রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী

মো. তৌহিদ হোসেন
মো. তৌহিদ হোসেন

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যা সংঘটিত হয় দুই বছর আগে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে, যার ফলে কমবেশি সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ ও শিশু প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সেই থেকে, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এই শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী তড়িঘড়ি একটি চুক্তিও সই করে বসেন ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে।

আমার দেখা বা জানা বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বা দ্বিপক্ষীয় চুক্তিগুলোর মধ্যে এ চুক্তিটি সবচেয়ে ত্রুটিপূর্ণ। এতে সবকিছুই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে মিয়ানমার সরকারের সদিচ্ছার ওপর, বাংলাদেশের হাতে কিছুই রাখা হয়নি। চুক্তিটি স্বাক্ষরে চীনা চাপের কথা বলা হয়, তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। ফলাফল আমরা সবাই জানি। একজন রোহিঙ্গাও ফেরত যায়নি দুই বছরে। 

দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে কোনো উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী ফেরত যাবে না এ কথা শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞরা এবং আমার মতো কিছু সাধারণ মানুষ বারবার বলে আসছিলেন। দুই বছর পর এখন সরকারি ভাষ্যেও এর প্রতিফলন দৃশ্যমান হচ্ছে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সব সময় খানিকটা পেছনে তাকাতে হয়, ইতিহাস বিষয়টা টিকে আছে এ কারণেই। পেছনে তাকালে আমরা কী দেখতে পাই? পুনরাবৃত্তি হয়ে যাচ্ছে, তবে ঘটনা পরম্পরা বোঝার জন্য তালিকাটা দেখা প্রয়োজন।

১. ১৯৭৮ সালে আড়াই লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়ন করেছিল মিয়ানমার। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে তাদের প্রায় সবাইকে ফেরত পাঠানো গিয়েছিল। চুক্তিতে বলা হয়েছিল মিয়ানমারের সব আইনসম্মত বাসিন্দাকে ফেরত নেওয়া হবে।
২. ১৯৮২ সালে নতুন আইন জারি করে এক ধাক্কায় রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয় মিয়ানমার। এরপর প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনে নতুন মাত্রা যোগ হয়।
৩. ১৯৯১-৯২ সালে আবার বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নির্যাতনের মুখে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। আবার দ্বিপক্ষীয় চুক্তি, তবে এবার ‘বাসিন্দা’ শব্দটির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় ‘নাগরিক’ শব্দটি। ফলে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অনেকটা জটিল হয়ে যায়। ১৯৭৮ সালের মতো সবাইকে তখন আর ফেরত পাঠানো যায়নি। সেই সময়ে আসা শরণার্থীদের অনেকে এখনো রয়ে গেছে বাংলাদেশে।
৪. ২০০০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অব্যাহত নির্যাতনের মুখে সীমান্ত অতিক্রম করে অন্তত তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং রয়ে গেছে এখানে।
৫. ২০১৬ সালে আবার ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশ ঠেলে দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
৬. সবশেষে ২০১৭ সালের পরিকল্পিত গণহত্যা ও চূড়ান্ত উচ্ছেদের ঘটনা।

এই ঘটনাগুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই, কারণ এর সবগুলোই একসূত্রে গাঁথা। মিয়ানমারের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে রাখাইন তথা মিয়ানমার থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ এবং এ কাজে তারা সফল হয়েছে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তাদের ফেরত নেওয়ার জন্য তারা এ কাজ করেনি, এটা বুঝতে সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধিই যথেষ্ট।

গত দুই বছরে আরও জটিল হয়েছে পরিস্থিতি। মিয়ানমার কর্তৃক নির্ধারিত নিয়মকানুন মেনে অল্প কিছু রোহিঙ্গা পরিবারের তথ্যাদি পাঠিয়েছে বাংলাদেশ। পাঠানো তালিকা থেকে মাত্র ১০ শতাংশের মতো পরিবারকে ‘ক্লিয়ার’ করেছে মিয়ানমার ফেরত নেওয়ার জন্য। যার পরোক্ষ অর্থ এই যে বাকি ৯০ শতাংশ তাদের লোক নয়। এই স্বীকৃত পরিবারগুলোকে ফেরত পাঠানোর জন্য বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে ২২ আগস্ট ঠিক করা হয়েছিল। এমন একটা আবহ সৃষ্টি করা হয়েছিল যেন এ শুরুটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এরপর অব্যাহতভাবে রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে থাকবে। কিন্তু তালিকাভুক্ত একটি পরিবারও ফেরত যেতে রাজি হয়নি। সরকারি মহলে এ ব্যাপারে হতাশা খুবই স্পষ্ট। বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গাদের দাবি যে তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে ওই দেশে তারা ফেরত যাবে না। ২৫ আগস্ট কুতুপালং মধুরছড়া এলাকায় বিশাল সমাবেশ করে রোহিঙ্গারা তাদের এই দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে মিয়ানমার জোর প্রচারে নেমেছে যে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে প্রস্তুত কিন্তু বাংলাদেশের অসহযোগিতার কারণে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার তাদের এই বক্তব্য অগ্রহণযোগ্য বলে বিবৃতি দিয়েছে এবং যথোপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের ব্যর্থতার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
তবে সরকারি ভাষ্যের বাইরেও এ বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। যেমন

