Thank you for trying Sticky AMP!!

স্মৃতি-বিস্মৃতির রহমান সাহেব

পরিবারের সঙ্গে মতিউর রহমান

অবিভক্ত ভারতের পূর্ব বাংলা। ব্রিটিশ ভারতের এক রক্ষণশীল আর পশ্চাৎপদ এলাকা কানাইঘাটের জুলাই-পীরনগর। শিক্ষা, সংস্কৃতিতে কতটা পশ্চাৎপদ ছিল আজকের সময়ে শুধু অনুমানই করা যাবে। যাওয়া যাবে না বাস্তবতার গভীরে। সময়টা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজার আগে, ১৯৩৬ সাল। সময়ের এক টগবগে তরুণ মতিউর রহমান। অঞ্চলের একমাত্র উচ্চতর ইংরেজি স্কুল থেকে সে বছর ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। উচ্চশিক্ষা লাভের প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা ছিল তাঁর। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। ক্যানসারে বাবার মৃত্যুতে বিপত্তি ঘটে। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে তাঁকে চাকরির সন্ধান শুরু করতে হয়।

ডিগবয়, তখন আসাম ওয়েল কোম্পানি লিমিটেডের বিখ্যাত জ্বালানি শোধনাগার। জুনিয়র হিসাবরক্ষক হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন মতিউর রহমান, অখণ্ড উপমহাদেশ যখন রাজনীতির ঐতিহাসিক বাঁকে। ধর্মের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগের মহাআয়োজন চলছে।

১৯৪৭ সালে মতিউর রহমান ভারত বিভক্ত হলে পাকিস্তানে থাকাকে পছন্দ করে পূর্ববাংলায় ফিরে আসেন। পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁকে তাড়িত করে। খুলনার জুবিলি জুটমিলে যোগ দেন তিনি। বছর দুই পরে স্থানান্তরিত হয়ে চট্টগ্রাম চলে যান। ইস্পাহানি জুট মিলসে প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পান। ব্রিটিশ ভারতের বনেদি প্রতিষ্ঠান তখন ইস্পাহানি জুট মিলস।

কানাইঘাট এলাকার কর্মসন্ধানী মানুষের মধ্যে হিড়িক পড়ে চট্টগ্রামে যাওয়ার। এলাকার বিপুলসংখ্যক মানুষ ইস্পাহানি জুট মিলসে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন মতিউর রহমানের প্রচেষ্টায়। এসব প্রান্তিক শ্রমিকের তখন চাকরির প্রথম তিন মাস ছিল শিক্ষানবিশ কাল। বেতন পেতেন না শ্রমিকেরা। তিন মাস দীর্ঘ সময়। থাকা খাওয়ার ব্যয় কুলিয়ে ওঠা অনেকের পক্ষে সহজ ছিল না। তিনি স্থানীয় মুদি দোকানে, তাঁর নিজের নামে বাকির খাতা খুলে দিতেন।

ব্রিটিশ তাড়িয়ে পূর্ব বাংলায় তখন স্বাধীনতার ডাক। বাঙালির এক শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠছেন। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে চাকরি ছেড়ে ১৯৬৯ সালে কানাইঘাট ফিরে আসেন মতিউর রহমান। উনসত্তরের উত্তাল রাজনৈতিক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় তখন।

মতিউর এক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা মানুষ। আমাদের জাতীয়তা বিনির্মাণের ধারাবাহিকতায় তিনি বা তাঁর সমসাময়িক মানুষের ইতিহাস লেখার যোগ্যতা আমার নেই। এসব প্রান্তিক মানুষের বিস্মৃত ইতিহাস, অকথিত ইতিহাস চর্চায় আমাদের কারও কোনো দায় আছে কি না, জানি না। নিজেদের বর্তমান নিয়ে আমাদের বিব্রত কোলাহলে মতিউর রহমানদের কর্ম ও ত্যাগের বিবরণ হয়তো ঊহ্যই থেকে যায় ইতিহাসের সাদা পৃষ্ঠা গুলোতে।

