রোগী শনাক্ত হলে ঝুঁকি কমবে

সাইফ উল্লাহ মুন্সী ।
সাইফ উল্লাহ মুন্সী ।

বাংলাদেশ করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে। অর্থাৎ দেশে এখনো বিদেশফেরত মানুষের মাধ্যমেই করোনা সংক্রমিত হচ্ছে। তৃতীয় স্তর হচ্ছে কমিউনিটি (স্থানীয় জনগোষ্ঠী) সংক্রমণ, যেদিকে আমরা যাচ্ছি।

দেশে কমিউনিটি সংক্রমণ হবেই। করোনা নিয়ে এই পরবর্তী পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মহামারির এই সুড়ঙ্গ থেকে বের হতে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা দরকার, যেখানে সম্মিলিতভাবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সব বিভাগ কাজ করবে। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিজেদের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়াতে হবে।

করোনার প্রাদুর্ভাব সামলাতে চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, কোয়ারেন্টিন। কোয়ারেন্টিনে সফলতা না এলে দেশকে বড় ধরনের মাশুল দিতে হতে পারে। চীনের উহানফেরত প্রবাসীদের সময় যতটা সফলভাবে কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে, ইতালিসহ অন্য দেশ থেকে আগতদের বেলায় সেটা করা হয়নি। এ কারণে করোনা–আক্রান্ত রোগীদের বড় অংশ হয় এসব দেশ থেকে এসেছেন, না হয় রোগীরা তাঁদের সংস্পর্শে এসেছেন।

বিমানবন্দর থেকে কোয়ারেন্টিনে নিয়ে যাওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ, এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে। কোয়ারেন্টিনের ক্ষেত্রে কোথায় যেন একটা সমন্বয়ের অভাব, যাতে ঝুঁকি বাড়ছে। কোয়ারেন্টিনের মাধ্যমে হয়তো শতভাগ সফলতা আসবে না, করোনা সংক্রমণ সম্পূর্ণ থামানো যাবে না। তবে এটা করতে পারলে রোগীর সংখ্যা কমানো যাবে। পাশাপাশি রোগী বাড়ার হারও কমবে, যেমন ১০ জন থেকে ২০ জন হবে কিন্তু ১০০০ জন হবে না। এতে হাসপাতাল ও চিকিৎসকেরা প্রস্তুতির আরও সময় পাবেন।

দ্বিতীয়ত, প্রবাসীদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত ও তাঁদের কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি তাঁদের পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসা। তাঁদের মধ্যে করোনায় আক্রান্তদের বিচ্ছিন্ন করা গেলে কমিউনিটির মধ্যে সংক্রমণের হার কমিয়ে রাখার সুযোগ বাড়বে।

তৃতীয়ত, কোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত সন্দেহ হলেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। কিটের সীমাবদ্ধতা থাকার পরেও পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হবে। যত বেশি মানুষকে পরীক্ষা করা যাবে, তত বেশি মানুষকে বিচ্ছিন্ন করার সুযোগ বাড়বে, যা সরাসরি রোগীর সংখ্যা বাড়তে না দেওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

চতুর্থত, জনসমাগম বন্ধ করতে হবে। বিশ্বের বহু দেশে জনসমাগমস্থল থেকেই করোনা ছড়িয়েছে। নির্বাচনের মতো জনসমাগম হয় এমন কার্যক্রম ঝুঁকি বাড়াতে পারে।সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে মসজিদে এসে নামাজ পড়া বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

তবে চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করা জরুরি। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তায় ঘাটতি থাকলে তাঁরা প্রাণ উজাড় করে কাজ করতে পারবেন না, তাঁদের মনোবল ভেঙে যাবে, কর্মস্পৃহাও কমে যাবে।

দেশে কেউ কেউ করোনা নিয়ে আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন, আবার কেউ বলছেন, করোনাতে কিছুই হবে না। এই দুই ধরনের আচরণই পরিত্যাজ্য। বাস্তবতার নিরিখে, পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দায়িত্বশীল আচরণ বা মন্তব্য করতে হবে। যাতে জনগণ বাস্তব পরিস্থিতি বুঝতে পারে, সচেতন হয়, সাবধান হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে যেমন আতঙ্কিত হওয়া যাবে না, আবার সমুদ্রেও ভ্রমণে যাওয়া যাবে না। ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিদের ঘরের বাইরে না যাওয়াই ভালো।

করোনা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের গুজব ছড়ানো হচ্ছে, মিথ্যা তথ্য দেওয়া হচ্ছে। বিষয়টি সরকারের আমলে নিয়ে ডিজিটাল মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া দরকার। যেখান থেকে জনগণ সঠিক তথ্য পাবে, করণীয় সম্পর্কে জানতে পারবে। সর্বোপরি, সবার সম্মিলিত উদ্যোগই এই মহামারির ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারে, এখান থেকে বের হওয়ার পথ দেখাতে পারে।

অধ্যাপক সাইফ উল্লাহ মুন্সী: বিভাগীয় প্রধান, ভাইরোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়