১. ফেরত না যেতে রোহিঙ্গাদের উসকানি দেওয়া হচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ আনছেন, অভিযোগের তির প্রধানত এনজিওদের দিকেই তাক করা হচ্ছে। ক্ষুব্ধ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বেশ কিছু নিরাপত্তা বিশ্লেষকও আছেন এ দলে।
২. ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের সমাবেশকে অনেকেই নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন। রোহিঙ্গাদের এই সাংগঠনিক সামর্থ্যকে তাঁরা হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছেন।
৩. রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে, এতে উদ্বেগ এবং ক্ষোভ প্রকাশ করছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, যে করেই হোক রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হোক।
৪. সবচেয়ে কট্টর প্রতিক্রিয়া দেখলাম এক দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে। ‘মিয়ানমারের রাখাইনের অর্ধসভ্য রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে বিশ্বাসঘাতক ও কৃতঘ্নতার প্রতিকৃতি বলে ভাবা হয়’ এমন বাক্যও এতে স্থান পেয়েছে। এই সম্পাদকীয়তে মিয়ানমার সেনাদের অপকর্মের জন্য পরোক্ষভাবে রোহিঙ্গাদেরই দায়ী করা হয়েছে।
এসব অভিযোগের মধ্যে সত্যতা যে নেই, তা নয়। রোহিঙ্গা শিবিরে বিভিন্ন অপরাধের খবর আসছে প্রায়ই। তবে তার মানে এই নয় যে রোহিঙ্গা নারী, শিশু এবং সব পুরুষ অপরাধে জড়িত। যেকোনো গোষ্ঠীর মতো এখানেও ক্ষুদ্র একটি অংশ অপরাধে জড়িত, আর তাদের সঙ্গে স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশও সর্বজনবিদিত। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর অসংগঠিত এবং নেতৃত্বহীন থাকার বিষয়টি আমার মতে বেশি বিপজ্জনক। সমাবেশকে কেন্দ্র করে রোহিঙ্গাদের একটি নেতৃত্ব দৃশ্যমান হয়েছে। আমাদের নিরাপত্তা এবং গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগের মাধ্যমে শিবিরগুলোতে কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে পারে। ওপরে উল্লিখিত সম্পাদকীয়তে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা একেবারে অগ্রহণযোগ্য। কোনো জাতিগোষ্ঠীকে ‘অর্ধসভ্য’ বলে আখ্যায়িত করার আগে আমাদের উচিত আয়নায় নিজের মুখ দেখা।

২২ আগস্টের ফেরত প্রচেষ্টার ব্যর্থতা নিয়ে হতাশা, উদ্বেগ ও ক্ষোভ আমার কাছে অনেকটাই অবান্তর বলে মনে হয়। এই এক হাজার পরিবার ফেরত গেলে আমাদের কোনো লাভ হতো না, বরং জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের আসন্ন অধিবেশনে মিয়ানমার এটাকে তাদের সদিচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ পেত। ফেরত প্রচেষ্টার ব্যর্থতা নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া বরং মূল বিষয় থেকে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছে। মূল সমস্যা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফিরতে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টিতে মিয়ানমারের ইচ্ছাকৃত ব্যর্থতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারকে সেই পরিবেশ সৃষ্টিতে বাধ্য করাই হবে আমাদের লক্ষ্য।
কাজটি সহজ হতো চীন-ভারত যদি এ প্রচেষ্টায় আমদের সঙ্গী হতো। কিন্তু কঠিন হয়ে গেছে বলে হাল ছেড়ে দিলে তো আমাদের চলবে না। চীন, ভারত আমাদের বন্ধু আছে এবং থাকবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে অন্য কোনো কার্যকর বন্ধু খুঁজে নিতে হবে আমাদের।
মো. তৌহিদ হোসেন, সাবেক পররাষ্ট্রসচিব