মতিউর রহমানের মেয়ে উষা আমার স্ত্রী। বাবা দিবসে নয়, বাবার জন্য বাঙালি মেয়ের মন কাঁদে সব সময়। টুকরো টুকরো কথায় ইতিহাস উঠে আসে। নিজের বাবাকে নিয়ে আমি নতজানু হই। অনুসন্ধানী মন আমাকেও উসকে দেয়।

১৯৮৯ সাল, উষা আর আমার বিয়ের মাস দু-এক পরের ঘটনা। বন্ধুর মতো হলেও উষার বড় ভাইকে জুয়েল ভাই ডাকতে হয়। ঘাড়ে মাথা একটা বলেই নয়, এ আমাদের সংস্কৃতি। তো জুয়েল ভাই একদিন আমাকে কানাইঘাট নিয়ে যান। তাঁদের থানা সদরের কাছে নন্দিরাই গ্রামে। উষা আগে থেকে অবস্থান করছিলেন সেখানে। শহর থেকে আমরা দুজন গিয়ে পৌঁছাই সন্ধ্যার পর। ঘরের বাইরে আমাদের অপেক্ষায় পায়চারি করছিলেন উষা, জুয়েল ভাইদের বাবা মতিউর রহমান আমার শ্বশুর।

রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেলে কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল মতিউর রহমানের সঙ্গে। আমার সঙ্গে আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলেন। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ মনে হচ্ছিল আমার। হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাস হাতে ছিল। আমার বই পড়ার অভ্যাসটা যে তাঁর ভালো লেগেছে, এটি কথায় কথায় জানিয়েছিলেন সে রাতে।

১৯৯০ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি। উষা তখনো বাংলাদেশে। স্ত্রী দেশে রেখে বেশি দিন প্রবাসে থাকা যায় না। পরের বছর দেশে যাই। নানা উপলক্ষে তাঁর সঙ্গে আবারও দেখা হয়।

একদিন কাকতালীয়ভাবে দেখা সিলেটের হাউজিং এস্টেট এলাকার সড়ক পথে। তাঁরা ডাক্তারের চেম্বার থেকে রিকশায় করে বাসায় যাচ্ছিলেন। নাতিরা ছিল সঙ্গে। কোনো কাজে আমি উল্টো দিকে যাওয়ার পথে, তাঁকে অতিক্রম করছিলাম। রিকশা থামিয়ে, নেমে দেখা করব। তিনি আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য, তাঁর রিকশা থেকে নামার চেষ্টা করছেন। আমি নামতে না দিয়ে, ডাক্তার কী বললেন জিজ্ঞেস করি।

শ্রদ্ধা মেশানো ভালোবাসার প্রকাশ তাঁর কথা বলায়। দেখলে যে কেউ সহজে মুগ্ধ হতো। আমার সঙ্গে ‘আপনি’ সম্বোধন করে কথা বলছিলেন। শ্বশুর যে জামাইকে তুমি সম্বোধন করার অনুরোধটি করা হয়নি আমার। মতিউর রহমানের কথা বলায় ছিল এক আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ছাপ। ছিল এক নিজস্ব আভিজাত্য। যেটা সেদিন মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেছিলাম। তাঁর সঙ্গে যে আর কখনো দেখা হবে না, সেবার আমেরিকায় ফিরে আসার সময় একেবারও ভাবিনি।

পরের বছর উষাও আমেরিকায় পাড়ি জমান। বিদায় মুহূর্তে উষা বাবাকে জড়িয়ে ধরেন। তখন তিনি খুব সহজভাবে বলেছিলেন, মা, তুমি তো চলে যাচ্ছ। আমার সঙ্গে তোমার এ জীবনে আর দেখা হবে না। উষা কথাটি বলে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন। ১৯৯৩ সালের ১৫ জুন জগতের সব বাঁধন ছিন্ন করে ওপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন উষার বাবা।

