গণিত ও বিজ্ঞান

সাধারণ মানুষের অনেকে বিজ্ঞানের মধ্যে গাণিতিক ফর্মুলা, সমীকরণ, অঙ্ক কষা ইত্যাদির ছড়াছড়ি দেখে ভাবেন, বিজ্ঞান সরাসরি প্রকৃতির ব্যাখ্যা নিয়ে থাকলেই পারে, এর মধ্যে গণিত এনে একে অনাবশ্যক জটিল করা কেন। তাঁদের অনেকের ধারণা, সংক্ষেপে গুছিয়ে বলার খাতিরে বিজ্ঞানীরা ইংরেজি-বাংলার মতো সাধারণ ভাষার বদলে বিজ্ঞানীদের নিজেদের জন্য জুতসই গণিতের ভাষা ব্যবহার করেন, প্রয়োজনে একে সাধারণ ভাষায় অনুবাদ করে নেওয়া সম্ভব। এ রকম ভাবাটি ভুল। গণিত ব্যতিক্রমী একটি সাংকেতিক ভাষা মাত্র নয়, এটি মানুষের চিন্তা ও যুক্তি বিস্তারের একটি অনন্য ধারা। বিজ্ঞানের জন্য সেটি খুবই প্রয়োজন।

গণিতের সঙ্গে বিজ্ঞানের সম্পর্কটি চট করে বলতে গেলে, বিজ্ঞান বিশ্বকে বোঝার ও ব্যাখ্যা করার যে কাজে নেমেছে, সেটি অতি কঠিন। এমনকি অসম্ভব হবে, যদি গণিতের সাহায্য না পাওয়া যায়। আসলে বিজ্ঞান কী, এ প্রশ্নের একটি ভালো উত্তর হলো, প্রকৃতির নানা বিষয় নিয়ে অনুমানগুলো যথাযথ গণিতের যুক্তিধারায় অঙ্গীভূত করে সেখান থেকে পরীক্ষণসাপেক্ষ বাস্তব সিদ্ধান্ত টানাই বিজ্ঞান। একটি বক্তব্যকে বিভিন্নভাবে প্রকাশের একটি আশ্চর্য শক্তি গণিতের আছে। তাই তার মাধ্যমে জুতসই প্রকাশে চলে গিয়ে এ রকম সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়। বিজ্ঞানের কোনো শাখা যদি এভাবে গণিতকে ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে সেটি খুব সন্তোষজনক বিজ্ঞান হয় না। তাই গাণিতিক হওয়ার ক্রমাগত চেষ্টা করে যায়, যতক্ষণ পর্যন্ত শাখাটি ওই পর্যায়ে গিয়ে যথেষ্ট উন্নত বিজ্ঞান হতে পারে।

বিজ্ঞানের সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও ভালো করে দেখার আগে বোঝার চেষ্টা করি, গণিত জিনিসটি আসলে কী। খুব প্রাথমিক স্তরে মনে হতে পারে, গণিত বাস্তব জগতেরই একটি বিশেষ ধরনের প্রতিফলন। কিন্তু একটু এগিয়ে গেলেই দেখা যায়, এটি হুবহু প্রতিফলন নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতার অনেকটা বিশুদ্ধ ও বিমূর্ত করে নেওয়া একটি আদর্শ ছবি। বড়জোর বলা যায়, বাস্তব জিনিস গোনার অভিজ্ঞতা থেকে গণিতের একটি প্রথম ধাপ, সংখ্যাপদ্ধতি উদ্ভাবিত হয়েছিল। কিন্তু দুটি ছাগল, তিনটি গরু ইত্যাদি গোনা আর ১, ২, ৩, ৪...এই সংখ্যাপদ্ধতি এক জিনিস নয়। প্রথমটি বাস্তব অভিজ্ঞতা, আর দ্বিতীয়টি একটি গাণিতিক ধারণা, যে ধারণা মানুষের অতি সুন্দর একটি সৃষ্টি। এমনি একটি সৃষ্টি ছিল ভারতীয় গণিতবিদের শূূন্যের ধারণা। এই শূূন্যের সঙ্গে ১ যোগ করে সংখ্যাপদ্ধতির প্রথম সংখ্যাটি পাওয়া যায়, আবার এর সঙ্গে ১ যোগ করলে দ্বিতীয়টি, এমনিভাবে ক্রমাগত করে অসীমভাবে সংখ্যা সৃষ্টি হতে পারে। এ যেন সংখ্যার একটি বিস্ফোরণ, সেভাবে চিন্তা করলে একটি বিস্ফোরণের মতোই বড় ব্যাপার এ ধারণা।

বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে প্রাথমিকভাবে চিন্তার রসদ পেলেও গণিত আসলে গণিতবিদের মনোজগতের সৃষ্টি। গাণিতিক যুক্তি রাজ্যটির উত্স মানুষের মস্তিষ্কে। গণিতবিদেরা একের পর এক অবাক হওয়ার মতো সুন্দর ধারণা সৃষ্টি করেছেন এবং করে চলেছেন। শুধু বাস্তব অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করলে এটি সম্ভব হতো না। এই ক্ষমতার অঙ্কুর জন্ম থেকেই মানুষের মস্তিষ্কে রয়েছে। যেমন মাত্র কয়েক মাস বয়সী যেকোনো বাচ্চার ওপর এক রকম পরীক্ষা করা হয়েছে। তার দৃষ্টির সামনে দুটি একই রকম পুতুল রেখে একটি একটি করে পুতুল দুটিকে পর্দার আড়ালে সরিয়ে তারপর পর্দাটি তুলে নেওয়া হলো। তখন সেখানে দুটি পুতুল দেখা গেলে বাচ্চাটির চোখ অলস ভঙ্গিতে থাকে, অর্থাত্ ১ আর ১ যোগ করলে যে ২ হয়, এটি তার জন্মসূত্রেই জানা, প্রত্যাশিত বলে এই ফলাফল তাকে চমকে দেয় না। কিন্তু যদি পর্দা তোলার পর একটি পুতুল দেখে (আরেকটিকে তার অগোচরে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে), তখন তার চোখ চকচক করে ওঠে, ভুল অঙ্কে বিস্মিত হওয়াটাই যার কারণ।

প্রতিভাবান গণিতবিদেরা মনের আনন্দে গণিতের সুন্দর সুন্দর ধারণাগুলো সৃষ্টি করেছেন, মনের আনন্দেই যুক্তির ধারায় সেগুলোকে নানা দিকে বিস্তৃত করেছেন। এ প্রক্রিয়া চলছে এবং ভবিষ্যতেও চলতে থাকবে; আর গণিতে নতুন নতুন দারুণ সব ধারণা যোগ হতে থাকবে। কেউ সে ধারণাগুলোকে কখনো বাস্তব কাজে অথবা বিজ্ঞানে ব্যবহার করতে পারবে কি না, সেই চিন্তা গণিতবিদের কাছে বড় নয়। কিন্তু প্রায়ই বিজ্ঞানীরা এসব গাণিতিক ধারণার দুর্দান্ত ব্যবহার করেছেন। ওই শুরুতে সংখ্যাপদ্ধতির ধারণায় ফেরত গেলে দেখি, অসীমভাবে সংখ্যা সৃষ্টির সুযোগ ঘটিয়ে এটি অসীমের (ইনফিনিটি) ধারণার জন্ম দিয়েছে, যার সঙ্গে বাস্তবের মিল সামান্যই। গণিতবিদের ধারণা সাধারণ সংখ্যাপদ্ধতিতে সীমাবদ্ধ না থেকে ঋণাত্মক সংখ্যা (উদাহরণ: -৩), ইমাজিনারি নম্বর বা কাল্পনিক সংখ্যা {উদাহরণ: √(-১)}, কমপ্লেক্স নম্বর বা জটিল সংখ্যা {উদাহরণ ২+√(-৩)} এবং এ রকম আরও আশ্চর্যজনক লা-জওয়াব ধারণায় বিস্তৃত হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে এদের কোনো মিল নেই, অথচ ধারণা হিসেবে অদ্ভুত সুন্দর ও শক্তিশালী। সংখ্যাপদ্ধতি ছেড়ে জ্যামিতির কিছু আদি চিন্তায় যাওয়া যাক। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিন্দু ও রেখা থেকে গণিতবিদ বিমূর্ত বিন্দুকে নিয়েছেন ‘যার অবস্থান আছে কিন্তু আয়তন নেই’ এমন জিনিস হিসেবে, আর রেখাকে নিয়েছেন ‘যার দৈর্ঘ্য আছে প্রস্থ নেই’ এমন জিনিস হিসেবে। দুটির কোনোটাই বাস্তব নয়, অথচ এভাবে এগুলো পরবর্তী জ্যামিতির ভিত্তি হতে পেরেছে। এসবের মতো গণিতের সব ধারণাই গণিতবিদেরা নিজেদের গাণিতিক সৃষ্টির প্রেরণাতেই করে গেছেন, তাঁদের পরবর্তী জটিলতর ধারণা গড়তে কাজে লাগিয়েছেন। অন্যদিকে বিজ্ঞানীদের সব কাজ শেষ পর্যন্ত বাস্তবানুগ হতে হলেও তাঁরা এসব বিমূর্ত গাণিতিক ধারণাকে খুবই বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিজ্ঞানের কাজে লাগিয়ে দিতে মোটেই কার্পণ্য করেননি। সেটি না করে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নেওয়া তাঁদের জন্য খুবই কঠিন হতো। কীভাবে তাঁরা কাজে লাগান, সেটি আমরা একটু পরে দেখব।

