ইন্টারনেট নয়, ভালো মন্দ নিজের ভেতরে

আয়মান সাদিক
আয়মান সাদিক

প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপ থেকে দুই দিন আগে জানলাম, দেশে প্রতি চার তরুণের মধ্যে তিনজনই জীবনের লক্ষ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন। কর্মসংস্থান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন প্রায় ৭৮ শতাংশ তরুণ। অথচ কী আশ্চর্য, এই তরুণদের ইন্টারনেট ব্যবহারের হিসাব–নিকাশের মধ্যে ‘লিংকডইন’–এর নাম কোথাও নেই!

উদ্বিগ্ন তরুণেরা যদি কাজের খোঁজে নানা সুযোগ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করতেন, দেশ–বিদেশে চাকরির জন্য আবেদন করতে শুরু করতেন, তাহলে তো লিংকডইনেই তাঁদের ভিড় করার কথা। কারণ, পেশাজীবীদের জন্য এটিই সবচেয়ে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, আর কাজের সুযোগসন্ধানীদের জন্য ‘নেটওয়ার্ক’ তৈরি করার সবচেয়ে ভালো প্ল্যাটফর্ম। জরিপ বলছে, তরুণেরা প্রতিদিন গড়ে ৮৭ মিনিট সময় ব্যয় করেন ইন্টারনেটে। প্রতিদিন এই ৮৭ মিনিটের মধ্যে ১০ মিনিটও যদি আত্মোন্নয়নে কাজে লাগানো যেত, তরুণেরা যদি ইন্টারনেটের শক্তি কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন দক্ষতা রপ্ত করতেন, তাহলে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন তরুণদের নিয়ে আমাদের উদ্বেগ অনেকটা কমত।

বাংলাদেশের আনাচকানাচে তথ্যপ্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের সুফল পৌঁছে যাচ্ছে বেশ দ্রুত। কিন্তু ডিজিটাল সাক্ষরতার (ডিজিটাল লিটারেসি) প্রয়োজনীয়তা বুঝতে আমরা বোধ হয় একটু দেরি করে ফেলেছি (শুধু আমরা বললে ভুল হবে, পুরো পৃথিবীই সময়মতো এর ব্যাপকতাটুকু ধরতে পারেনি)। আশার কথা হলো, এখন সরকারিভাবে মানুষকে ইন্টারনেটের ব্যবহার–আদবকেতা শেখাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলোও বিভিন্ন ক্যাম্পেইন আয়োজন করছে।

এ রকম বেশ কয়েকটি আয়োজনে গিয়ে আমি নিজেও ডিজিটাল সাক্ষরতার কথা বলেছি, আমাদের টেন মিনিট স্কুলে এ–সংক্রান্ত বিভিন্ন ভিডিও বানিয়েছি। কিন্তু দিন শেষে কেন যেন আমার কাছে পুরো ব্যাপারটাই ফুটো কলসের মতো মনে হয়। এক দিকে আমরা হয়তো দুজন মানুষকে ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার শেখাচ্ছি, অন্যদিকে আরও দুজন নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হচ্ছেন, যিনি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তিনি হয়তো ফেসবুকের একটা ছবি কিংবা অনলাইনের যেকোনো খবর কোনো যাচাই–বাছাই ছাড়াই অকাট্য সত্য বলে ধরে নিচ্ছেন।

ফেসবুক অনেকটা চিনির মতো—আমাদের শরীর–মনে একধরনের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। চিনি খাওয়া কিন্তু খারাপ নয়। এর মধ্যে শরীরের জন্য কিছু উপকারী উপাদানও আছে। কিন্তু আপনি যদি খাওয়ার পরিমাণটুকু নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন, তাহলে বিপদ। আমাদের সমস্যা হলো, আমরা বলি বাচ্চাদের হাত থেকে মুঠোফোন কেড়ে নাও, ফেসবুক বন্ধ করে দাও। এটা তো সমাধান নয়। যে শিশুটিকে আপনি ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখছেন, কদিন পর ওর ক্লাস হবে ইন্টারনেটে, ওর অফিস হবে ভার্চ্যুয়াল। অতএব, তাকে ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখার কোনো উপায় নেই। বরং ওকে এর সঠিক ব্যবহার শেখান।

একটা মানুষের ইউটিউবের হোমপেজ হলো তাঁর প্রতিফলন। আপনার হোমপেজে কী ধরনের ভিডিও আসে? নাচ, গান, খবর, খেলাধুলা? গান হলে কার গান? কোন ভাষার গান? ইউটিউবের হোমপেজ একনজর দেখেই মানুষটির পছন্দ–রুচি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। আমরা যদি নিজেরাই একবার নিজেদের হোমপেজের দিকে তাকিয়ে ভাবি, তৃতীয় একজন ব্যক্তি আমার হোমপেজ দেখে আমার সম্পর্কে কী ধারণা পাবে, আমি কি নিজেকে এভাবে অন্যের সামনে তুলে ধরতে চাই? তাহলেই কিন্তু নিজেকে বদলানোর তাগিদটা অনুভব করা যায়। পৃথিবীতে যত কিছু আবিষ্কৃত হয়েছে, প্রতিটিরই ভালো–মন্দ দিক আছে। দিন শেষে ভালো–মন্দ নিজের ভেতরে; ইন্টারনেট বা ফেসবুকে নয়।

 লেখক: টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা