জিন-রহস্য এবং জিনোম সিকোয়েন্স

জিন গ্রিক শব্দ, যার অর্থ ‘কোনো কিছু থেকে উদ্ভূত হওয়া’ বা শিকড়। একটি বিস্তৃত ডিএনএ অণুর নির্দিষ্ট খণ্ডাংশ, যা জীবের বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে তাকে জিন বলে। সব জীবদেহই অসংখ্য কোষের সমষ্টি। সব কোষেই বংশগতিক পদার্থগুলো বহনের জন্য ডিএনএ থাকে। কোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিউক্লিয়াস। এখানেই থাকে ক্রোমোজোম নামের রাসায়নিক তন্তু। ক্রোমোজোম দুই ধরনের নিউক্লিক অ্যাসিড ও দুই ধরনের প্রোটিন দিয়ে গঠিত। ডি-অক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা ডিএনএ হচ্ছে ক্রোমোজোমের একমাত্র স্থায়ী রাসায়নিক উপাদান। এটিই বংশগতির ধারক ও বাহক। পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, ডিএনএ প্রকৃত জেনেটিক বস্তু। এটি দেখতে সুতার মতো, কিন্তু খুবই সূক্ষ্ম। বিজ্ঞানীদের মতে, মানব ডিএনএর প্রায় ১.৫ শতাংশজুড়ে জিনের অবস্থান। প্রতি নিউক্লিয়াসে প্রায় ২০ হাজার প্রোটিন উত্পাদক জিন থাকে। এসব জিনের প্রতিটিতে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন জৈব রাসায়নিক সংকেত। প্রতিটি জিনের কোনোটিতে না কোনোটিতে রয়েছে জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্যের পরিস্ফুটন, যা বংশপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়। প্রতিটি বৈশিষ্ট্য এক বা একাধিক জোড়া জিন দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ধর্মযাজক জোহান গ্রেগর মেন্ডেলের গবেষণায় জিনবিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। পর্যবেক্ষণ থেকে মেন্ডেল ধারণা দিয়েছিলেন, পিতা-মাতা থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় বংশগতির কিছু বিচ্ছিন্ন একক দ্বারা। মেন্ডেলের এই এককই পরবর্তী সময়ে জিন হিসেবে চিহ্নিত হয়। জীবের বাহ্যিক গঠন ও আচরণ নির্ধারণে জিনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কিন্তু জিন ও জীবসত্তার অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে তার বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয়। যেমন যদিও জিন কোনো ব্যক্তির উচ্চতা নির্ধারণ করে, তবু তার শৈশবের স্বাস্থ্য, পুষ্টিও এতে বড় প্রভাব ফেলে। কেউ ফরসা, কেউ কালো; কেউ লম্বা, কেউ খাটো। কারও চুল কালো, কারও সোনালি—এ বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ন্ত্রণ করে একেক জোড়া জিন।

জিনোম হলো জীবের জেনেটিক বৈশিষ্ট্যের বিন্যাস বা নকশা। এর ওপর নির্ভর করে ওই প্রাণী বা উদ্ভিদের বৈশিষ্ট্য। জীবদেহে অসংখ্য কোষের প্রতিটিই সেই জীবের বিকাশ ও গঠনের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা বহন করে। এসব নির্দেশনার সমন্বয়ই হলো জিনোম। ১৯২০ সালে জার্মানির হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞানের অধ্যাপক হান্স ভিংকলার জিন ও ক্রোমোজোম শব্দ দুটির অংশবিশেষ নিয়ে জিনোম শব্দটি প্রচলন করেন। জিনোম সিকোয়েন্স হলো কোষের সম্পূর্ণ ডিএনএ বিন্যাসের ক্রম। জিনোম যত দীর্ঘ, তার ধারণ করা তথ্যও তত বেশি হবে। তবে ব্যতিক্রমও আছে। একটা ডিএনএ কত বড়, সেটা মাপা হয় ক্ষারক-জোড় (বেস-পেয়ার) বা বিপি হিসেবে। ডিএনএর দুটি বিপরীত সূত্রে বিপরীত দুটি ক্ষারককে একত্রে বলে এক বিপি।

জিনোম সিকোয়েন্স বা ডিএনএ বিন্যাসের ক্রম জানার বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। শটগান সিকোয়েন্সিং তার একটি পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জিনোম ক্রম নির্ণয় করেছিলেন। ডিএনএ বিন্যাসের ক্রম সাজানোর জন্য বিজ্ঞানীরা একে ছোট ছোট খণ্ডে বিভাজন করেন। তারপর পাজল জোড়া লাগানোর মতো প্রতিটি অংশ জোড়া লাগিয়ে পূর্ণাঙ্গ ক্রম তৈরি করেন। ফসফেট, সুগার আর চার ধরনের ক্ষারক দিয়ে ডিএনএ গঠিত। একটি ডিএনএ হেলিক্সে এই ক্ষারক বেস অ্যাডেনিন (A), গুয়ানিন (G), থায়ামিন (T) ও সাইটোসিন (S) পর্যায়ক্রমে সাজানো থাকে। ডিএনএ সিকোয়েন্স করা হয় একধরনের হাইটেক সিকোয়েন্সিং মেশিনের সাহায্যে। বর্তমানে আরও উন্নতমানের সিকোয়েন্সার এসেছে। সেই পদ্ধতিকে বলা হচ্ছে নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং বা এনজিএস। এটা কাজ করে অনেকটা আমাদের চোখ যেমন কোনো শব্দ বা বাক্য গঠনে অক্ষরগুলো দেখে মস্তিষ্কে সংকেত পাঠায়, ঠিক তেমনই। সিকোয়েন্সিং মেশিন একটি ডিএনএ খণ্ডাংশে চার ধরনের ক্ষারক বেস কীভাবে সাজানো, তা নির্দেশ করে। একে ইংরেজি অ্যালফাবেটের মতো করে প্রকাশ করা হয়। একটি মানব জিনোমে ৩ বিলিয়নের বেশি ক্ষারক বেস থাকে। তাই একেকটি জিনোম সিকোয়েন্স যেন দীর্ঘ অক্ষরে রচিত দুর্বোধ্য এক রহস্যময় ভাষা। দাঁড়ি, কমা বা ব্যাকরণহীন এ ভাষার মর্মার্থ জানা ও রহস্য উদ্ঘাটনেই বিজ্ঞানীদের সাফল্য নিহিত। এ নিয়েই চলছে গবেষণা। অবশ্য এখন দেখা যাচ্ছে, জিনের ভাষায় বর্ণমালার পাশাপাশি দাঁড়িকমাও আছে। সেগুলো বোঝার চেষ্টা হচ্ছে এক নতুন শাখায়, যার নাম এপিজেনেটিক্স। সে কথা হবে আরেক দিন।

সহজ ভাষায়, কাগজের পৃষ্ঠায় হয়তো একটা চিঠি আমরা লিখতে পারি। পৃষ্ঠাটা কিন্তু চিঠি নয়। বর্ণমালার বর্ণগুলো কোনটি কীভাবে সাজানো আছে, সেটাই চিঠি। সেটাই সংকেত বহন করে আর সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। পৃষ্ঠাটা কেবল অক্ষরগুলোকে ধারণ করছে। অক্ষরগুলোর মিলিত রূপ এক-একটি শব্দ বা বাক্য গঠন করেছে, যা একটি বার্তা বহন করে। ঠিক তেমনি ডিএনএ হেলিক্স হলো পৃষ্ঠা আর সুগার ও ফসফেটের শেকল ধারণ করে থাকা ক্ষারক সংকেত হলো এর বর্ণমালা। এরা ডিএনএর বার্তা বহন করে বা একেকটি বৈশিষ্ট্যের সংকেত বহন করে। জিনোম সিকোয়েন্স জানা মানেই জীবের সব বৈশিষ্ট্য জানা নয়। কারণ, এটি অতি দুর্বোধ্য ও জটিল। এর কোনোটি প্রচ্ছন্ন আবার কোনোটি প্রকট। কোনটি সহ-প্রকট, কোনটি আবার এর কোনটিই নয়। প্রকট জিন কেবল বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। আর প্রচ্ছন্ন জিন তা পারে না। প্রচ্ছন্ন জিন আবার বংশপরম্পরায় কখনো কখনো প্রকাশিত হয়ে যায়। ফলে কৃষ্ণাঙ্গ পিতা-মাতার সংসারে শ্বেতাঙ্গ কন্যা বা খাটো পিতা-মাতার লম্বা সন্তান জন্মাতে পারে।

আধুনিক জিন প্রকৌশলবিদ্যায় একটি ডিএনএ অণুর প্রত্যাশিত অংশ ভেঙে খণ্ডটিকে আলাদা করা হয়। পরে অন্য একটি ডিএনএ অণু নির্দিষ্ট জায়গায় প্রবেশ করানো হয়। ফলে নতুন ধরনের ডিএনএ উত্পন্ন হয়। একে বলে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ। এটি করা হয় জীবের শরীরে কোনো কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য সংযোজনের জন্য। সাধারণত সম্পর্কহীন জীবের ডিএনএর মধ্যে এ সংযুক্তি ঘটানো হয়। যেমন মানুষ ও ব্যাকটেরিয়া। এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে এক কপি ডিএনএ বা জিন খণ্ডকে একই রকমের অসংখ্য কপি তৈরি করা যায়। জীবদেহে কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য যোগ করতে বিজ্ঞানীরা জিনোম সিকোয়েন্স বা জিনবিন্যাস উন্মোচনকে গুরুত্ব দেন। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বেশ আলোচিত বিষয় জিনবিন্যাস উন্মোচন। কারণ জীবদেহে কোন বৈশিষ্ট্যটি কোন জিন নিয়ন্¿ণ করে বা কোন বৈশিষ্ট্যের জন্য কোন জিন দায়ী, তা জানার এটি প্রথম ধাপ।

