Thank you for trying Sticky AMP!!

স্কুলেই নেতৃত্বের ঝলক

১৯৩৯ সালের ছাত্র নেতা শেখ মুজিব

১৯৩৯ সালের কথা। গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলের ছাত্র-শিক্ষক, স্কুল পরিচালনা পর্ষদ সবাই ব্যস্ত। স্কুলের শ্রেণিকক্ষ, বারান্দা, পায়খানা, প্রস্রাবখানা সব ঝকঝকে পরিষ্কার। গাছ থেকে একটি ঝরা পাতা উড়ে এসে বারান্দায় পড়লে প্রধান শিক্ষক কাউকে কিছু না বলে নিজেই ঝট করে পাতাটা তুলে ফেলছেন। দুই সপ্তাহ আগেই ছাত্র-ছাত্রীদের বলে দেওয়া হয়েছে, সেদিন যেন সবাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মার্জিত পোশাক পরে স্কুলে হাজির হয়। কারণ ওই দিন অবিভক্ত
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক স্কুল
পরিদর্শনে আসবেন, সঙ্গে থাকবেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যিনি পরবর্তীতে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হন।
ভালোয় ভালোয় স্কুল পরিদর্শন শেষে মন্ত্রী মহোদয় ডাক বাংলার দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন—এমন সময় একদল ছাত্র এসে হঠাৎ তাঁদের পথ আগলে দাঁড়াল। ছাত্রদের এমন কাণ্ড দেখে প্রধান শিক্ষক তো রীতিমতো ভড়কে গেলেন। তিনি চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘এই তোমরা কী করছ, রাস্তা ছেড়ে দাও।’ ছাত্ররা প্রধান শিক্ষকের কথায় কর্ণপাত না করে হ্যাংলা পাতলা লম্বা ছিপছিপে মাথায় ঘন কালো চুল, ব্যাক ব্রাশ করা একটি ছেলে গিয়ে দাঁড়াল একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে। মন্ত্রী মহোদয় জিজ্ঞেস করলেন, কি চাও? বুকে সাহস নিয়ে নির্ভয়ে সে উত্তর দিল, ‘আমরা গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশনারি হাইস্কুলেরই ছাত্র। স্কুলের ছাদে ফাটল ধরেছে, সামান্য বৃষ্টি হলেই সেখান থেকে বৃষ্টির পানি চুঁইয়ে পড়ে আমাদের বই-খাতা ভিজে যায়। ক্লাস করতে অসুবিধা হয়। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার এ ব্যাপারে বলা হলেও কোনো ফল হয়নি। ছাদ সংস্কারের আর্থিক সাহায্য না দিলে রাস্তা ছাড়া হবে না।’
কিশোর ছাত্রের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, সৎ সাহস আর স্পষ্টবাদিতায় মুগ্ধ হয়ে হক সাহেব জানতে চাইলেন, ছাদ সংস্কার করতে তোমাদের কত টাকা প্রয়োজন? সাহসী কণ্ঠে সে জানাল, ‘বারো শ টাকা।’ মুখ্যমন্ত্রী প্রত্যুত্তরে বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমরা যাও, তোমাদের ছাদ সংস্কারের ব্যবস্থা আমি করছি।’
মুখ্যমন্ত্রী তাঁর তহবিল থেকে ওই অর্থ মঞ্জুর করে অবিলম্বে ছাদ সংস্কারের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দিলেন। এমনি এক দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে যার জীবনযাত্রা শুরু এই ছাত্রনেতার, তিনি আর কেউ নন। তিনি হলেন আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু সে সময়ে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশনারি হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন।
নারকেল-সুপারি বনবীথির ছায়াঘেরা মধুমতির তীর ছোঁয়া সবুজ শ্যামল গ্রাম টুঙ্গিপাড়া। তদানীন্তন ভারতীয় উপমহাদেশের বঙ্গ প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেন।
অনেক জ্ঞানী-গুণী, কবি-সাহিত্যিক, দেশপ্রেমিক-রাজনীতিবিদ জন্মগ্রহণ করেন ফরিদপুরে। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের মধ্যযুগীয় প্রখ্যাত কবি আলাওল, পল্লিকবি জসিম উদ্দিন, ফরায়েজি আন্দোলনের অন্যতম নেতা হাজি শরীয়তুল্লা ও তাঁর ছেলে মুহিত মহসীন দুদুমিয়া, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ কাজী মোতাহার হোসেন, মুক্তিযোদ্ধা বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ প্রমুখ। প্রসিদ্ধ উপন্যাস ‘বিষাদ-সিন্ধু’-এর রচয়িতা মীর মশররফ হোসেনের জন্ম ফরিদপুরে না হলেও তিনি তাঁর বাল্যকাল কাটিয়েছেন ফরিদপুর।
বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা সায়েরা খাতুনের সংসারে চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তৃতীয়। তার বড় বোন ফাতেমা, মেজ বোন আছিয়া, সেজ বোন হেলেনা ও ছোট বোন লাইলী বেগম। একমাত্র ছোট ভাইয়ের নাম ছিল শেখ আবু নাসের। তখন বাবা-মা বড় ছেলেকে আদর করে ডাকতেন ‘খোকা।’ সেই হিসেবে শেখ মুজিবের ডাক নাম ছিল ‘খোকা।’ কথিত আছে, শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ব পুরুষ ছিলেন শেখ আউয়াল, যিনি মোঘল শাসন আমলে বাগদাদ থেকে বাংলায় আসেন ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে। সেই শেখ আউয়ালেরই বংশধর শেখ আবদুল হামিদ। শেখ আবদুল হামিদের ছেলে শেখ লুৎফর রহমান যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বাবা। শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (হিসাব রক্ষক) ছিলেন। তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী, ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি। শেখ মুজিবের জীবনে বাবার আদর্শ বিরাট ভূমিকা রেখেছে। অন্যায়, অসত্য, নির্যাতন, ভয়ভীতির কাছে কখনো মাথা নত করেননি শেখ লুৎফর রহমান।
টুঙ্গিপাড়ার শ্যামল পরিবেশে শেখ মুজিবের জীবন কাটে দুরন্তপনায়। মধুমতির ঘোলাজলে গাঁয়ের ছেলেদের সঙ্গে সাঁতার কাটা, দৌড়-ঝাঁপ, দল বেঁধে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ভলিবল খেলায় তিনি ছিলেন দস্যি বালকদের নেতা। তখন কে জানত, এই দস্যি বালকদের নেতাই একদিন বিশ্বনেতা, বাঙালি জাতির পিতা হবেন? শেখ মুজিব অনেকটা দেরিতে পড়ালেখা শুরু করেন। গৃহ শিক্ষক মৌলভি সাখাওয়াৎ উল্লাহর কাছে তাঁর শিক্ষার হাতেখড়ি। ১৯২৭ সালে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন যখন তার বয়স সাত বছর। ১৯৩১ সালে বাবা লুৎফর রহমান পরিবার নিয়ে তাঁর কর্মস্থল গোপালগঞ্জ আসেন। খোকাকে ভর্তি করে দেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে। এখানে বছর দেড় যেতে না যেতেই খোকা আক্রান্ত হলো বেরিবেরি রোগে। এই বেরিবেরি রোগ থেকেই তার চোখে জটিল অসুখ দেখা দেয়। যার নাম ‘গ্লোফুমা।’ ছেলের চিন্তায় বাবা লুৎফর রহমান অস্থির হয়ে পড়লেন। শুভাকাঙ্ক্ষীরা পরামর্শ দিলেন খোকাকে চিকিৎসার জন্য কলকাতা নিয়ে যাওয়ার।
কলকাতা তখন ছিল বঙ্গ প্রদেশের রাজধানী। সেখানে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চক্ষু বিশেজ্ঞ ডা. টি আহমেদ তার চোখের সার্জারি করেন এবং তিনি সুস্থ হয়ে উঠেন। গ্লোফুমা থেকে সুস্থ হলেও ডাক্তার তাঁকে চোখে চশমা ব্যবহারের পরামর্শ দিলেন। চোখে অসুখের কারণে ১৯৩৪ সাল থেকে চার বছর তিনি বিদ্যালয়ের পাঠ চালিয়ে যেতে পারেননি। সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই স্কুলে থাকাকালেই তাঁর প্রতিভা আর নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। এমনিতেই ক্লাসের অন্যান্য ছেলের চেয়ে কিছুটা বয়সে বড়, সেই সঙ্গে তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা সবাইকে মুগ্ধ করে। সবার প্রিয় পাত্রে পরিণত হন তিনি। তাঁর পরিচিতি বাড়তে থাকে ‘মুজিব’ ভাই হিসেবে।
লেখার শুরুতে বলা হয়েছে, অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যখন গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুল পরিদর্শনে আসেন, তখন তাঁর সঙ্গে ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিব যখন মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে বাদানুবাদ করছিলেন, তিনি পেছনে দাঁড়িয়ে তা দেখছিলেন। শেখ মুজিবের সৎসাহস, কর্তব্যবোধ তাঁর মনোযোগ আকর্ষণ করে। ডাকবাংলোয় ফিরেই তিনি শেখ মুজিবকে ডেকে পাঠালেন। তিনি তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন এবং কলকাতায় তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। পরবর্তীতে এই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরেই শেখ মুজিব রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
স্কুল জীবনেই শেখ মুজিব প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। মুজিব যখন নবম শ্রেণির ছাত্র সে সময়ে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দেওয়ার সময় তাঁকে মিথ্যা অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। সম্ভবত এটিই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম গ্রেপ্তার। পরে ছাত্রদের চাপের মুখে পুলিশ শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন। সেখানে তিনি এক বছর মেয়াদে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪২ সালে শেখ লুৎফর রহমানের ‘খোকা’ শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুল থেকে প্রবেশিকা (বর্তমান স্কুল মাধ্যমিক) পাশ করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজের বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত এই কলেজটি তখন বেশ নামকরা ছিল।