দীর্ঘ ২৭ বছর পর, ২০২০ সালের জুন মাস। করোনাভাইরাসের তাণ্ডবে নাকাল অবস্থা সারা বিশ্বের। সারা বিশ্বে আজ ছড়িয়ে আছেন মতিউরের গর্বিত সন্তানেরা। বাবা দিবসের এই সপ্তাহটি। তাঁরা স্মৃতিচারণ করছেন। বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে। এক ভার্চ্যুয়াল মিলন মেলায় বাবার জন্য আর্তি জানানো সন্তানদের কথায় উঠে আসে এক মতিউর রহমানের নানা কথা। ব্যক্তি, সমাজ, স্বদেশের বিরান বাস্তবতায় মতিউর রহমানের সন্তানদের উচ্চারণ বাবার জন্য অনেকের উচ্চারণ হয়ে দাঁড়ায়।

জুয়েল ভাই, উষার আরেক ভাই টুটুল—দুজনই বাবার বর্ণাঢ্য জীবনের স্মৃতিচারণ করেন। তাঁদের এ স্মৃতিচারণে উঠে আসে ব্রিটিশ শিক্ষাব্যবস্থার কথা। তখনকার পূর্ব বাংলার প্রান্তিক জনপদ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার অজানা সব কাহিনি।

১৯৯১ সালের শীতকাল। ৪৫ দিন বাংলাদেশে অবস্থানকালে আমার আব্বা ও ছোট চাচার সঙ্গে গ্রামের বাড়ি বারাপইতে যাই। দিনটি শুক্রবার ছিল। বাড়িতে গেলে গ্রামের মসজিদের পাশে দাদার কবর জিয়ারতের রেওয়াজ ছিল। গ্রামের মুরব্বিরা ছোটবেলা আমাকে দেখেছেন। জুমার নামাজের পর মসজিদের আঙিনায়। অনেক দিন পর আমাকে দেখে উৎসুক কিছু মানুষ। চাচা গ্রামের তাঁর এক অগ্রজকে বলছিলেন, আপনি কি জানেন, আমাদের মাহবুবতো এখন রহমান সাহেবের মেয়ের জামাই? আরও অন্তত চারজন এগিয়ে আসেন। রহমান সাহেবের প্রশংসায় তারা পঞ্চমুখ। ইস্পাহানি জুট মিলসে শ্রমিক ছিলেন তাঁরা। রহমান সাহেবের সরাসরি সহায়তার সেখানে চাকরি পেয়েছিলেন। ইস্পাহানি জুটমিলে চাকরির জন্য যান এসব মানুষ। শুধুমাত্র এ চিন্তা করে, নিজ থানার একজন রহমান সাহেব সেখানে ভালো অবস্থানে আছেন। চাকরি পেতে সহায়ক হবে, হয়েছেও তাই। নিজ এলাকার মানুষদের সঙ্গে তাঁর তখনকার আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণে মুগ্ধ কয়েকজন মানুষকে সেদিন দেখেছিলাম। সরলপ্রাণ সেই মানুষগুলোর চোখে রহমান সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা স্পষ্ট ছিল।

ইস্পাহানিতে তখনকার সময়ের আকর্ষণীয় বেতনে চাকরি করেছেন মতিউর রহমান। কোম্পানি প্রদত্ত কোয়ার্টার, জিপ গাড়ি ছিল তাঁর। একপর্যায়ে সায়াটিকা রোগে আক্রান্ত হন তিনি। কোম্পানির উদ্যোগে চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়। সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন।