ওই কাজে লাগানোর ক্ষেত্রটি যতই জটিল হয়, অর্থাত্ বিজ্ঞানীর সামনে প্রকৃতির নিয়ম আবিষ্কারের চ্যালেঞ্জটি যত বড় হয়, গণিতবিদের সৃষ্টি থেকে তত উপযুক্ত জিনিস তাঁকে খুঁজে নিতে হয়। গ্রিক গণিতবিদদের আমল থেকে কোনো কিছুর পরিবর্তনের তাত্ক্ষণিক হার বের করার এবং এমন তাত্ক্ষণিক হারগুলোকে একত্র করে সমষ্টিগত ফলাফল পাওয়ার উল্টো সমস্যাটির ওপর গণিতবিদেরা হাজার বছর ধরে কাজ করেছেন। এর ফলে আধুনিক গণিতে ক্যালকুলাসের ধারণা এসেছে। ক্যালকুলাসের একেবারে প্রাথমিক চিন্তায় আর্কিমিডিস যে রকম চিন্তা করেছিলেন, সেটি দেখা যাক। সব বাহু পরস্পর সমান এমন সব বহুভুজ আঁকতে থাকি এবং পরপর বাহুর সংখ্যা বাড়াতে থাকি। এভাবে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, পঞ্চভুজ, ষড়ভুজ ইত্যাদি পেতে থাকব। বাহুর সংখ্যা যত বাড়বে, তাদের দৈর্ঘ্য তত ছোট হবে, পাশাপাশি বাহুর মধ্যে কোণটি মসৃণ হয়ে আসবে, বহুভুজটিকে ক্রমে বেশি বেশি করে বৃত্তের মতো মনে হবে। অসীমভাবে বাহুর সংখ্যা বাড়ালে এটি বৃত্তই হয়ে যাবে, অথচ বহুভুজ কখনো বৃত্ত হতে পারে না। বৃত্তকে বহুভুজ হিসেবে কল্পনা করে ক্যালকুলাসের গাণিতিক সমস্যার সমাধান হয়, তবে এ জন্য অসীমভাবে ক্ষুদ্রের (লিমিট) ধারণাটি আনতে হয়। আধুনিক ক্যালকুলাসে এই বিমূর্ত জিনিসটি এমনভাবে এসেছে যে ধারণাটির চমত্কারিত্বে রীতিমতো শিহরিত হতে হয়। অথচ এই ক্যালকুলাস ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞানের মতো বাস্তবানুগ জ্ঞান আসতে পারত না; অর্থনীতি, ব্যবসায়িক বিশ্লেষণের মতো আরও অনেক নেহাতই বাস্তব বিষয়ের চর্চাও কঠিন হতো।

