Thank you for trying Sticky AMP!!

'আল্লাহ ভরসা'

ডর-ভয় কি জিনিস? আর সাহস? আমার অনুভূতিতে এসব এখন নেই।

আজ কি বার? তাও ভুলে গেছি। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের ক্যালেন্ডারে গিয়ে জানতে পারি মঙ্গলবার। সিলেট থেকে আমার স্ত্রী, হাসি যোগ করলেন পয়লা বৈশাখ।

আমি ঢাকায়, হাসি সিলেটে, ছেলে-মেয়ে নিউইয়র্কে।

দুদিন আগেও প্রথম আলোর অ্যাপ টিপে উত্তর আমেরিকার খবরে চোখ বুলাতাম। এখন করি না।

এক কক্ষে স্বামীর লাশ, অন্য কক্ষে বসে আছেন স্ত্রী ও দুই সন্তান অথবা ‘রোগী আসছে, আর একটু পর পর মৃত ঘোষণা করছি’—এ সব শিরোনাম আর নিতে পারছিলাম না।
মানব জাতি কখনো এমন অদৃশ্য ঘাতকের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি।

‘হু ইজ নেক্সট?’
কেউ জানে না। প্রশ্নকর্তাও না।

হাসি বাংলাদেশে আসার কথা ছিল না। আমিই নিয়ে এসেছিলাম। দেড় মাস ধরে দুজন দুই শহরে, লকডাউন। সন্তানদের জন্য তার কান্না আমি শুনি। তাকে বোঝানোর ভাষাও আমার নেই। ইংরেজি vulnarable শব্দটা এক শ ভাগ আমাদের জন্য প্রযোজ্য।
মীরজাদী সেব্রিনা যখন বলেন, করোনাক্রান্ত মৃত ব্যক্তি হার্টের রোগী ছিলেন, তার দেহে স্ট্যান্ট লাগানো। নিজের কথা মনে হয়, তিনটা স্ট্যান্ট ছাড়াও আছে পেস মেকার। আমেরিকা থেকে যে ওষুধ নিয়ে এসেছিলাম, তাও শেষ।
হাসির ক্রনিক এজমা ও ডায়াবেটিস।

আমার ভ্রাতৃবধূ মনি অবশ্য বলে ভিন্ন কথা। ‘ভাইসাহেব, আপনি ও ভাবিকে রক্ষার জন্য আল্লাহ আপনাদের বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন।’ তার কথা হয়তো ঠিক। হাসি কুইন্সের যেখানে চাকরি করেন, সে জায়গায় পড়েছে করোনার ভয়াবহ থাবা।
আমিতো ঢাকায় নামার তিন ঘণ্টার মধ্যে কাঁধ ভেঙে ঘরবন্দী। হাড় এখনো জোড়া লাগেনি। প্রচণ্ড ব্যথা। ডাক্তার দেখানো দরকার। আরও দরকার একজন কার্ডিওলজিস্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ। কোনোটাই পারছি না।

সময়টা বৈরী। ‘প্রবাসী’ পরিচয় দেওয়াটা নিরাপদ নয়।
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন ‘নবাবজাদা’।

ইব্রাহিম চৌধুরী তার রেশ টেনে লিখলেন ‘আমি নবাবজাদা বলছি’। আমি চৌধুরীকে ফোনে বললাম, লেখাটা অসময়ে এসেছে। কোন সহানুভূতি পাবে না বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রীই সহানুভূতি পাচ্ছেন।
রেমিট্যান্সের সঙ্গে প্রবাসীরা মরণব্যাধিটাও এনেছে, এ রূপ এক ধারণার জন্ম নিয়েছে। জানি না, সম্পর্কের এ ক্ষতটা কবে শুকাবে।

হাসি তার অভিজ্ঞতার কথা জানালেন, তাদের বাড়ির কাজের বুয়া এসে বলল, কাউকে বলবেন না, আপনি যে আমেরিকা থেকে এসেছেন। ওই বাড়ির বিলেতির খোঁজখবর নিচ্ছে জনগণ।
আমার মেয়ে চাকরি করে নিউইয়র্কে এক মিডিয়া কোম্পানিতে। ব্রঙ্কাইটিস হওয়ায় কর্তৃপক্ষ তাকে ঘরে পাঠিয়ে বলে, কাজে ফিরতে হলে কোভিড-১৯ মুক্ত—এই সার্টিফিকেট তাকে সংগ্রহ করতে হবে।
শুনে আমি তাঁকে পরামর্শ দিলাম, ঘরে বিশ্রাম নাও, চাকরির দরকার নেই।