যুক্তরাষ্ট্রের হিউম্যান জিনোম প্রকল্পের (এইচজিপি) বিজ্ঞানীরা প্রথম মানুষের জিনবিন্যাস উন্মোচন করেন। ২০০০ সালের জুনে প্রথমবারের মতো প্রকাশ করা হয় এ নকশার খসড়া। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০১ সালে হিউম্যান জিনোম প্রকল্প তাদের প্রথম মানব জিনোম নেচার জার্নালে প্রকাশ করে। এক দিন পর সায়েন্স জার্নালে মানব জিনোম প্রকাশ করে সেলেরা জিনোমিক্স।

মানব জিনবিন্যাস উন্মোচন হলেও এর বিশ্লেষণ জটিল, দুর্বোধ্য ও সময়সাপেক্ষ। এ বিশ্লেষণ জানা গেলে কোনো ব্যক্তি তাঁর দেহের রোগ নিরাময়ের জন্য ব্যক্তিগত ওষুধ ব্যবস্থাপনা নিতে পারেন। অর্থাৎ, কোনো রোগীর জিনবিন্যাস অনুযায়ী রোগ নির্ণয় করে সেই অনুযায়ী ওষুধ সেবন করা যাবে। জিনোম সিকোয়েন্সের মাধ্যমে ভবিষ্যতে ক্যানসারের মতো কোনো জটিল রোগ হওয়ার ঝুঁকি আছে কি না, তা-ও জানা যায়। এ ছাড়া বংশগতভাবে তার ভবিষ্যৎ প্রজন্মে কোনো রোগ যেতে পারে কি না, তা-ও আগাম জানা যাবে। অদূর ভবিষ্যতে মানুষ এর সুফল ভোগ করবে—এ প্রত্যাশায় মানব জিনবিন্যাস নিয়ে গবেষণা চলছে। মানুষের না হলেও গবাদিপশু ও ফসলের জিনোম সিকোয়েন্স বা জিনবিন্যাস উন্মোচনে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীদের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। ২০১০ সালে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করে সাড়া ফেলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম। তিনটি ফসল, চারটি জীবাণুসহ ১৯টি জীবের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে তিনি পেঁপে, মালয়েশিয়ার হয়ে রাবার এবং বাংলাদেশের হয়ে পাট ও পাটের ছত্রাকের জীবনরহস্য উন্মোচন করেন।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও চীনের বেইজিং জিনোম ইনস্টিটিউটের (বিজিআই) বিজ্ঞানীরা যৌথভাবে বিশ্বে সর্বপ্রথম মহিষের পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্সে উন্মোচন করেন। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. তোফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে এসেছে আরেক সাফল্য। বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীরা যৌথ গবেষণায় গমের ‘ব্লাস্ট’ রোগের জন্য দায়ী ছত্রাকের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচনে সফল হয়েছেন। এতে বাংলাদেশে ছত্রাকটির উত্স, সবলতা ও দুর্বলতা জানার সুযোগ তৈরি হলো। এখন ব্লাস্ট প্রতিরোধী গমের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছেন তাঁরা।

২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বা ইরির বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৮৯টি দেশের প্রায় তিন হাজার প্রজাতির ধানের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন ও উন্মোচন করেছেন। গেল বছর সেটি সবার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আশার কথা, এর মধ্যে বাংলাদেশের ১৮৩টি ধানের জাত রয়েছে। শিগগিরই কৃষকেরা ধানের জিনোম সিকোয়েন্স প্রযুক্তির সুবিধা পাবেন বলেও জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। ইরির জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবক দলের সদস্য ও রুশ বিজ্ঞানী নিকোলাই আলেকসানড্রাইভ বলছেন, এ আবিষ্কারের মাধ্যমে শস্যে মানুষের শরীরের চাহিদামাফিক বিভিন্ন পুষ্টিগুণ সংযোজন বা বায়োফর্টিফিকেশন করা অধিকতর সহজ হবে। এ ছাড়া এর মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ, পোকামাকড়, বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও ঠান্ডা সহনশীল জাত উদ্ভাবন আরও ত্বরান্বিত হবে। পাশাপাশি পৃথিবীর অর্ধেক মানুষের খাদ্য চাহিদা পূরণকারী শস্যটির বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে। আরেকটি সবুজ বিপ্লবের দুয়ার খুলে দেবে বিজ্ঞানীদের এই অসামান্য উদ্ভাবন।

লেখক: ঊর্ধ্বতন যোগাযোগ কর্মকর্তা, ব্রি, গাজীপুর।

সূত্র: জিনোমনিউজনেটওয়ার্ক ডট ওআরজি