এদিকে বিজ্ঞানের পরিচয় ও স্বাতন্ত্র্য সবচেয়ে ভালো ফুটে ওঠে তার পদ্ধতিতে। খুব সংক্ষেপে আজকের বিজ্ঞানের সর্বস্বীকৃত পদ্ধতিটি এভাবে বলা যায়। বিজ্ঞানী তাঁর পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ, অভিজ্ঞতা ও কল্পনাশক্তির মাধ্যমে প্রকৃতির কোনো একটি বিষয় ব্যাখ্যায় একটি অনুমান বা সম্ভাব্য তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। তাঁর চেষ্টা হলো, বাস্তব পরীক্ষণে (এক্সপেরিমেন্ট) প্রমাণ করে এ অনুমানটিকে স্বীকৃত তত্ত্বে পরিণত করা। সেটিই তখন হবে তাঁর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও প্রকৃতির একটি সর্বজনমান্য নিয়ম। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুমানটি সরাসরি বাস্তব পরীক্ষণে প্রমাণ করার কোনো উপায় থাকে না। সে ক্ষেত্রে যেটি করতে হয়, এ অনুমান থেকে যৌক্তিক ধারায় এগিয়ে গিয়ে যেসব সিদ্ধান্তে আসা যায়, সেগুলোকে পরীক্ষণের সম্মুখীন করা যায় কি না দেখা। এই যৌক্তিক ধারাটি গণিতের যৌক্তিক ধারা হলে কাজটি সহজতর ও নির্ভরযোগ্য হয়, কারণ গণিতবিদেরা এমন যৌক্তিক ধারা শতভাগ নিখুঁতভাবে তৈরিই করে রেখেছেন, যাকে আমরা গাণিতিক অঙ্ক কষা বলি। উদাহরণস্বরূপ ১৪ বিলিয়ন বছর আগে বিগ ব্যাংয়ের মাধ্যমে মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল, এই তত্ত্ব সরাসরি পরীক্ষণের কোনো উপায় নেই। কিন্তু এর গাণিতিক রূপ থেকে অঙ্ক কষে জানছি যে তার দ্বারা সৃষ্ট একটি সর্বব্যাপ্ত বিকিরণ আজ এত দিন পর এসে মাইক্রোওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি ধারণ করার কথা। এই বিকিরণের উপস্থিতি ও ফ্রিকোয়েন্সি প্রমাণিত হওয়ায় বিগ ব্যাং তত্ত্বও প্রমাণিত হয়েছে। অনুমানটি থেকে অঙ্ক কষে সিদ্ধান্তটি আসে বলে সিদ্ধান্ত পরীক্ষণে প্রমাণিত হলে অনুমানটিও প্রমাণিত বলে ধরে নিতে হবে। কারণ, আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, গণিত আসলে একই বক্তব্যকে নানাভাবে প্রকাশ করে, তাই ওই অনুমান আর ওই সিদ্ধান্তের মধ্যে মূলত কোনো প্রভেদ নেই। এভাবে যুক্তিধারার মাধ্যমে শুধু অনুমানভিত্তিক তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ শুধু নয়, ওই তত্ত্বের সিদ্ধান্তগুলোর মাধ্যমে তাকে নানাভাবে প্রয়োগ করারও রাস্তা খুলে যায়।

কিন্তু এত সব কিছু হতে গেলে প্রথমেই একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সারতে হবে, সেটি হলো মূল অনুমান বা প্রস্তাবিত তত্ত্বটিকে গণিতের ভাষায় প্রকাশ করতে হবে। এটিই গণিত আর বিজ্ঞানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি কাজ, যার ওপর এই তত্ত্বের ভবিষ্যৎ অনেকখানি নির্ভর করে। এই কাজকে বলা যায় বিজ্ঞানের গাণিতিক ম্যাপিং বা মডেলিং। বাস্তব জায়গাকে যেমন ম্যাপে এনে এরপর সেই ম্যাপ নিয়েই কাজ করি, এ-ও অনেকটা তা-ই। গাণিতিক ম্যাপিং করে যে জ্ঞান, সেটিকেই বিজ্ঞান বলা চলে। ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, বিজ্ঞানের তত্ত্ব বাস্তব বিশ্বের কথা বললেও গণিতের ধারণাগুলো বিমূর্ত এবং প্রায়শ বাস্তবানুগ নয়। কাজেই এ ক্ষেত্রে নিজের প্রস্তাবিত তত্ত্বটি সম্পর্কে বিজ্ঞানীর বিচার-বুদ্ধি এবং গণিতের ওপর তাঁর দখলটি খুবই বড় ভূমিকা পালন করে। সাধারণত শুরুতে তাঁর তত্ত্বের সব খুঁটিনাটির ওপর জোর না দিয়ে তিনি মোটের ওপর এর প্রতিনিধিত্ব করার মতো গাণিতিক ধারণা খোঁজেন। যদি তিনি তাঁর তত্ত্বের দুটি রাশির মধ্যে এমন কোনো সম্পর্ক দেখতে পান, যার সঙ্গে গণিতের কোনো ধারণায় দুটি রাশির মধ্যকার সম্পর্কের কিছুটা মিল রয়েছে, তখন তিনি হয়তো অন্য খুঁটিনাটির দিকে বেশি না তাকিয়ে তাঁর তত্ত্বের জন্য গণিতের ওই সম্পর্কটিই হুবহু গ্রহণ করে নেবেন। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীকে কিছুটা বেপরোয়াও বলা যায়। অনেক ক্ষেত্রে আসলেও দেখা যায় যে মূল অনুমানে না থাকলেও গণিতের মধ্যে ওই অনুমানের কাছাকাছি যা পাওয়া যায়, সেটিই বরং আরও ভালো প্রমাণযোগ্য তত্ত্ব দিতে পারে। এভাবে শেষ পর্যন্ত গণিত প্রকৃতি নিয়ে অনুমানভিত্তিক তত্ত্বকে প্রতিফলিত হুবহু করছে না, বরং ওই তত্ত্বকে নিখুঁত করে এর গ্রহণযোগ্য হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিচ্ছে। গ্রিক দার্শনিকদের থেকে শুরু করে অনেকে যে বলেছেন ‘প্রকৃতির নিয়মগুলো গণিতের ভাষায় প্রকাশিত’, এতে যেন সেই কথারই বাস্তব প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। গণিতের অনেক কিছুই যে বিশুদ্ধ যুক্তিতে মানুষের মস্তিষ্কের সৃষ্ট, সেটি মনে রাখলে ব্যাপারটিকে রীতিমতো অলৌকিক মনে হয়। ভেবে কূল পাওয়া যায় না প্রকৃতির নিয়মগুলো মানুষের মস্তিষ্ককে এত সম্মান কেন দেখাচ্ছে?

এই যে বললাম, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিষয়টি গণিতের ভাষায় এনে, গণিতের অঙ্ক কষে তার ফলাফলকে আবার বাস্তবিক বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তে ফিরিয়ে আনার মধ্যেই বিজ্ঞান ও গণিতের সম্পর্ক। এর একটি প্রাচীনতম উদাহরণ দিয়ে শেষ করব। ১, ২, ৩, ৪ করে সংখ্যা সিস্টেম প্রথম ব্যাবিলনিয়ান গণিতবিদেরাই উদ্ভাবন করেছিলেন। সংখ্যা সিস্টেমের এ গাণিতিক ধারণাটি ব্যাবিলনিয়ানরা বিজ্ঞানের একটি বিষয় বছর, মাস, সপ্তাহ, দিনের গাণিতিক ম্যাপিংয়ের কাজে লাগাতে পেরেছিল। সম্ভবত এটিই দুনিয়ার প্রথম গাণিতিক ম্যাপিং। এর ফলে হয়েছিল ব্যাবিলনিয়ান ক্যালেন্ডার। ম্যাপিংয়ে মাসের প্রথম দিন হয়ে গেল সংখ্যা সিস্টেমের ১, মাসের দ্বিতীয় দিন হলো ২ ইত্যাদি। এরপর এগুলোকে দিন হিসেবে না ভেবে সংখ্যা হিসেবে ভাবা গেল এবং সংখ্যার মতোই সেগুলোর ওপর যোগ, বিয়োগ ইত্যাদি অঙ্ক করা গেল। যেমন ২২ তারিখের ৫ দিন পর কোন তারিখ হবে, সেটি নির্ণয় করতে হলে ২২ সংখ্যাটির সঙ্গে ৫ যোগ করলেই চলে, যেটি বিশুদ্ধ গণিতের কাজ। জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্বটির গাণিতিক ম্যাপিং এভাবে একটি বাস্তব সিদ্ধান্ত পেতে সাহায্য করছে। এখন হয়তো ব্যাপারটিকে হাস্যকরভাবে সহজ মনে হচ্ছে কিন্তু সেদিন এটি ছিল গাণিতিক যুক্তির ভাষায় প্রকৃতির নিয়ম উদ্ঘাটনের, অর্থাত্ বিজ্ঞানের প্রথম উন্মেষ। অত্যন্ত প্রাজ্ঞ মানুষ ছাড়া এই সাহসী পদক্ষেপ কেউ নিতে পারত না।

এরপর নতুন নতুন চমকপ্রদ ধারণা সৃষ্টি করে গণিত যতই শক্তিশালী হয়েছে, গাণিতিক ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞানও ততই শক্তিশালী হয়েছে। আমরা যখন নিউটনীয় গতিবিদ্যা ব্যবহারের চেষ্টা করি, তখন দেখি কীভাবে গতির একটি বাস্তব ঘটনাকে ওখানে ক্যালকুলাসের সমীকরণে ম্যাপিং করা যায়। কারণ, ওই গতিবিদ্যা প্রকৃতির আটপৌরে গতিকে ক্যালকুলাসের বিশুদ্ধ গণিতে পরিণত করেছে। ওই সমীকরণের সমাধান থেকে আমরা আবার আটপৌরে গতির খুঁটিনাটি ফলাফল পাই। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মতো যে অত্যন্ত গণিতনির্ভর তত্ত্ব পদার্থবিদ্যাকে সাফল্যের তুঙ্গে নিয়ে গেছে, তা-ও কিন্তু মূলত ওই একই রকম ম্যাপিংয়ের সৃষ্টি। আধুনিক পদার্থবিদ্যার এসব তত্ত্বে অবশ্য আরও ভালো করে বোঝা যায়, সেখানে গণিত কত বেশি চালকের আসনে। গণিতের ভাষা ছাড়া এসব আধুনিকতম তত্ত্বের কোনো মানেই হতে চায় না। তারপরও ব্যাপারটি মূলত কিন্তু ওই ক্যালেন্ডারের মতোই—গাণিতিক ম্যাপিং।

বিজ্ঞানের সব শাখা এতটা গাণিতিক হয়ে উঠতে পারেনি কিন্তু একই রকম উন্নত হতে চাইলে তাদেরও তা হতে হবে। সে জন্যই এখন দেখি, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয় হোক, ইকোসিস্টেমে নানা প্রাণীর উত্থান-পতন হোক, কিংবা প্রাণীর সম্পূর্ণ জেনোম, অর্থাৎ ডিএনএ জিনগুলোর উদ্ঘাটনেই হোক, কম্পিউটার মডেলিংয়ের মধ্যে গাণিতিক ম্যাপিং করেই বিষয়গুলো ইদানীং অতি শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

লেখক: পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক ও বিজ্ঞান লেখক।