মেয়ে হ্যাঁ হ্যাঁ বললেও আমি জানি, সে কোভিড-১৯ টেস্ট করিয়ে কাজে ফিরতে চাইবে। শুনেছি, করেছেও তাই। টেস্টের ফলাফল এখনো হাতে আসেনি।

ভার্জিনিয়া থেকে ভাইপো জামাল ফোন করে জানতে চাইল, চার্টার্ড ফ্লাইটে নিউইয়র্ক ফিরতে ইচ্ছুক কিনা। তার শ্বশুর-শাশুড়ি ফিরছেন। মিরপুর থেকে নিউইয়র্কের লেখক শেলী জামানও জানতে চাইলেন, যাব কিনা। তিনি আমেরিকান দূতাবাস থেকে অফার পেয়েছেন।
আমি যেতে পারিনি। দূতাবাসে আমাদের নাম রেজিস্ট্রি হয়নি। আমি ঢাকায় অসুস্থ, হাসি সিলেটে। কী করে যাই।

নিউইয়র্কে করোনার থাবা যখন তুঙ্গে, সে সময় বাংলাদেশে স্বস্তি ছিল, এতটা বিস্তার হয়নি। এখন চিত্রটা পাল্টে যাচ্ছে। করোনাক্রান্তের হার বেড়েই চলছে। নতুন নতুন এলাকা, নতুন নতুন জেলা লকডাউন হচ্ছে। সরকারের চেষ্টা ও নানাবিধ কার্যক্রম চোখে পড়ছে। বিপদ অন্য জায়গায়। এক শ্রেণির লোকের আইন না মানার প্রবণতা বা অভ্যাস। মসজিদে নিয়মের বাইরে সমাবেশ, রাস্তায় হাওয়া খাওয়া, ঘোরাঘুরি, আড্ডা ইত্যাদি বিপদ ডেকে আনতে পারে। এ ঘাতকের কোন ওষুধ বা ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়নি, একমাত্র ওষুধ ঘরে থাকা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। এ সচেতনতা সৃষ্টি হলেই মুক্তি, অন্যথায় বিপদ সামনে, যম হয়ে দাঁড়িয়ে।

প্রায় তিন যুগের স্মৃতি জড়ানো নিউইয়র্কে কবে ফিরব বা আদৌ ফিরতে পারব কিনা, জানি না। পাশ্চাত্যের কোথাও কোথাও বয়স্কদের বছরের শেষদিন পর্যন্ত আইসোলেশনে রাখার কথা বলছে। কখনো বলা হচ্ছে, ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত না হওয়া পর্যন্ত ঘরে থাকাই উত্তম।
কী করতে হবে, কী করা উচিত, কিছুই জানি না। শুধু অপেক্ষা করছি। এই মহামারি বৈশ্বিক। কোন একক দেশের নয়। তাই বৈশ্বিক উন্নতির সঙ্গেই জড়িয়ে আছে সবকিছু।

নিউইয়র্কে আবাসিক সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরী কয়েকজন সাহসী লেখক ও সাংবাদিককে নিয়ে প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার প্রকাশনা অব্যাহত রেখেছেন। কমিউনিটির সবচেয়ে বিপদের দিনে প্রথম আলোর এই পাশে থাকা অবশ্যই মানুষ মনে রাখবে। তাঁর টিমের ইশতিয়াক রুপু আহমদ, শাহ আহমদ, রহমান মাহবুব, রওশন হক, মনিজা রহমান, রোকেয়া দীপা, তফাজ্জল লিটন, রোমানা লেইস, রাজুব ভৌমিক, জাহিদা আলম, আসিফ মোক্তাদির, আবদুস শহীদ, মনজুরুল হক, এইচ বি রিতা, সানজিদা উর্মিসহ অন্যরা যে অনবদ্য ও আন্তরিক ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন, তা প্রশংসার দাবিদার।

ঢাকায় এক ঘরে একটানা দেড় মাস শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছি আর অঙ্ক কষছি। নিজে বাঁচার অঙ্ক, বিপদ মুক্তির অঙ্ক। কিন্তু কোন অঙ্কই মিলছে না। তবে একটি সূত্র মানলে সব অঙ্ক তা যত জটিল আর কঠিন হোক, অনায়াসে মিলে যাচ্ছে। সে সূত্র হচ্ছে
‘আল্লাহ ভরসা’।

তবে সতর্কতা অবশ্যই মানতে হবে।

ঘোড়াকে বাইরে বেঁধে রেখে মসজিদে ঢুকতে হবে, ‘আল্লাহ ভরসা’ বলে বাঁধন মুক্ত করে দিয়ে নয়।

লেখক: নিউইয়র্কপ্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক।