প্রতিপদার্থের প্রথম আলো

বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকের কথা। সে সময় ইংরেজ পদার্থবিদ পল ডিরাক অ্যান্টিম্যাটারের অস্তিত্বের সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। তখন থেকেই বিজ্ঞানীরা পদার্থের সঙ্গে প্রতিপদার্থের যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য বিগত কয়েক দশক কণা পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়েছে মহাবিশ্বের সরলতম ও সবচেয়ে প্রাচুর্যপূর্ণ কণা—হাইড্রোজেনের প্রতিপদার্থ, অর্থাত্ অ্যান্টিহাইড্রোজেনের ওপর। ১৯৯৫ সালের দিকে সার্ন নয়টি অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করতে পেরেছিল। পরের বছর ফার্মিল্যাব তৈরি করে প্রায় ১০০টি অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণু। সম্ক্রতি ইউরোপিয়ান অর্গানাইজেশন ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চের (সার্ন) আলফা কোলাবরেশনের একটি দল প্রথমবারের মতো অ্যান্টিহাইড্রোজেনের বর্ণালি বিশ্লেষণ করতে পেরেছে। গত ২০ ডিসেম্বর নেচার-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা গবেষণাটির ফল প্রকাশ করেছেন। ২০ বছরের চেষ্টায় পাওয়া এ ফলাফল প্রতিপদার্থ নিয়ে গবেষণায় একটি সম্কূর্ণ নতুন দিক উন্মোচন করেছে।

পদার্থ কীভাবে আলো শোষণ বা নির্গমন করে তা নির্ণয়ে সবচেয়ে কার্যকরী পদ্ধতি হচ্ছে বর্ণালিবীক্ষণ (Spectroscop)। এ পদ্ধতি শুধু পরমাণু ও অণুর মধ্যে পার্থক্যই বলে দেয় না, এর সাহায্যে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দূর নক্ষত্র থেকে নির্গত আলো বিশ্লেষণ করে তাদের গঠনও নির্ধারণ করতে পারেন। অতীতে হাইড্রোজেনের বর্ণালি নিয়ে বহু গবেষণা পদার্থ, শক্তি ও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক স্বীকার্য ও মৌলিক নীতি বুঝতে সহায়তা করেছে। কিন্তু প্রতিকণার বর্ণালি নিয়ে গবেষণা ভীষণ কঠিন। প্রথমত, অ্যান্টিহাইড্রোজেন তৈরিতে প্রয়োজন অ্যান্টিপ্রোটন ও পজিট্রন (অ্যান্টিইলেকট্রন)। পজিট্রন ও ইলেকট্রন সব দিক থেকেই এক, শুধু চার্জ ভিন্ন। শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলার সময় পজিট্রন ইলেকট্রন যেদিকে বাঁকে, তার বিপরীত দিকে বেঁকে যায়। একই কথা প্রোটন ও অ্যান্টিপ্রোটনের জন্যও প্রযোজ্য। পদার্থবিজ্ঞানীরা কণাসংর্ঘষক যন্ত্র (Particle Collider) দিয়ে পজিট্রন ও অ্যান্টিপ্রোটন তৈরি করতে পেরেছেন। তবে কণাগুলোর ধর্ম ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করতে তাদের শীতল করে কিছু সময়ের জন্য রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ, সাধারণ পদার্থের সংস্কর্শে আসামাত্র প্রতিপদার্থ গামা রশ্মি বিচ্ছুরণের মাধ্যমে শক্তি উত্পন্ন করে নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

সৌভাগ্যের বিষয়, আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে, অ্যান্টিম্যাটার নিয়ে গবেষণা অনেক দূর এগিয়েছে। আলফা এক্সপেরিমেন্টের পরীক্ষায় চার্জনিরপেক্ষ অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণু পর্যাপ্ত পরিমাণ সময়ের জন্য আটক করে রাখা হয়, যাতে বিজ্ঞানীরা অতিবেগুনি লেজার ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন যে হাইড্রোজেন ও অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানের একই সূত্র মেনে চলে কি না। অ্যান্টিপ্রোটন বা পজিট্রন আটক করা সহজ, কারণ এরা চার্জযুক্ত প্রতিকণা। কিন্তু অ্যান্টিহাইড্রোজেন চার্জ নিরপেক্ষ। বিজ্ঞানীরা অ্যান্টিহাইড্রোজেন আটক করতে একধরনের ম্যাগনেটিক ট্র্যাপ বা চৌম্বকীয় ফাঁদ ব্যবহার করেন। কারণ, অ্যান্টিহাইড্রোজেন সামান্য চৌম্বকত্ব প্রদর্শন করে। অ্যান্টিহাইড্রোজেনে পজিট্রন অ্যান্টিপ্রোটনকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। পদার্থে ইলেকট্রন শক্তি শোষণ করে, নিম্ন শক্তি স্তর থেকে উচ্চ শক্তি স্তরে যায়। তারপর উচ্চ শক্তি স্তর থেকে সেই শক্তি বিকিরণ করেই আবার নিম্ন শক্তি স্তরে ফেরত চলে আসে। পজিট্রনের বেলায়ও ব্যাপারটা তা-ই। একেক মৌলের ক্ষেত্রে এই বর্ণালি একেক রকম দেখা যায়। আলফা এক্সপেরিমেন্টের বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, হাইড্রোজেনের বর্ণালি আর অ্যান্টিহাইড্রোজেনের বর্ণালির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

এ পর্যবেক্ষণের কারণে এখন পর্যন্ত আমরা নিশ্চিত যে প্রতিপদার্থের আচরণ চার্জ-প্যারিটি-সময় প্রতিসমতার (CPT প্রতিসমতা) সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। প্রতিসমতা তত্ত্বমতে, পদার্থ আর প্রতিপদার্থের শক্তিমাত্রা একই হবে। সেটিই এবার পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত (অন্তত হাইড্রোজেনের জন্য হলেও)। পদার্থ ও প্রতিপদার্থের বর্ণালি বৈশিষ্ট্য একই রকম। এটা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ডার্ড মডেলের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, ২০১৩ সালে হিগস বোসন আবিষ্কারের মতোই। এ ছাড়াও অ্যান্টিহাইড্রোজেন পরমাণু আটকানোতে আলফা যে কার্যকারিতা দেখিয়েছে, তা অন্যান্য গবেষণায় সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। সার্নের গবেষকেরা ভবিষ্যতে এ পরীক্ষাটি আরও নিখুঁতভাবে করতে পারবেন বলে আশা করছেন। শুধু স্ট্যান্ডার্ড মডেল পরখ করার একটি নতুন উপায়ই নয়, তাঁরা আশাবাদী, এটি বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্বে পদার্থ ও প্রতিপদার্থের ভারসাম্যহীনতা বুঝতে সাহায্য করবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)

সূত্র: হোম.সার্ন