১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি কানাইঘাট থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হাবিবুর রহমান, সেই আসনে নৌকা মার্কার প্রার্থী। তাঁকে জয়ী করতে সক্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক হিসেবে নিজ এলাকায় ব্যাপক সমাদৃত হন তিনি। স্বাধীনতাবিরোধীদের রোষানল থেকে বাঁচতে পরিবারসহ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়েছিল তাঁকে। নয় মাস সেখানে অবস্থান করেন।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে মতিউর রহমান আবার চট্টগ্রাম চলে যান। বছর খানেক হাফিজ জুটমিলে চাকরি করেন। ১৯৭৪ সাল, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লব বাকশালের ডাক শুরু হয়। জাতির পিতার প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল প্রচণ্ড। আবদুস সামাদ আজাদ, দেওয়ান ফরিদ গাজীর ডাকে সিলেটে চলে আসেন তিনি।

বাকশালের থানা প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার নির্দেশ ছিল তাঁর প্রতি। দলীয় কৌশল অনুযায়ী নিজ ইউনিয়ন পশ্চিম দিঘিপাড় থেকে ১৯৭৪ সালে নির্বাচনে অংশ নেন। জমিয়তে উলামা ইসলামের মাওলানা মুশাহীদ সাহেবের ছেলে ফারুক। তাঁর বিপরীতে প্রার্থী।

মতিউর রহমানের দাঁড়ি নেই। ক্লিন শেভ করেন। প্যান্ট শার্ট পরা, মাথায় টুপি না দেওয়া মানুষ। কানাইঘাট এলাকায় জুয়া খেলায় বসলেও টুপি মাথায় থাকতে হয়। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী একজন মাওলানার ছেলে। কালোবাজারিদের দৌরাত্ম্য তখন সীমান্ত এলাকায়। ধর্মান্ধ আর স্বাধীনতাবিরোধীদের সম্মিলিত তৎপরতা। নির্বাচনে মতিউর রহমানে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।

নিজ এলাকার মানুষের এত উপকার, এত মানুষকে চাকরি পেতে সহায়তা করলে। তোমার ওই সব লোকজনের ভোট কই?

জুয়েল ভাই স্মরণ করলেন, তাদের মায়ের এমন রসিকতার উত্তরে মতিউর রহমান হেসে বলতেন, এক কাপ চা নিয়ে আসো কড়া করে!

পারিবারিক জীবনে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেন মতিউর রহমান। শফিকুন্নেসা খাতুন এক বিদুষী নারীকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পেয়েছিলেন তিনি। উষা বলেন, মা নারী অধিকার সচেতনতাসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িয়ে রাখতেন।

পারিবারিক জীবনে এ দুজন নয় সন্তানের মাতা-পিতা। মতিউর রহমানের সন্তানেরা আজ পূর্ব-পশ্চিমের নানা দেশে ছড়িয়ে আছেন। ব্রিটিশ বাংলার অনগ্রসর জনপদের এক অগ্রসর মানুষ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিলেন মতিউর রহমান। জীবন তাঁকে ভাসিয়ে নিয়েছে দেশের নানা প্রান্তে। নানা বাঁকে। দেশের ইতিহাসের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এমন বিস্মৃত মতিউর রহমানরা তাদের সময়কে আলোকিত করেছেন। নিজেদের প্রয়াস দিয়ে দেশ, সমাজ সংসারকে দেদীপ্যমান করে গেছেন। অপ্রাপ্তির কোন বেদনা থাকলেও মুখ ফসকে বলেননি। আজ তাঁদের উত্তরাধিকারের প্রবহমান স্রোতোধারা মিশে গেছে বিশ্ব সভ্যতার মহাসড়কে। তিনি দেখে যাননি ঠিকই। কখনো উত্তর প্রজন্মের ভালোবাসার উচ্চারণে, কখনো দেশ মাতৃকার বিস্মৃত ইতিহাসের অকথিত পাঠে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে থাকবে।

বাবা দিবসের বিনম্র শ্রদ্ধা বিস্মৃত ইতিহাসের মানুষ মতিউর রহমানের প্রতি।