল
কী আর বাকী শুধু সময়ই আছে।
এমন সময়ের নামতা থেকে নামুক কিছু
মানবতার বর্ষণ।
[ চলছে ভালোবাসার বিরতি]
প্রাণের ভেতরের ভাঙচুর খুবই তাৎপর্যময়। আমাদের দেহের ভেতরে প্রতিটি মুহূর্তে লাখ লাখ রক্তকোষ ভাঙছে প্রতিনিয়ত। আবার নতুন করে গড়ে উঠছে হিমোগ্লোবিন। আমাদের চোখের আড়ালে অসংখ্য রকমের ভাঙাগড়া ঘটে যায়। যা আমরা কিছু দেখি, কিছু দেখেও দেখি না। জগৎ কিন্তু ঠিকই দেখতে পারে কবি-হৃদয়ের আর্তি। মাঝে মাঝে ক্ষরণ কবিকে জাগতিক আলো থেকে কাছ থেকে নিয়ে যার অন্য এক ভুবনে। নশ্বর ভুবন ছেড়ে অবিনশ্বর সত্তার কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করেন কবি।
এই গ্রন্থে কবি বার বার সমর্পিত হয়েছেন তাঁর নিজ সত্তার কাছে। ৭২ পৃষ্ঠার বইটি প্রকাশ করেছে ‘নাগরী’। চমৎকার প্রচ্ছদ এঁকেছেন এন্টনি ফিরিঙ্গি। মূল্য রাখা হয়েছে ১৪০ টাকা। এই কবিকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। কোনো কবিরই পথ ফুরোয় না। কবিতার ধ্যানী মনীষা ও বিচিত্রতা তাঁকে আরও বর্ণময় করে তুলুক।